Published : 05 Jul 2025, 12:13 AM
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় প্রায় দুই বছর ধরে গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল। দক্ষিণ লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেনকেও হামলার লক্ষ্যবস্তু করেছে দেশটি। সবশেষ তাদের আক্রমণের শিকার হয়েছে ইরান।
ইরানে হামলায় ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয় যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইসরায়েলের এই হামলাকে নির্লজ্জভাবে সমর্থন করেছে পশ্চিমা দেশগুলো।
পশ্চিমা নেতারা একটি ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’ এর মন্ত্র আঁকড়ে আছেন, যেন তা বেদবাক্য। কিন্তু বাস্তবে এই পরিভাষাটি কল্পকাহিনী। মধ্যপ্রাচ্য এমনই একটি অঞ্চল, যা প্রত্যেক দশকে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে।
পশ্চিমাদের ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’ এর স্বপ্ন যে ‘অবান্তর’ তা নিয়ে মিডল ইস্ট আই-এ নিজের বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন আবেদ আবু শাহদেহ্।
তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করা আবেদ আবু ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত জাফা সিটি কাউন্সিলে ফিলিস্তিন কমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
তিনি বলেছেন, আরবদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন এক আঞ্চলিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে আরব জাতির দৃষ্টি দেওয়ার সময় এসেছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকোয়ামার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আবেদ আবু বলছেন, ইতিহাসের যে সমাপ্তি ঘটে না তা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাই সাক্ষ্য দিচ্ছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ফুকোয়ামা ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ ঘটেছে বলে নজিরবিহীন এক সাহসী ঘোষণা দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রেরই নয়, উদার গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদী অর্থনীতিরও বিজয় ঘোষণা করেছিলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। কিন্তু নিজের শক্তিমত্তা পুনর্গঠনে রাশিয়ার সময় লেগেছে দুই দশক, জর্জিয়া ও ইউক্রেইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধও ঘোষণা করেছে। আর এখন আত্মবিশ্বাসী এক চীনকে দেখছে বিশ্ব।
তার বিপরীতে উদ্ধার গণতন্ত্র পিছু হটেছে, তার নিজের পরিচয় খুঁজছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গর্ভে জন্ম নেওয়া নতুন এক বিশ্বব্যবস্থার জন্য লড়াই করছে।
ইরান-ইসরায়েল ১২ দিনের যুদ্ধের পর নতুন মধ্যপ্রাচ্যের ধারণাটি আবার সামনে হাজির হয়েছে, যেখানে বলা হচ্ছে, ইরানের নেতৃত্বাধীন প্রতিরোধ অক্ষ দুর্বল হয়ে গেছে। সিরিয়া, লেবানন ও গাজায় তার প্রভাব কমেছে। যদিও গত শতাব্দীর বিভিন্ন সময় এমন দাবি শোনা গেছে।
অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ও পশ্চিমাদের বলি হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বিভাজন ঘটার পর থেকে এ জিগিরই উঠেছে।
প্রতিটি যুদ্ধের পর বলা হয়েছে, নতুন যুগের সূচনা হবে, যা মধ্যপ্রাচ্যকে সমৃদ্ধ করবে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিটি যুদ্ধই নতুন সংঘাতের বীজ বপন করে গেছে।
১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল তিনটি আরব দেশের সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করেছিল। দখল করে নিয়েছিল সিনাই উপদ্বীপ, গোলান মালভূমি ও ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের বাকী অঞ্চল। কিন্তু সে বিজয় ইসরায়েলের জন্য তৈরি করেছে দীর্ঘমেয়াদী বড় চ্যালেঞ্জ এবং তার গর্ভেই বেড়ে উঠেছে ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের শক্তিশালী সংগঠন ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন-পিএলও।
একইভাবে ১৯৮২ সালে লেবাননে ইসরায়েলের সামরিক বিজয় জন্ম দিয়েছে হিজবুল্লাহর মত সশস্ত্র প্রতিরোধ শক্তির, যা ইসরায়েলের জন্য সরাসরি হুমকি তৈরি করেছে। গত চার দশক ধরেই তেল আবিব সরকার হিজবুল্লাহর হুমকির মধ্যে আছে।
আরব দেশগুলো যেমন নিজেদের শক্তিমত্তা বুঝতে বা ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে তেমনি ইসলায়েলও আরবদের সুপ্ত সামর্থ্য অনুধাবন করতে পারছে না।
