Published : 10 May 2025, 01:55 AM
মিয়ানমারে সংঘাতে চলার মধ্যে দেশটির রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘের ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে ‘মানবিক করিডোর’ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের নানা ধরনের বক্তব্য আসার প্রেক্ষাপটে এ বিষয়ে সতর্ক পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ।
এই করিডোরের বিষয়ে সব তথ্য স্পষ্ট না হলে আগানো উচিত হবে না মত দিয়ে তিনি বলেন, করিডোরের পুরো নিয়ন্ত্রণও বাংলাদেশের হাতে থাকা দরকার।
“না হলে কোনো অবস্থায় এটার দিকে যাওয়া উচিত হবে না। এটা একটা ফাঁদ হিসেবে দেখে দেবে, পরে আমাদের গলায় ফাঁস হিসেবে পড়ে যাবে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হতে হবে।”
বাংলাদেশ আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার ‘প্রত্যাবাসনযোগ্য’ বলে মিয়ানমার সরকারের তরফে জানানোর পর এ নিয়ে কিছুদিন আলোচনা ছিল। কিন্তু তাদের ফেরত পাঠানোর আশা একদিনে যেমন ফিকে হয়ে গেছে, অন্যদিকে নতুন করে আরো অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
ফয়েজ আহমদ বলেছেন, মিয়ানমারের তরফ থেকে প্রত্যাবাসনযোগ্য রোহিঙ্গাদের তথ্য জানানো একটা ইতিবাচক খবর। কিন্তু খুব যে অগ্রগতি কিছু হয়েছে তাও না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ‘ইনসাইড আউটে’ অতিথি হয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সাবেক চেয়ারম্যান ফয়েজ আহমদ।
ভারত-পাকিস্তানে চলমান সংঘাত নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান, ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েন, পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব, মিয়ানমারে সম্ভাব্য মানবিক করিডোর, রোহিঙ্গা সংকটসহ নানা প্রসঙ্গে নিজের বিশ্লেষণ তিনি আলোচনায় তুলে ধরেছেন।
শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হয়।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে অগ্রগতি কি খুব হয়েছে?
থাইল্যান্ডের ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে ৪ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সঙ্কট ও সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক হয় মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ থান শিউর।
সেখানে থান শিউ জানান, বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকা আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা থেকে আংশিক যাচাই বাছাইয়ে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ‘যোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে মিয়ানমার।
এছাড়া আরও ৭০ হাজার রোহিঙ্গার চূড়ান্ত যাচাই বাছাইয়ের অংশ হিসেবে ছবি ও নাম মিলিয়ে দেখার কাজ চলছে। ওই তালিকার বাকি সাড়ে ৫ লাখ রোহিঙ্গার যাচাই বাছাই কাজও দ্রুত সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মিয়ানমার।
এ বক্তব্য আসার পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
ফয়েজ আহমদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, যেসব অগ্রগতি হওয়া দরকার সেসব বিষয়ে কোনো অগ্রগতি তার চোখে পড়েছে কি না?
জবাবে তিনি বলেন, “অগ্রগতি কি খুব হয়েছে? আমি সেটা মনে করি না।”
মিয়ানমারের জান্তা সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী বর্তমানে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকে দেওয়া তথ্য তুলে ধরে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, “এইটা শুনে খুব অস্থির সবাই। কিন্তু আসলে তো এদের (জান্তা) এখন এখানে নিয়ন্ত্রণই নাই। এটা একটা ইতিবাচক খবর, ভালো। কিন্তু ওইটাতে অস্থির হওয়ার কিছু নাই। খুব যে অগ্রগতি কিছু হয়েছে তাও না।”
‘করিডোরের সব তথ্য প্রকাশ্যে আনা দরকার’
