Published : 19 Jun 2025, 05:43 PM
জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানের ছায়ায় ইসলামী উগ্রবাদের হুমকিকে ব্যবহার করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার গুমকে ‘একটি সুশৃঙ্খল ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ’ দিয়েছিল বলে মনে করছে গুম সংক্রান্ত অনুসন্ধান কমিশন।
কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম বলেছেন, “তাদের উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন এবং শাসনকে দীর্ঘায়িত করা। এই গুমের শিকার হয়েছেন শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি পেশাজীবি তথা সাধারণ জনগণ।”
বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এ কথা বলেন মইনুল ইসলাম। তবে লিখিত বক্তব্যের শেষাংশে স্বীকার করে নেওয়া হয় যে সন্ত্রাসবাদের হুমকি মিথ্যে নয়।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, কমিশনে জমা পড়া ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ বিশ্লেষণ করে ২৫৩ জন ব্যক্তিকে গুম করার মুহূর্তে, গুমকালীন সময়ে এবং গুম থেকে ফেরত আসার সময়কার অকাট্য প্রমাণ পেয়েছে কমিশন। কমিশনে জমা পড়া অভিযোগগুলো বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, গুম হওয়া ব্যক্তিদের চার ধরনের পরিণতি হয়েছে।
১. তাকে হত্যা করা হয়।
২. তাকে বিচারের আগেই মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করে সাধারণত ‘জঙ্গি’ তকমা দিয়ে বাংলাদেশেই বিচারাধীন বা নতুন ফৌজদারী মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
৩. তাকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দিয়ে ভারতের আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করা হয়।
৪. ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে, অল্প সংখ্যক ক্ষেত্রে মামলা না দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।
লিখিত বক্তব্যে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, প্রায় ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ বিশ্লেষণ করে তার মধ্যে থেকে ২৫৩ জন গুমের শিকার ব্যক্তির তথ্য অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাদের সবার ক্ষেত্রে মোটামুটি তিনটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।
১. নিখোঁজ হওয়ার সময়ে তাদের নিকটাত্মীয়ের দায়ের করা সাধারণ ডায়েরি, ফৌজদারি মামলা, গুম থাকা অবস্থায় সংবাদ প্রতিবেদন এর মত সমসাময়িক প্রমাণ রয়েছে। শুধুমাত্র এই ২৫৩ জন সমসাময়িক প্রমাণ দাখিল করতে সক্ষম হয়েছেন, বাকিরা হননি। কারণ তখন এসব ক্ষেত্রে জিডি করতে গেলে জিডি নেওয়া হত না।
২. গুম অবস্থা থেকে ফেরতের সময় তাদের সন্ত্রাসবিরোধী মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কোনো একটি সংস্থা স্বীকার করে নেয় যে ওই ব্যক্তি তাদের হেফাজতে আছে।
৩. এই ভিক্টিমরা জীবিত আছেন, তাই তারা কমিশনকে জানাতে পেরেছেন যে তারা রাষ্ট্রীয় হেফাজতে গোপন আটককেন্দ্রে বন্দি ছিলেন, যেখানে তাদের অনেকের একে অপরের সঙ্গে দেখাও হয়েছে এবং একই ধরনের নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন। অর্থাৎ এই ২৫৩ ব্যক্তিকে গুম করার মুহূর্তে, গুমকালীন সময়ে এবং গুম থেকে ফেরত আসার মুহূর্তে তিনটি পর্যায়ই অকাট্য প্রমাণাদি পাওয়া যাচ্ছে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, “আমাদের কাছে ২৫৩ জন মানুষের একটি তথ্যভিত্তিক দলিল রয়েছে, যারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং এক দশকের বেশি সময় ধরে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেও অত্যন্ত সাদৃশ্যপূর্ণ অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। এমন ঘটনা কাকতালীয় হওয়া সম্ভব নয়। এমনকি হাতে গোনা কিছু অবাধ্য কর্মকর্তার বিচ্ছিন্ন অপরাধও হতে পারে না। এই অভিজ্ঞতার সাদৃশ্যতা একটি সাংগঠনিক ও পদ্ধতিগত কাঠামোর অস্তিত্ব নির্দেশ করে।”
গুমকে বিগত সরকার ‘প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র হিসেবে’ ব্যবহার করেছে মন্তব্য করে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, “এতে স্পষ্ট হয় যে বিগত সরকারের শাসনামলে গুম একটি সুশৃঙ্খল ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপে ‘জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানে’র ছায়াতলে ইসলামী উগ্রবাদের হুমকিকে ব্যবহার করে পরিচালিত হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এ প্রক্রিয়ায় তারা ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে অস্ত্র বানিয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবাধীন করেছে এবং নির্যাতন ও গোপন আটকের সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালু করেছে। এমনকি সাধারণ নাগরিকদের বেআইনি পন্থায় বারবার ভারতীয় বাহিনীর হাতেও তুলে দিয়েছে।”