আরব বসন্ত শুরু হলে, তিউনিসিয়ায় জিনে আল-আবিদিন বেন আলী সরকারের পতন ও মিশরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু পর ইসরায়েল দ্রুত এই গণতন্ত্রের ঢেউ নস্যাতের জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়। বিশেষ করে মিশরের প্রতি মনোযোগ দেয় তারা। এর কারণও সহজবোধ্য, মিশরের জনমত ব্যাপকভাবে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির (মিশর-ইসরায়েলের মধ্যে ১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এই চুক্তি হয়) বিরুদ্ধে। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পক্ষেও নয় মিশরীয়রা।
ফলে ইসরায়েল ২০১৩ সালে সামরিক অভুত্থানের মধ্য দিয়ে মিশরের ক্ষমতা দখল করা জেনারেল আব্দুল ফাত্তাহ আল-সিসির সরকারকে বৈধতা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জোর তদবির করে।
নতুন মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ইসরায়েলের আকাশকুসুম কল্পনার পুনরাবৃত্তি শুধু অবাস্তবই নয়, আরব দেশগুলোর কাছে তার অনেক চাওয়ার ওপরও তা নির্ভর করছে, যা আরব শাসকরা গ্রহণ করবেন না। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র যখন সুদূরপ্রসারী সমঝোতার বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়, সবসময় ইসরায়েল নতুন নতুন চাহিদা সামনে নিয়ে আসে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে ঢুকে হামলা ও জিম্মি করে গাজার স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। তার কয়েক সপ্তাহ আগে সৌদি আরব ‘আব্রাহাম’ চুক্তিতে যোগ দিতে প্রস্তুত বলে শোনা যাচ্ছিল। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবিকে পাশে সরিয়ে এই চুক্তি করতে যাচ্ছিল সৌদি সরকার, যার বিনিময়ে ওয়াশিংটনে ‘তদবিরের সুবিধা’ ছাড়া বাস্তবিক আর কোনো প্রাপ্তি ‘মিলত না’।
গাজা ও লেবাননে হামলার দুই বছর পর ইসরায়েলের অপ্রত্যাশিত আক্রমণের শিকার হয় ইরান। এবারও পশ্চিমা নেতারা ইসরায়েলের অবৈধ হামলাকে সমর্থন দিয়ে গেছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। এছাড়া লাখ লাখ মানুষের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল এই হামলা।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা করেছিল ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র, যা ওই অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য তেজষ্ক্রিয়তাজনিত দুর্যোগের ঝুঁকি তৈরি করেছিল। গোয়েন্দা মূল্যায়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তারা এ হামলা চালিয়েছিল, যা আরেকবার প্রমাণ করে যে তখনই কেবল আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ হয়, যখন পশ্চিমাদের স্বার্থ রক্ষার দরকার হয়।
ইরান-ইরায়েলের এই সংঘাতের গুরুত্বপূণ শিক্ষা হল-এখানে ‘নিশ্চিত বিজয়’ বলে কিছু নেই। বরং এই সংঘাতে নিজেদের সামরিক শক্তি প্রদর্শনের পাশাপাশি দুর্বলতার দিকটিও উন্মোচন করেছে উভয়পক্ষ।
ইসরায়েলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার যেমন শক্তিশালী হয়েছে, তেমনি ইরানে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সরকার জনগণের অনুমোদন পেয়েছে। কিন্তু উত্তেজনা ও ভবিষ্যৎ সংঘাতের আশঙ্কা থেকেই যাবে।
ইরান-ইসরায়েলের এই সংঘাত প্রমাণ করে দিয়েছে আরব দেশগুলো কতটা নগ্ন এবং সামরিক দিক থেকে তারা যে অপ্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে।
এ সংঘাত আরব জাতির সামনে দুটি অন্তর্নিহিত হুমকিও উন্মোচন করেছে। তার একটি হল-ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের শক্তি হিসেবে দাঁড়ানোর সামর্থ্য জানান দিয়ে ইরাক, লেবান ও সিরিয়া জুড়ে ইরান ‘সফট পাওয়ার’ (জবরদস্তি ছাড়াই প্রভাব বিস্তার) হিসেবে নিজেকে ভাবমূর্তি পুনর্গঠনে চেষ্টা করবে।
আর অন্যটি হলো, ভবিষ্যতে ইসরায়েরেল জবরদস্তিমূলক নীতি গ্রহণ করবে, যা ফিলিস্তিনের জনগণকে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে বাস্তুচ্যুত করবে, এর মূল্য চুকাতে হবে আরব দেশগুলোকে।
মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারের জন্য ইরান-ইসরায়েলের লড়াই চললেও অনেক কিছু নির্ভর করছে প্রতিবেশি আরব দেশগুলোর ওপর। দুই বছর ধরে গাজায় গণহত্যা চললেও সেখানে মানুষ নিধন ও দুর্ভিক্ষ রোধ করতে বিশ্ব ব্যর্থ হয়েছে। গত দুই দশক ধরে আরবের রাজনীতিতে যে দুটি ধারা চলছে তা নিয়ে আরব জনগণকে গভীরভাবে প্রশ্ন তুলতে হবে। এই দুটি ধারা হচ্ছে পশ্চিমাপন্থি সেক্যুলারিজম (ধর্ম নিরপেক্ষতা) ও ইসলামিজম। এই দুই ধারার সমর্থকদের দ্বন্দ্ব আরব জনগণকে অরক্ষিত ও অসহায় অবস্থায় ফেলেছে।
সম্ভবত, আরবদের নিজেদের মধ্যে তৈরি হওয়া সত্যিকারের নতুন মধ্যপ্রাচ্যের আকাঙ্খা বাস্তবায়নে কাজ করার সময় এসেছে। যে মধ্যপ্রাচ্যের স্বপ্ন পশ্চিম বা পূর্বের কোনো বাইরের শক্তির মাধ্যমে হাজির হবে না। যে মধ্যপ্রাচ্য প্রথমেই আরবদের স্বার্থ রক্ষা করবে।