২০২১ সাল থেকে সামরিক জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত মিয়ানমার। গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের লাগোয়া রাখাইন রাজ্যের পুরোটা দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি। শুধু এ রাজ্যের কায়ুকফায়ু সমুদ্রবন্দরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পেরেছে সামরিক জান্তা।
রাখাইনে যুদ্ধের তীব্রতার মধ্যে গত নভেম্বরে ‘রাখাইন: গড়ে উঠছে একটি দুর্ভিক্ষ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি-ইউএনডিপি।
এর মধ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের ঢাকা সফরের পর গত ৮ এপ্রিল বাংলাদেশের ‘মানবিক সহায়তা চ্যানেল’ বিষয়ে প্রথম ধারণা দেন প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান।
এরপর বিভিন্ন সময় সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে এ বিষয়ে নানা ধরনের বক্তব্য আসছে।
ফয়েজ আহমদ বলেন, “একটা করিডোরের প্রশ্ন চলে এল। এই করিডোরটা হলে আমরা রোহিঙ্গাদের এই করিডোর দিয়ে ফেরত পাঠাতে পারব, এরকম একটা ধারণা মানুষের মনে এল। আমিও মনে করি যে এটা হয়ত হতে পারে। যদি সেরকম কিছু করা যায়, তাহলে তো খারাপ না।”
কিন্তু করিডোর নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে, যেগুলোর উত্তরও পাওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।
ফয়েজ আহমদ বলেন, “করিডোরটা কে চালাবে, কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, কী আসা-যাওয়া করবে? বলা হচ্ছে, মানবিক করিডোর, নিশ্চিত করবে কে? সুতরাং এটা নিয়ে যখন কথাবার্তা হচ্ছে, আমি তখন বলছি একটা কথাই যে–পূর্ণ তথ্য আমাদের কাছে থাকবে। কোনো তথ্যই আমাদের কাছে গোপন করা হবে না।”
করিডোরের পুরো নিয়ন্ত্রণ যে বাংলাদেশের হাতে থাকা দরকার এবং তা নাহলে বিপদের আশঙ্কা যে থেকে যায় সে বিষয়টিও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি।
ফয়েজ আহমদ বলেন, “ত্রাণ কখন যাবে, কখন যাবে না, কে যাবে, কে যাবে না এবং যে কোনো সময় আমরা এটা বন্ধ করে দিতে পারি অস্থায়ীভাবে বা স্থায়ীভাবে, সেটা থাকতে হবে।
“সেই ক্ষমতা আমাদের হাতে পুরোপুরি থাকলে এবং আমরা যদি নিশ্চিত হই যে আমাদের সেই শক্তি আছে, যেই নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে দেওয়া হল, সেটা আমরা ব্যবহার করতে পারব, সেরকম আমাদের নিজেদের উপর আত্মবিশ্বাস থাকলে তখনই আমাদের এটাতে আগানো উচিত।
“না হলে কোনো অবস্থাতে এটার দিকে যাওয়া উচিত হবে না। এটা আমাদের গলায় ফাঁস হিসেবে পড়ে যাবে। সুতরাং আমাদের সতর্ক হতে হবে।”
সরকারের দপ্তর থেকে নানা রকম মন্তব্য করার বিষয়টি তুলে ধরে সাবেক রাষ্ট্রদূত ফয়েজ আহমদ বলেন, “করিডোর নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বিভিন্ন রকমের বক্তব্য আসতে লাগল। একজন এটা বলছে তো আরেকজন ওটা বলছে। একজন বলছেন-‘না কোনো আলোচনাই হয় নাই’, একজন বলছেন-‘আমরা নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছি শর্ত সাপেক্ষে’। তারপরে কেবল প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে, কেউ বলছেন।
“তো এইরকম কথাবার্তার পরে তারপর আস্তে আস্তে এখন এই বিষয়টা ধামাচাপা পড়ে গেছে। আমি মনে করি যে খুব ভালো হয়েছে, এটা নিয়ে আগানো উচিত না।”
পরামর্শ না করলে ‘সন্দেহের কারণ থাকে’
করিডোর দেওয়া নিয়ে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল জোরালোভাবে বিরোধিতা করছে। সে বিষয়ে তার মতামত জানতে চাইলে ফয়েজ আহমদ বলেন, “তাদের আপত্তির মূল কারণটা হল-এটা একটা খুব বড় সিদ্ধান্ত। হ্যাঁ, এটা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত একটা বিষয়।
“সুতরাং, সবার সাথে আলাপ না করে কীভাবে করতে পারে? তারপরে অন্তর্বর্তী সরকার তো অন্তর্বর্তী সরকারই। যদিও গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসছে।”