প্রতিবেদনে নাম আসা ২৫৩ জনের ঘটনাগুলো মোমুনাটি এক দশকেরও বেশি সময়জুড়ে বিস্তৃত জানিয়ে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, তাদের বয়স, পেশা ও নিখোঁজ থাকার সময়কাল-সবই ভিন্ন হলেও তাদের অভিজ্ঞতাগুলো ‘আশ্চর্যজনক প্যাটার্নে’ মিলে যায়।
“অধিকাংশই সে সময়কার বিরোধী দলগুলোর বা ভিন্ন মতের সমর্থক ছিলেন এবং তাদের অনেককেই রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। এমনকি অল্প কিছু ক্ষেত্রে তৎকালীন শাসক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরও দলীয় কোন্দল বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণেও ওম করা হয়েছে। সকল ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা প্রায় একই ধরনের প্রক্রিয়ার শিকার।”
তাদের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত নির্যাতন, সন্ত্রাসী হিসেবে প্রচার, একই ধরনের আইন অনুযায়ী অভিযোগ দায়ের এবং একই ধরনের ভাষায় ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় জানিয়ে কমিশন প্রধান বলেন, বিভিন্ন পটভূমি থেকে আসা ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতার এই সামঞ্জস্য ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে’ স্পষ্ট করে।
“ব্যাপারটা মোটেও এমন নয় যে একটি ‘জঙ্গিবাদ দমন অভিযানে’ দুই-একজন অসাবধানী কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক কিছু মানবাধিকার লঙ্ঘন এর ঘটনা ঘটে গেছে। বরং এটি ছিল একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দমনযন্ত্র, যা জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। এছাড়া আমাদের প্রতিবেদনে সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের তথ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করে আমরা দেখিয়েছি যে মামলার সংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা নয় বরং রাজনৈতিক ও 'পার্ফরমেন্স ইনডিকেটর' ভিত্তিক বিবেচনা কাজ করেছে।”
কমিশন সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী প্রক্রিয়া পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা দুটি সুপারিশ দিয়েছি। প্রথমত, সন্ত্রাসবিরোধী মামলার অপব্যবহারের বিষয়ে অবগত হয়ে সেগুলো ন্যায় বিচারের মানদণ্ড বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয়ত, আইনশৃংখলাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের সাথে আলোচনার প্রেক্ষিতে মানুষের মনস্তত্ব পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমান কাউন্টার টেরোরিজম মেথড ত্রুটিপূর্ণ। বিধায় মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার মত উপযুক্ত কাউন্টার টেরোরিজম মেথড বের করা।”
তবে সন্ত্রাসবাদের হুমকি যে মিথ্যে নয়, সে কথা স্বীকার করে নিয়ে লিখিত বক্তব্যের শেষাংশে বলা হয়, “সন্ত্রাসবাদ সারা বিশ্বে একটি বাস্তব হুমকি, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ২০১৬ সালের হলি আর্টিজানে হামলার মত ঘটনা এর প্রমাণ। তবে, এই হুমকি মোকাবেলায় রাষ্ট্রের সততা, মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতি এবং আইনসম্মত প্রক্রিয়ায় অটল থাকা জরুরি। সরকার সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণাকে যখন রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, তখন তা আইনের শাসন, প্রতিষ্ঠান ও জনগণের বিশ্বাসকে ধ্বংস করে দেয়।”
পুরনো খবর
সেনাবাহিনী গুমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জড়িত নয়, তবে তারা জানত: গুম সংক্রান্ত কমিশন
গুমে জড়িতরা এখনো ক্ষমতার কেন্দ্রে, ভিকটিমদের দিচ্ছে হুমকি: গুম সংক্রান্ত কমিশন
গুম: 'জোর করে' জবানবন্দি, 'জড়িত' ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেটরাও
‘গুমের' শিকারদের নির্যাতনের যত নিষ্ঠুর কায়দা
গুমে প্রধান ভূমিকা ছিল র্যাবের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের: প্রেস সচিব
সমাজের 'ভদ্রলোকেরা' গুমে জড়িত: প্রধান উপদেষ্টা
'গুমের শিকার' ৩৩০ জনের ফেরার আশা ক্ষীণ: কমিশন প্রধান
'আয়নাঘরে' গেলেন ইউনূস, দেখলেন নির্যাতনের যন্ত্র