Published : 26 May 2025, 09:53 PM
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের পথ রাজনৈতিক দলগুলোই নির্ধারণ করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা ঐকমত্য কমিশনের নেই মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, “এটা অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নেবেন যে তারা কীভাবে অগ্রসর হবেন। রাজনৈতিক দলগুলোর আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে কীভাবে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া তৈরি হয়, সেটা হচ্ছে প্রশ্ন।”
সোমবার সংসদ ভবনের এলডি হলে ঐকমত্য কমিশনের কাজের অগ্রগতি তুলে ধরতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন আলী রীয়াজ।
চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি সংবিধান, নির্বাচন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানদের নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে সরকার।
বিভিন্ন সংস্কার সুপারিশের বিষয়ে রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছানো এবং ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন করা এ ঐকমত্য কমিশনের লক্ষ্য। ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করা এ কমিশনকে ছয় মাস সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কী হবে জানতে চাইলে কমিশনের সহ-সভাপতি বলেন, “জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রজ্ঞাপনের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার প্রশ্নটি অনুল্লিখিত আছে। আমরা যখন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মতামত চাই প্রতিটি সুপারিশের ব্যাপারে আমরা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কেও জানতে চেয়েছিলাম। তারা মত দিয়েছে, সেগুলো এক অর্থে আমরা একত্রিত করছি। কিন্তু পাশাপাশি এটাও আমাদের মনে রাখা দরকার যে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটা আসলে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই নির্ধারণ করবে।”
এখানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নেই বলে জানান আলী রীয়াজ।
তিনি বলেন, “কোন কোন বিষয়ে সংস্কার প্রয়োজন, সেগুলোর ব্যাপারে এক ধরনের ঐকমত্যে এসে একটা জুলাই সনদ যদি তৈরি করতে পারি; তাহলে সে সময় এই এটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার প্রশ্নটি আসবে। আমরা আশা করি রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু সংস্কার প্রস্তাবের ব্যাপারে অকুণ্ঠ চিত্তে সমর্থন জানিয়েছেন, বারবার জানাচ্ছেন, তাদের যে কমিটমেন্ট, সেটা প্রকাশ করছেন। আমরা মনে করি যে একটা পথ তারা নির্ধারণ করতে পারবে।”
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, কিছু কিছু বিষয় আশু করা যায়, সেগুলো সরকারকে জানানো হয়েছে। সরকার সেগুলোর কিছু কিছু বাস্তবায়নও করছে। আগামী কয়েক মাসে এগুলোর বাস্তবায়ন হবে।
কমিশনের কার্য অগ্রগতি তুলে ধরার এ সংবাদ সম্মেলনে ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, মো. আইয়ুব মিয়া, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
ব্রিফিংয়ের পর ঐকমত্য কমিশনের প্রধান, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন সদস্যরা।
দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা কীভাবে
ঈদুল আজহার ছুটির আগেই দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শুরুর প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন আলী রীয়াজ।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনাটা আমরা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে শুরু করতে চাই। এবং আমরা আশা করছি যে নিঃসন্দেহে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে আমরা শুরু করব। আমরা আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই শুরু করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। যদি সম্ভব হয় তাহলে মে মাসের শেষের থেকে যদি সেটা সম্ভব না হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে জুনে।”
ঈদের ছুটির বিষয়টি তুলে ধরে কমিশনের সহ সভাপতি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে যে ওই ছুটির আগেই আমরা যেন শুরুটা করতে পারি।”
প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় দলগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে বসে তাদের মতামত শুনেছে ঐকমত্য কমিশন। দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা সেভাবে হবে না।
আলী রীয়াজ বলেন, “প্রথম পর্যায়ে উদ্দেশ্য ছিল ১৬৬টি সুপারিশ এবং প্রতিবেদনগুলোর ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা অবস্থান বোঝা। সেটা তারা তাদের মতামত দিয়েছেন। কমিশন সেটা দলের সাথে আলোচনা করেছে।
“আমাদের দ্বিতীয় পর্যায়ে হবে বিষয়ভিত্তিক। যে সমস্ত বিষয়ে, বিশেষত প্রধান প্রধান যেসব বিষয়ে ভিন্ন মত আছে, সেগুলো নিয়ে আমরা আলাদা আলাদা দল নয়, একত্রিতভাবেই দল এবং জোটগুলোকে সাথে নিয়ে বসার পরিকল্পনা করছি।”
মৌলিক সংস্কারে ঐকমত্য হবে?