দলগুলোর আপত্তি যথার্থ এবং সরকার নিজের ঘাড়ে ‘বেশি দায়িত্ব’ নিয়ে নিচ্ছে–যা তার নেওয়ার কথা নয় বলে মনে করেন তিনি।
“তার ফলে হয়েছে কি যে, লোকে এটাকে ভুল বোঝার সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং ভুল বুঝছে। সেইজন্য সবাই বলছে যে এটা তো এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুমি আমাদের সাথে আলাপ আলোচনা করা ছাড়া কীভাবে এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছ।
“রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্নভাবে, তারা বিভিন্ন সময় ভোটে জিতেছে বা সরকার গঠন করেছে। সুতরাং তাদের তো অবশ্যই একটা অধিকার আছে। আর এখন যারা ক্ষমতায় আছে, তারা তো তাদের সে অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। সুতরাং আমার মনে হয় যে দলগুলোর যে আপত্তি, সেগুলো যথার্থ।”
করিডোরের আলোচনায় সবপক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিয়ে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, “সবাইকে এখানে নেওয়া উচিত। কি কি হচ্ছে, না হচ্ছে সবাইকে আস্থায় নেওয়া উচিত। শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলো না সাধারণ মানুষের সাথে এই ব্যাপারে আরো খোলামেলা হওয়া উচিত। একটা স্বচ্ছতা থাকা দরকার।
“আর কি করা উচিত, সেটা ব্যাপারে পরামর্শ করা দরকার। উচিত কি অনুচিত সেটা পরামর্শ করা দরকার। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যারা আছেন তাদের সাথে বসে পরামর্শ করা দরকার। সবসময় তাদের পরামর্শ মানবে সরকার, এমন নিশ্চিত না। কিন্তু পরামর্শ না করলে যথেষ্ট সন্দেহের কারণ থাকে।”
আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ‘যুক্তিযুক্ত’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথা যখন বলা হয়, তখন স্বভাবতই রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ আরাকান আর্মির হাতে থাকার বিষয়টি সামনে আসে, কারণ সেখানেই রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে। সেটি জান্তা সরকারের হাতে নেই। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ বলছে যে তারা আরাকান আর্মির সাথেও কথা বলছে। এটি কতটুকু যুক্তিসঙ্গত?
সাবেক রাষ্ট্রদূত ফয়েজ আহমদ মনে করেন তা ‘পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত’।
রাখাইনের পরিস্থিতি কেমন হতে পারে? তার কয়েকটি দৃশ্যকল্প তুলে ধরে তিনি বলেন, “যদি আমরা চিন্তা করি, এক হল যে আরাকান আর্মি পুরো রাখাইন স্বাধীন করে ফেলল। যদিও তারা এখন পর্যন্ত কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা চায় নাই। তবুও অনেকেই মনে করছে যে, এখানে এরা স্বাধীন করে ফেলবে বা স্বাধীনতা ঘোষণা করে ফেলবে।
“তাহলে একটা নতুন দেশ তৈরি হবে। তখন তো আর জান্তার কোনো ক্ষমতাই থাকল না। তখন এদের সাথে ছাড়া আর কার সাথে আপনি যোগাযোগ করবেন? সেই যোগাযোগ এখনই থাকা ভালো। আগে থেকে না থাকলে পরে যোগাযোগ স্থাপন করা কঠিন হতে পারে। সুতরাং এটা যুক্তিযুক্ত।”
ফয়েজ আহমদ বলেন, “তারপরে অন্য একটা সিনারিও যদি ধরি–এরা ঠিকই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল এলাকার কিন্তু তারা স্বায়ত্তশাসন গ্রহণ করল। তারা পুরো স্বাধীনতা ঘোষণা করল না। তাহলে জান্তারও কিছু বক্তব্য থাকবে। জান্তার সাথে আমাদের আগে থেকেই যোগাযোগ আছে। কিন্তু এদের সাথেও যোগাযোগটা এইজন্য জরুরি যে, তারা স্বায়ত্তশাসিত হলে তো এই এলাকায় তারাই শাসন করবে। নিয়মকানুন তারাই করবে।”
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য হলেও এই যোগাযোগ জরুরি মনে করেন তিনি।
ফয়েজ আহমদ বলেন, “রোহিঙ্গারা ওইখানে (রাখাইনে) যদি ফেরত যায়, তাহলে বসবাস করবে কাদের সাথে? রাখাইনদের সাথে। সুতরাং সেই অবস্থাতেও রাখাইনদের সাথে বা রাখাইনদের প্রতিনিধি যারা, তাদের সামরিক প্রতিনিধি হোক আর রাজনৈতিক প্রতিনিধি, তাদের সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক থাকা ছাড়া তো এটা সম্ভব না।
