Published : 06 May 2024, 11:44 AM
স্ত্রীকে রমনা পার্কে বেড়াতে নিয়ে এসে ‘যারপরনাই’ বিব্রত আল আমিন। কীভাবে বসা যাবে না- সেই ‘জ্ঞান’ দিয়ে গেলেন পার্কের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসারের এক সদস্য।
তাদের বিয়ের এক বছর পূর্তি হয়েছে কদিন আগে। চাকরির কারণে ছুটি না পাওয়ায় একসঙ্গে বেড়ানোর সুযোগ হয় কম। মে দিবসের সরকারি ছুটির ফুরসতে দুজন মিলে উত্তরা থেকে গিয়েছিলেন ছায়া সুনিবীড় রমনা পার্কে।
কিন্তু কেবল লজ্জা নয়, ক্ষোভ নিয়ে তাদের ফিরতে হয়েছে পার্ক থেকে।
গাছের নিচে বেঞ্চে স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে গল্প করছিলেন আল আমিন। মাথায় হাত বুলাচ্ছিলেন স্ত্রী।
হঠাৎ এক আনসার সদস্য একে হাঁক দিলেন, “সোজা হয়ে বসুন। এভাবে বসা যাবে না।”
আল আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আনসারের এমন আচরণে আমি খুবই লজ্জা পেয়েছি। স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে পার্কে শোয়া যাবে না এটা কোন আইনে আছে?”
সঙ্গী নিয়ে পার্কে আসা বহু মানুষের এমন অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু এ নিয়ে প্রতিবাদও তারা করতে পারেন না বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভয়ে।
গুলিস্তান থেকে আসা আল আমিন নামেরই আরেকজন ক্ষুব্ধ হন আনসারের আচরণে।
তিনি বলেন, “এখানে আনসারদের নিয়ে কেমন যেন আতঙ্কে থাকা লাগে। হাত ধরে হাঁটতে গেলেও তারা যেন কেমন করে তাকায়, মনে হয় এইতো কিছু বলবে এবার। নিজের বান্ধবী নিয়ে হাত ধরে যদি হাঁটতে না পারি তাহলে ‘বান্ধবীর সঙ্গে প্রবেশ নিষেধ’ করে দিক।”
গেটে হেনস্তার শিকার হওয়ার অভিযোগ করছেন মাহমুদ হোসাইন অপু নামে আরেকজন।
পার্কে খাবার নিয়ে ঢোকা নিষেধ। খাবার আছে কি না, তা দেখতে স্ত্রীর ব্যাগ পরীক্ষা করেছে পুরুষ আনসার সদস্যরা। এ সময় তারা দুর্ব্যবহারও করেছে।
মাহমুদ বলেন, “আনসারদের আচরণে একটু পরিবর্তন আনা জরুরি। নাগরিকদের সঙ্গে তারা কেমন আচরণ করবে সে বিষয়ে একটা প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার।
“পরিবার নিয়ে সেখানে মুক্ত বাতাসে একটু হাঁটাহাঁটি করতে যাই। কিন্তু আনসারদের আচরণের কারণে পরিবারের সামনে বিব্রত হতে হয়।”
নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম মনে করেন, আনসার সদস্যদের এই ধরনের আচরণ করা উচিত না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পার্কে যুগলরা সামাজিকতা মেনেই বসবে, আড্ডা দেবে, নিজেদের মাঝে একটু ভাব বিনিময় করবে। এতে নিরাপত্তা কর্মীরা কেন বাধা দিতে যাবে?