মৌলিক সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা হবে জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, সব বিষয়ে ঐক্যমত হবে না; তবে একটি ‘জায়গায় পৌঁছানো’ যাবে বলে তিনি আশা করছেন।
এক পশ্নের জবাবে কমিশনের সহ-সভাপতি বলেন, “মত পার্থক্য আছে। মত পার্থক্যের ক্ষেত্রেও আবার আলোচনার সময় কেউ কেউ কোন কোন দল তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে, তারা অনেকটাই নমনীয়তা দেখিয়েছেন। তারা পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনার সময় এগুলোর ব্যাপারে হয়তো আরো সুনির্দিষ্ট করে অবস্থান নিতে পারবে। এটা আমরা আশা করি।
“সব বিষয়ে তো ঐকমত্য হবে না। কিন্তু মৌলিক বিষয়গুলোতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা।”
তিনি বলেন, “আমরা অনেক বিষয়ে একমত আছি। তাহলে এগুলোকে সরিয়ে রেখে আমরা প্রধান, গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক (সংস্কার সুপারিশ) ব্যাপারে আলোচনা করব। আমাদের বিশ্বাস, আমরা এক জায়গায় আসতে পারব।”
বিষয় নির্ধারণ করে ৪৬ হাজার খানায় জনমত জরিপ
কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কার সুপারিশগুলোর মধ্য থেকে নির্বাচিত কিছু বিষয়ে জনগণের মতামত জানতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাধ্যমে একটি জরিপ পরিচালনার ব্যাপারে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছেন আলী রীয়াজ।
তিনি বলেন, “যে সুপারিশগুলো সম্পর্কে রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্য থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশসমূহ সম্পর্কে জনগণের মতামত নেওয়ার উদ্দেশ্যেই এই জরিপ পরিচালনা করা হবে।’’
জরিপের বিষয়বস্তু এবং প্রক্রিয়া কেমন হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং আরও দুটি কমিশন প্রায় ৪৬ হাজারের বেশি হাউজহোল্ড জরিপ চালিয়েছিল। আমরা সেটাই ব্যবহার করতে চাচ্ছি। কী কী বিষয়ে এবারের জরিপে থাকবে তার জন্য প্রশ্ন তৈরি করতে হবে। কিছু বিষয় নির্ধারণ করে সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করা হবে।’’
নির্বাচন ও সংস্কারে ‘বিরোধ নেই’
এক প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, “নির্বাচন এবং সংস্কার-এর মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। বিরোধটা আসলে এক ধরনের কল্পিত বিরোধ তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। নির্বাচনের প্রক্রিয়া একরকম এবং জাতীয় সনদ তৈরির চেষ্টা সেটা দীর্ঘমেয়াদের লক্ষ্যেই করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে রাজনৈতিক কাঠামোটা এমনভাবে হয়, যার মধ্যে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা পুনরায় উত্থিত না পারে।”
সহ-সভাপতির ভাষ্য, “(সংস্কার, জুলাই সনদ) এটা দীর্ঘ মেয়াদের চিন্তা, আজকের চিন্তা না। আগামীকাল নির্বাচন হবে কিনা ছয় মাস পরে নয় মাস পরে নির্বাচন–এটা এক্ষেত্রে মুখ্য নয়।
“নির্বাচনকেন্দ্রিক যেগুলো, সেগুলোর ব্যাপারে কিছু আশু করণীয় ( আরপিওদের সংশোধনসহ) প্রস্তাব আমরা সরকারের কাছে দিয়েছি। যেগুলো নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের মধ্য থেকে উত্থাপন করা হয়েছে। সেগুলো সরকার দেখছে, তার ভিত্তিতেই হয়ত আগামী নির্বাচনের ব্যবস্থাটা করা হবে। এটাই আমরা আশা করছি”।
সংবিধান সংস্কার হবে? সংশোধন হবে? না পুনর্লিখন হবে? আলী রীয়াজ বলছেন, এটা প্রক্রিয়াগত সিদ্ধান্তের বিষয়।
“এই সিদ্ধান্ত রাজনীতিবিদরা নেবে। যখন এই বিষয়ে এক ধরনের ঐকমত্য হবে যে কী পরিবর্তন করা হচ্ছে। তাহলে কীভাবে করা যাবে সেটা নিয়ে প্রশ্নটা তখন নিষ্পত্তি করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। আমরা তাতে ফ্যাসিলিটেট করতে পারি। কিন্তু এটা আমাদের দায়িত্ব হতে পারে না।”
আরো পড়ুন
সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে সুরাহা হয়নি, দরকার আরও আলোচনা: আলী রীয়াজ
'জাতীয় সনদ' জুলাইয়ের মধ্যেই: আলী রীয়াজ
দুদক সংস্কারে সব দল একমত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারে দ্বিমত নেই
সংস্কারের সুপারিশ: জনগণের মতামত নিতে জরিপ চালাবে ঐকমত্য কমিশন
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সব দল একমত: আলী রীয়াজ