Published : 16 May 2025, 09:02 PM
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ যখন ‘অবমাননাকর’ আক্রমণের মুখে পড়ছে, তখনই ‘সমতা ও ন্যায্যতার’ দাবিতে ঐক্যবদ্ধ থাকার বার্তা এল ‘নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা’ থেকে।
শুক্রবার বিকেলে ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউয়ে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে এই সমাবেশে জড়ো হয়েছিলেন হাজারো নারী। শুধু নারী নয়, অন্যান্য লিঙ্গ বৈচিত্র্যের বহু মানুষ এই আয়োজনে অংশ নিয়ে প্ল্যাকার্ডে তুলে ধরেন সাম্যের দাবি।
যে ক্ষমতা কাঠামো ‘জুলুমবাজি’ জিইয়ে রাখে, সেই কাঠামো ভাঙার প্রত্যয়ের কথা বলা হয় আয়োজকদের ঘোষণাপত্রে।
সমাবেশে অংশ নিতে আসেন জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ও নিহতদের স্বজন, মানবাধিকারকর্মী, পেশাজীবী, শিল্পী, গার্মেন্টস শ্রমিক, চা-বাগানের শ্রমিক, যৌনকর্মী, প্রতিবন্ধী, অধিকারকর্মী, হিজড়া, নানা লিঙ্গ বৈচিত্র্যের মানুষ এবং অন্যান্য প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মানুষ।
বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীদেরও সমাবেশ প্রাঙ্গণে দেখা যায়। তবে তারা কেউ সংগঠনের ব্যানারে সমাবেশে আসেননি বলে আয়োজকরা জানান।
সমাবেশের দর্শক সারিতে দেখা যায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, বাংলাদেশ জাসদের নাজমুল হক প্রধান ও ডা. মুশতাক হোসেন, অধিকারকর্মী খুশি কবির, সংগীতশিল্পী সায়ান, নাট্যকার সামিনা লুৎফা, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদসহ অনেককে। তারা কেউ মঞ্চে উঠে বক্তব্যও দেননি।
কারা আয়োজক?
সমাবেশে এসেছিলেন আবৃত্তিশিল্পী কাজী বুশরা আহমেদ তিথি ও আশরাফুল হাসান।
বুশরা আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই সমাবেশের আয়োজক কারা, তা জানি না। তবে এখানে এসেছি, আমার মনে হয়েছে আয়োজনটি খুবই জরুরি। নারীরা ঘরে-বাইরে নানা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। এখন নানাভাবে নারীদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হবে। এজন্যই সংহতি জানাতে এসেছি।”
আয়োজকেরা বলছেন, এই আয়োজনটি ‘সকল মানুষের’ আয়োজন। নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন কিংবা প্রতিষ্ঠান এই মৈত্রীযাত্রার আয়োজক নয়। সমাবেশে প্রাঙ্গণে আলাদা করে আয়োজকদের কেউ গণমাধ্যমের সঙ্গে কথাও বলেননি।
তবে অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে ঘোষণা দিয়ে বলা হয়, এখানে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ এসেছেন। কেউ যদি গণমাধ্যমে কোনো বক্তব্য দেন, তবে সেই দায় তার ব্যক্তিগত। আয়োজকদের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
প্ল্যাকার্ডে নানা দাবি
অনুষ্ঠানের সূচনা হয় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। পরে চা বাগানের শিল্পীরা গানে গানে শোনান তাদের বঞ্চনার কথা। গান, নাচ, পাঠে নারীদের অধিকারের কথাও উঠে আসে। দর্শক সারিতে আসা কেউ কেউ প্ল্যাকার্ডে তুলে ধরেন নানা দাবি।
প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল- ‘মায়ের আত্মত্যাগ নিয়ে শুধু কবিতা লিখো না, তার শ্রমের মূল্য দাও’; ‘জমি, ঘর, উত্তরাধিকার/ নারীর চাই সম-অধিকার’; ‘কৃষিতে নারীর কাজকে স্বীকৃতি দিতে হবে’; ‘নারী পরিবারে পুরুষের তুলনায় প্রায় ৮ গুণ বেশি কাজ করে- মজুরি নেই, নেই স্বীকৃতি’; ‘তোলো আওয়াজ সমতাভিত্তিক শ্রমের দায়িত্ব পালনে’; ‘নারীর ওপর মবের আঘাত/ইন্টেরিম কি দেবে জবাব ‘; ‘চোখের সংযম কই’; ‘আদিবাসী নারীর অধিকার নিশ্চিত কর’; ‘আমরাই তনু/আমরাই মুনিয়া/আমরাই নুসরাত’; ‘কল্পনা চাকমা কোথায়?’; ‘যৌন কর্মীদের উচ্ছেদ নয়’; ‘পাহাড়িদের পর্যটনের অভিশাপ থেকে মুক্ত কর’; ‘বমদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বন্ধ কর’– এরকম নানা স্লোগান।
সমাবেশে আয়োজকরা যে ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন, তাতে কয়েকটি দাবি তুলে ধরেছেন। সেখানে বলা হয়েছে-
অন্তর্বর্তী সরকারকে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। বিশেষত নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতার হুমকি, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ঘিরে গুজব ও অপপ্রচার, এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আতঙ্ক সৃষ্টির বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