“শালীনতা বজায় রেখে বসতে হবে মানুষদের। মানুষ সামাজিকতা মেনে চলবে। এখানে দারোয়ানদের ঘুরে ঘুরে পাহারা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। দারোয়ানদের নাগরিকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না,তাদের আচরণে পরিবর্তন আনা উচিত।”
রমনা পার্ক গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হয়। আনসার সদস্যদের এমন করতে বলা হয়েছে কি না- এই প্রশ্নে অধিদপ্তরের উপ সহকারী প্রকৌশলী মো. শিহাব বলেন, “এই দায়িত্ব কাউকে দেওয়া হয়নি।”
পার্কে সামাজিকতার মানদণ্ড কীভাবে ঠিক করেন? – এই প্রশ্নে তিনি সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, “আমার দায়িত্ব হচ্ছে রক্ষণাবেক্ষণ। আইন প্রয়োগের বিষয়ে তেমন কেউ নেই।
“আনসার সদস্য দিয়েই আমরা সুশৃঙ্খল পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা করি। আমাদের হাতেই যেহেতু দায়িত্ব তাই আমরা চেষ্টা করি সবকিছু দেখভাল করতে। কিন্তু আইন প্রয়োগের দায়িত্বে কিন্তু আমি না। আর এ দায়িত্বে এখানে নির্দিষ্ট কেউ নাইও।”
এই ‘নীতি পুলিশিং’ কেন করেন, এই প্রশ্নে দায়িত্ব পালন করা আনসার কর্মীরা নাম প্রকাশ করে কিছু বলতে রাজি হননি। তাদের ভাষ্য, ব্যক্তিগতভাবে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ তাদের নেই।
তবে পার্কে দায়িত্বরত একজন সদস্য এই ভূমিকার জন্য গর্ব করে বলেন, “আমরা পার্কটার পরিবেশ ঠিক রাখতে কাজ করে যাচ্ছি। সজাগ দৃষ্টি রাখি বলে এখন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মানুষ পার্কে ঘুরতে এসে বিব্রত হতে হয় না।“
আনসার সদস্যদের মাধ্যমে দর্শনার্থীদের হেনস্থার বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে রমনা থানার আনসার ও ভিডিপি অফিসার মো. আবিদুল হাসান শিমুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিয়োগের সময়ই বিভিন্ন ক্যাম্পের মাধ্যমে কী করা যাবে বা কী করা যাবে না, এসব শেখানো হয়। এরপর কেউ কিছু করে থাকলে এ দায়ভার একান্ত তার। আর কারো বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাই আর সত্যতা মেলে সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
গ্রীষ্মের সকাল বা বিকালে ঝিরঝিরে বাতাসে রাজধানীতে সময় কাটানোর দারুণ এক জায়গা রমনা পার্ক। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতাও কম হয় না।
গেটে বা ভেতরে আনসার সদস্যরা অযাচিত হস্তক্ষেপ করেন, এমন অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি তাদের উদাসীনতায় ভেতরে বাচ্চাদের পার্কে খেলার উপকরণগুলো বড়রা ব্যবহার করে নষ্ট করে ফেলার ঘটনাও আছে।
তীব্র গরমেও পার্কে খাবারের পাশাপাশি পানি নিতেও প্রায়ই বাধা দেন আনসার সদস্যরা। হকাররা মাঝেমধ্যে পানি বিক্রি করে, তবে দাম নেয় বেশি।
সৌরভ ইসলাম নামে একজন বলেন, “গরমে এত বড় পার্কের ভেতরে কোথাও এক বোতল পানি খাওয়ার সুযোগ নাই। হকার নাকি ঢুকতে দেয় না। কিন্তু পানি বিক্রেতাদের ঢুকতে দেওয়া উচিত।”
স্কুল বা কলেজের পোশাক পরা থাকলে কাউকে ঢুকতে দেয় না আনসার সদস্যরা।
বাহিনীটির এক সদস্য বলেন, “তারা স্কুল ফাঁকি দিয়ে যেন পার্কে প্রবেশ না করতে পারে সেজন্য এই ব্যবস্থা।”
দুপুরে ‘অবাঞ্ছিত’ নাগরিকরা
পার্ক খোলে সকাল ৬ টায়। বেলা ১২ থেকে ২টা পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়। এরপর খোলা থাকে রাত ৮টা পর্যন্ত।
দুপুরের এই দুই ঘণ্টা ধরে পার্কের ভেতরে থাকা মানুষদের বারবার তাগাদা দেওয়া হয় বের হয়ে যেতে। তবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে পার্ক ব্যবহারকারীদের প্রশ্ন আছে।
তবে দুপুরে ঢোকার এই নিষেধাজ্ঞা আবার ‘সবার জন্য না’। পার্ক ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, গণপূর্তের লোক বললেই ঢুকতে দেওয়া হয় এই ‘নিষিদ্ধ সময়েও’, যদিও আনসার সদস্যরা সেই অভিযোগ স্বীকার করতে নারাজ।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. শিহাবের দাবি, দুপুরে বন্ধ থাকার সময় একবার একজন এডিসি এসেছিলেন। তিনি তার পদের কথা বলে ঢুকতে চেয়েছেন। কিন্তু সবার জন্য নিয়ম জানিয়ে আনসার সদস্যরা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