“রোহিঙ্গাদের সাথে তাদের একটা অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সুতরাং এ যোগাযোগটা খুব জরুরি। যোগাযোগের মাধ্যমে যদি সেই অবিশ্বাসটা দূর করা যায়, না হলে তো মোটেই সম্ভব হবে না সেই প্রত্যাবাসন।”
মুদ্রার অন্যপিঠে হলেও আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে তুলে ধরে তিনি বলেন, “আরেকটা হতে পারে কী, এদেরকে (আরাকান আর্মি) আবার পরাস্ত করে জান্তা ফেরত আসল পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণে। তাহলেও তারা তো আর ওই কেন্দ্র থেকে এখানে শাসন চালাতে পারবে না। হয়ত কেন্দ্রীয় শাসন ওখানে থাকবে। কিন্তু ওখানে স্থানীয় প্রশাসন চলবে তো বেশিরভাগ লোকই থাকবে হল রাখাইন।
রোহিঙ্গারা ফেরত গেলে তাদের সেখানে রাখাইন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বসবাস করতে হবে তুলে ধরে এই কূটনীতিক বলেন, “তো জান্তা এসে এখানে তাদেরকে নিরাপত্তা দিয়ে কুলাতে পারবে না। যেকোনো পরিস্থিতিতেই রাখাইনদের সাথে, আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগ, সম্পর্ক এবং তাদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করাটা খুব জরুরি, যদি আমরা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে চাই। আমাদের যদি সেটার ব্যাপারে একটা সিরিয়াসনেস থাকে।”
চীন-ভারত কেউ কারও ‘প্রতিস্থাপক নয়’
কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো দেশই আরেক দেশ দিয়ে ‘প্রতিস্থাপনযোগ্য’ বলে মনে করেন সাবেক এই কূটনীতিক।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা শীতল হওয়ার পর বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা করছে। দেশটি বাংলাদেশে তিনটি হাসপাতাল করতে যাচ্ছে। চিকিৎসা ভিসা দেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছে।
সে প্রসঙ্গ সামনে রেখে মুন্সী ফয়েজ আহমদের কাছে প্রশ্ন ছিল চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাংলাদেশকে কতটা সুফল নিয়ে বয়ে আনতে পারে?
জবাবে এই কূটনীতিক বলেন, “চীনকে দিয়ে ভারতকে প্রতিস্থাপন করা যায় না। ভারতকে দিয়ে চীনকে প্রতিস্থাপন করা যায় না। পঁচাত্তরের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় চীন। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কটা কিন্তু ওই আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অনেক পুরনো সম্পর্ক তো সেইখানে।
“চীন কিন্তু যখন থেকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তারপর থেকে সব দিকে আমাদের ভালো বন্ধু হিসেবে সহযোগিতা করেছে। আমাদের অস্ত্রশস্ত্র থেকে সামরিক বিষয়ে অনেক সাহায্য তারা করেছে।”
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের অর্ধশতবার্ষিকীর কথা মনে করিয়ে দিয়ে চীনে বাংলাদেশের সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, “তারা অনেক সময় ঋণ দিয়ে সে ঋণ মওকুফ করে দিয়েছে। তারা আমাদের অবকাঠামো গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। আস্তে-আস্তে তারা আমাদের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার হয়ে গেল। একসময় ভারত ছিল।
“কিন্তু, ২০১৩ সাল থেকে চীন প্রধান বাণিজ্য, সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার হয়ে গেল। তারপরে বিভিন্ন হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী।
“যেখান থেকে আপনি দেখেন বাংলাদেশের জন্য চীনের সাথে বন্ধুত্ব অত্যন্ত বেনিফিশিয়াল, সেটি প্রমাণিত হয়েছে। অত্যন্ত উপকারী প্রমাণিত হয়েছে। তারা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে আসে না। কিন্তু অনেক দেশ আছে, তারা সাহায্য করে অল্প কিন্তু হস্তক্ষেপ করে অনেক বেশি।”