যারা আমাদের সমর্থন চায়- নির্বাচনী অঙ্গীকারের মাধ্যমে হোক বা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে হোক। তাদের স্পষ্ট করতে হবে- নারী, শ্রমিক, জাতিগত, ধর্মীয়, ভাষাগত ও লিঙ্গীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং এসব জনগোষ্ঠীর পূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত মুক্তির বিষয়ে তাদের অবস্থান। বিশেষ করে আসন্ন নির্বাচন থেকে তাদের প্রার্থীদের অন্তত শতকরা ৩৩ ভাগ (ক্রমান্বয়ে জনসংখ্যার অনুপাতে) নারী হতে হবে।
নারী ও প্রান্তিক জনগণের শিক্ষা, রাস্তা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে অন্তর্বর্তী সরকারকে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
হাল না ছাড়ার প্রত্যয়
সমাবেশে আয়োজকদের পক্ষ থেকে পাঠ করা ঘোষণাপত্রে বলা হয়, “আমাদের দাবি, একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, যেখানে সকল মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে বৈষম্যবিরোধিতা ও সাম্যের যৌথ মূল্যবোধের ওপর।”
‘প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা’ নারীসহ অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অগ্রযাত্রায় ‘প্রতিবন্ধকতা’ সৃষ্টি করে চলেছে এবং নারীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রেও ‘বাধা’ তৈরি করছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়, “ব্যক্তিগত আক্রমণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা, এবং অনলাইনে হয়রানি করে রাজনৈতিক পরিসরে নারীর অংশগ্রহণ নিরুৎসাহিত করার তৎপরতা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। বিভিন্ন স্থানে অতর্কিত হামলা, আন্দোলনে বাধা, পরিকল্পিত মব-আক্রমণ, মোরাল পুলিশিং, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, প্রকাশ্যে মারধর, এবং নানান ধরনের হুমকি প্রদান অব্যাহত রয়েছে “
সরকারের নারী সংস্কার কমিশন নিয়ে ‘অপপ্রচার চালানো হচ্ছে’ বলেও অভিযোগ করেছেন মৈত্রীযাত্রার আয়োজকরা।
তারা বলছেন, “কমিশন শ্রমজীবী নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারী ও অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ নারীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ৪৩৩টি সুপারিশ পেশ করে। অন্যান্য সব কমিশনের মতই এ কমিশনের সুপারিশে ছিল নানা আলোচনা-সমালোচনার উপাদান। কিন্তু আমরা দেখেছি রিপোর্ট প্রকাশের পর থেকেই অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত সুপারিশগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গিয়ে এবং গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ না রেখে নানা ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। দেশবাসীর সামনে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হচ্ছে। জনসম্মুখে কমিশনের সদস্যদেরকে জঘন্যভাবে অবমাননা করা হয়েছে।
“এত কিছুর মধ্যে আমরা দেখলাম, জুলাইয়ে অসংখ্য নারীর আত্মত্যাগ ও শহীদদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার নারীর ওপর অব্যাহত নিপীড়ন, অবমাননা ও অপমানের বিরুদ্ধে আশ্চর্যরকম নিশ্চুপ। সরকারের নিজের তৈরি করা নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্যদের ওপর এ ধরনের ন্যক্কারজনক আক্রমণের পরেও সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।”
সহিংসতা ও বৈষম্য চালিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা ‘মেনে নেওয়া হবে না’ বলে বার্তা দেওয়া হয় সমাবেশ থেকে।
আয়োজকেরা ঘোষণাপত্রে বলেন, “আমাদের মৌলিক অধিকারগুলোকে অস্বীকার করার ষড়যন্ত্র আমরা প্রতিরোধ করব। বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা, সংস্কৃতি ও ধর্মকে দমনমূলক অস্ত্রে পরিণত করার চেষ্টা আমরা প্রতিরোধ করব।
“আমাদের সংস্কৃতি, ধর্ম ও ইতিহাস দারুণ বৈচিত্র্যময় এবং সংবেদনশীল। সেই বিশালতাকে উপেক্ষা করে আমরা গুটি কয়েক মানুষের সংকীর্ণ ব্যাখ্যাকে সার্বজনীন হতে দেব না। আমরা অধিকার ও ধর্মের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করতে দেব না, মর্যাদা দিয়ে কোনো ধরনের দ্ব্যর্থকতা মেনে নেব না। আমরা সরকার ও প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নারী বিষয়ক অবস্থান নজরদারিতে রাখব।
“যে ক্ষমতাকাঠামো এসব জুলুমবাজি জিইয়ে রাখে, আমরা সেই কাঠামোকে ভাঙব। আমরা চুপ করব না, হুমকির মুখে নত হব না। আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের দাবিতে অটল থাকব। ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের স্বপ্ন ও তা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমরা হাল ছাড়ব না।”