সকালে মগবাজারের আদ দ্বীন হাসপাতালে ডাক্তার দেখিয়ে স্ত্রী ও বাচ্চাকে নিয়ে সাড়ে ১২ টায় রমনা পার্কে এসেছিলেন তারেকুর রহমান। তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। কিছু রোগ পরীক্ষা করিয়েছেন যেগুলোর রিপোর্ট পাবেন বিকেলে। দুপুর রমনায় ঘুরে সময় কাটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। তবে দেড় ঘণ্টা ঢুকতে না পেরে বেশ আশাহত হন তিনি।
তারেকুর বলেন, “দুপুর বেলা কী কারণে বন্ধ রাখে সেটা আমার বুঝে আসে না। দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার পর ঢুকতে পেরেছি। এই সময়টা পার্কের বাইরে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করেছি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে।”
সৌরভ ইসলাম স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে এসেছেন পার্কে। তিনি বলেন, “আগে সকাল থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত খোলা থাকত। কয়েক বছর ধরে দুপুরে কেন বন্ধ করে দেয়, সেটার কোনো যুক্তি খোঁজে পাই না।”
দুপুর থেকে দুই ঘণ্টা কেন বন্ধ থাকে, এ প্রশ্নে পার্কে নিয়োজিত আনসার বাহিনীর সদস্যরা বললেন, সে কারণ তাদের জানা নেই। তবে অনেক মানুষ এসে গেটে খুলে দেওয়ার আবদার করে।
“কিন্তু আমাদের তো নিয়ম মানতেই হবে। কাউরে ঢুকতে দেই না,” বলেন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজন।
পার্ক বন্ধ থাকার কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দিনের বেলায় মাঝখানে আবার বন্ধ থাকবে কেন? করোনার সময় বন্ধ করেছিল সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু এখন বন্ধ রাখার তো কোনো যুক্তি নেই।
“মানুষ ঘুরে বেড়াবে, মুক্তভাবে বাতাস খাবে এরকম পার্ক ঢাকায় খুব একটা নেই। সেখানে রমনা পার্ক দিনের বেলা নির্দিষ্ট সময় বন্ধ রাখাটা খুবই অনুচিত।”
গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপ সহকারী প্রকৌশলী মো. শিহাব প্রথমে বলেন, “ওয়াশরুম ক্লিনিং ও পার্ক মেইনটেইন্যান্সেনর জন্য তো সময় দিতে হবে। দুপুরে যে সময়টা বন্ধ থাকে এই সময়টা টয়লেট পরিষ্কার করা হয়। পার্ক খোলা থাকলে তো টয়লেট পরিষ্কার করা সম্ভব না।”
পরে তিনি বলেন, “আমরাও চাই সময়টা একটু পরিবর্তন করা হোক।”
দুপুরে পার্কে ঢোকা নিয়ে ফটকে আনসারদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি, এমনকি হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে জানিয়ে এই কর্মকর্তা নিজেই বলেন, “বিভিন্ন দিবসে বা শুক্রবারে মানুষের ভিড় থাকে বেশি। সেদিনগুলোতে সকালে আসা মানুষদের বের করা যে কত কষ্ট তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না।
“যারা ঢাকায় ঘুরতে আসে তারা একটু স্বাচ্ছন্দ্যে এখানে ঘুরতে আসে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ১১ টার দিকে ঢুকলে তাকে ১২ টার সময় বের হয়ে যেতে হচ্ছে। মাঝখানে ভাঙা সময়ের জন্য তারা বের হয়ে যেতে হচ্ছে। করোনার সময় যেভাবে সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল তা এখনও আছে।”
সময় বাড়ানোর দাবি
পার্ক ব্যবহারকারীরা বরং সময় আরো বাড়ানোর দাবি করছেন। রাত ৮টাতেই বন্ধ না করে আরো কয়েক ঘণ্টা খোলা রাখার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
সিদ্ধেশ্বরী থেকে রমনা পার্কে শরীর চর্চা করতে এসেছেন বরকুতুল্লাহ শামস। তিনি প্রতিদিন বিকেলে আসেন। তিনি বলেন, “সন্ধ্যায় আমার প্রাইভেট থাকায় গরমে বিকেলেই আসতে হয়। যদি রাত ১০ টা পর্যন্ত খোলা থাকত পার্কটা তাহলে রাতেই আসতাম।”
অধ্যাপক নজরুল ইসলামও বলেন, “সকালে খোলার পর একেবারে রাত ৯ কিংবা ১০ টায় বন্ধ করা যেতে পারে। এখন গরমকাল ৭টার দিকে সন্ধ্যা হয়। তাই রাতের সময়টা বাড়ানো দরকার। আবার শীতকালে চাইলে বন্ধের সময়টা কমিয়ে ফেলতে পারে।”
এই দাবির বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপ সহকারী প্রকৌশলী মো. শিহাব বলেন, “আমাদের পক্ষ থেকে পার্ক বন্ধের সময় রাত ৮ টা থেকে বাড়িয়ে ৯ বা সাড়ে ৯ টা করার জন্য একটা চিঠি দেওয়া হয়েছে কর্তৃপক্ষের কাছে।”