চীন মোড়লগিরি করতে চায় না মন্তব্য করে ফয়েজ আহমদ বলেন, “চীন বিভিন্ন দেশের সাথে যখন সহযোগিতা করে, তারা নিশ্চয় তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতেই করে। কিন্তু, যার সাথে করে, তাদেরও স্বার্থ রক্ষা করার জন্য করে। পারস্পরিক স্বার্থে করে এবং কোনো হস্তক্ষেপ করে না। এটা হল চীনের বন্ধুত্বের সবচেয়ে বিশেষ দিক।
“অনেক বন্ধু আছে যারা খবরদারি করতে চায়, যারা আমাদের উপরে মোড়লগিরি করতে চায়, যেমন আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, তারা আমাদের কাছ থেকে অনেক সুবিধা পায়, আমরাও তাদের কাছ থেকে অনেক সুবিধা পাই। কিন্তু তারা আমাদেরকে বিভিন্নভাবে, আমাদের বিভিন্ন নীতি নির্ধারণে তারা হস্তক্ষেপ করতে চেষ্টা করেছে। এটা বারবার আমরা লক্ষ্য করেছি। তো যেভাবেই বলি চীনের সাথে বন্ধুত্ব ভালো। কিন্তু তার মানে এই না যে চীনের সাথে বন্ধুত্ব দিয়ে আমরা অন্যদের সাথে বন্ধুত্বের প্রয়োজনগুলো সরিয়ে দিতে পারব।”
তিস্তা প্রকল্প ‘বলে কয়ে’ করতে হবে
তিস্তা প্রকল্পে চীনের অংশগ্রহণ নিয়ে জানতে চাইলে ফয়েজ আহমদ বলেন, “আগের সরকারও তো তিস্তা প্রকল্প চীনকে দিয়ে করাতে চেয়েছিল। যখন এটা করার উদ্যোগ নেওয়া হল, তখন ভারত তাদের উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে আমাদেরকে থামানোর চেষ্টা করল যে ‘আমরা করে দেব’। কিন্তু আসল কথা হল ভারত যদি না করে, ভারত যদি আমাদেরকে পানি না দেয় তিস্তার, আমরা কি বসে থাকব বছরের পর বছর? যুগের পর যুগ? না, আমাদের লোকজন তো কষ্টে আছে, তাদেরকে একটা ব্যবস্থা করতে হবে।”
ভারত উজানের পানি না দিলে সেদিকে তাকিয়ে থাকা যাবে না বলে মনে করেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, এই অঞ্চলে, মানে উজান থেকে পানি যদি না আসে, তাহলে আমরা কি করতে পারি সেইগুলোর ভিত্তিতে একটা প্রজেক্ট আমাদের একটা অলরেডি আছে, সেই প্রজেক্টটা চীনারা যাচাই করে দেখেছে, তারা সেটাতে আমাদের সাহায্য করতে চায়। সুতরাং আমরা তাদের বলতেই পারি। আমাদের খালি খেয়াল রাখতে হবে, এমন কিছু আমরা করি না, যাতে সরাসরি ভারতকে ক্ষতি করা হয়।”
এ নিয়ে যে ভারতের আপত্তি আছে– সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “আপত্তি জানালেই যে আমরা সবসময় শুনব। তোমরা করে দাও, তাহলে তো আমাদের চীনের কাছে যেতে হয় না। তোমরা পানি ছেড়ে দাও এবং এখানে আমরা যা করতে চাই, আমাদের সাহায্য কর। তারা তো সেটা করছে না। সুতরাং আমাদের বাধ্য হয়ে চীনের কাছে যেতে হচ্ছে। তো সেটা বলেই, বলে কয়ে যেতে হবে। আমি গোপনে কিছু করব না। বলে কয়ে করব এবং কেন করব সেটা বুঝিয়ে করব।”
ভারত বন্যার সময় উজানের পানি ছেড়ে দিলে, তার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া দরকার বলে মনে করেন ফয়েজ আহমদ।
সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, “আমাদের প্রস্তুতি থাকতে হবে যে একসময় হয়ত তারা পানি ছাড়বে। তখন আমার যেসব কাজগুলো করব, প্রকল্পের যেসব বিশেষ দিকগুলো থাকবে, তখন যেন সেটার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া যায়, সেই ব্যবস্থা রেখেই আমাদেরকে করতে হবে।”
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “এখন পানি নাই, সেজন্য আমরা একরকমের ব্যবস্থা করছি। বৃষ্টির পানি, বন্যার পানি, মাটির নিচের পানি এগুলো দিয়ে যাই হচ্ছে, সেটাকে আমরা বিভিন্নভাবে চ্যানেলাইজ করতে চেষ্টা করি এখন। কিন্তু একসময় হবে যে হয়ত ভারত পানি ছাড়বে, তখন যাতে আমরা সেটাকে আমাদের প্রকল্পের মধ্যে ধারণ করতে পারি। সেই ব্যবস্থা আগে থেকেই রাখতে হবে, সেই চিন্তাটা আমাদের থাকতে হবে।
“চীনকে দিয়ে করাতে আমি কোনো দোষ দেখি না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা খোলাখুলিভাবে বা জেনে বুঝে ভারতের কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করি।”