Published : 21 Jun 2024, 09:14 AM
মাটির তৈজসপত্র তৈরির পারিবারিক পেশা ছেড়ে মানুষ যখন অন্য কিছু করে জীবন যাপন করছে, সেই সময়ে নরসিংদীর দুই নারী বাপ দাদার পেশা ধরে রেখেছেন। তারা একই বাড়ির বধূ, সম্পর্কে জা।
জেলার বেলাব উপজেলার চন্দনপুর গ্রামের কুমারবাড়িতে গেলে দেখা মেলে ছায়া রাণী পাল ও অষ্টমী রাণী পালের; দিনভর তারা ব্যস্ত থাকে মাটি বা হাড়ি পাতিল অথবা খেলনা তৈরির কাজে।
মাটির জিনিস তৈরির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কুমার বা কুম্ভকার বলা হয়। এই কুমারদের পূর্বপুরুষেরা প্রায় ২০০ বছর আগে গ্রামটিতে এসে বসতি গড়ে তুলেছিল। তাদের বাসস্থানটি কুমার বাড়ি হিসেবে পরিচিতি পায়।
বিয়ে সূত্রে চার দশক আগে পাশের দুই গ্রাম থেকে কুমার বাড়িতে অষ্টমী রাণী পাল ও ছায়া রাণী পাল। বিয়ের আগেও তারা মাটির হাঁড়িপাতিল তৈরি করতেন।
কুমার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, ছায়া রাণী চাকে মাটি ঘুরিয়ে চিতই পিঠা বানানোর তাওয়া (পাতিল) তৈরি করছেন, অষ্টমী রাণী তৈরি হওয়া সেই পাত্রগুলো রোদে শুকাচ্ছেন।
অষ্টমী পাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছোটবেলাত্তেই করতাছি; কামডা আর থাকতাছে না, আমরার কষ্ট অয়। এর লাইগ্যা পরিশ্রম হলেও কইরা যাইতাছি।”
বছর দশেক আগে উঠান আর ঘর মাটির হাতি, ঘোড়া আর পাতিলে ভর্তি থাকত জানিয়ে ছায়া রাণী পাল বলেন, “বাড়ির সবাই সারাদিন এইডি বানাইত, কুমার বাড়ি ভরা থাকত মানুষ আর মাডির জিনিসে। আমরারও বয়স হয়া গেছে, পরিশ্রম অনেক, কতদিন আর করতারমু জানি না।”
নতুন প্রজন্ম ছাড়ছে পেশা
বর্তমানে কুমার বাড়িতে মাটির জিনিস তৈরি করার মত ৬০ জন মানুষ রয়েছেন। ৭ থেকে ৮ বছর আগে বাড়ির প্রবীণ প্রজন্ম সরে এসেছেন এ পেশা থেকে। আর নবীন প্রজন্ম ছড়িয়ে পড়েছে ভিন্ন পেশায়।
৭৫ বছর বয়সী ওমর চন্দ্র পাল এখন আর কাজ করতে পারেন না। তিনি বলেন, “ছোট সময়তে এই কামই করছি। আর কিছু পারতাম না, এইডাই শিহাইছে আমরারে। আমার বাবায় বানাইছে, তারতে দেইখ্যা আমি শিখছি। বাবা শিখছে দাদারটা দেইখ্যা, এমনেই হইছে আরকি।”
কেন আগ্রহ কমছে- এই প্রশ্নে কুমার বাড়ির বাসিন্দারা বলছেন, বর্তমানে মাটির তৈরি জিনিস তেমন বিক্রি না হওয়ায় এ পেশায় উপার্জন কম, কিন্তু পরিশ্রম ব্যাপক। তাই নতুন প্রজন্ম আর এই কাজে আগ্রহী হচ্ছে না। তাদের কেউ কলকারখানার শ্রমিক, কেউ স্বর্ণকারের কাজ করছেন, কেউ আবার দর্জির কাজ করছেন।
বাড়িতে আসা নতুন প্রজন্মের বউয়েরাও এ কাজে আসতে আগ্রহী নন বলে জানান ছায়া রাণী পাল।
তিনি বলেন, “পারলেও করে না, ঝামেলা মনে করে। আর সবাইই এখন ছেলে মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত, পড়ালেখা করায়- এইগুলা নিয়াই থাকত চায় তারা।”
ওমর চন্দ্র পাল বলছেন, প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের চাহিদা বাড়ার ফলে এখন আর আগের মত মাটির জিনিস বিক্রি হয় না।
“আগে পাইহাররা (পাইকার) আইয়া নিত, এহন আর আইয়ে না; বেচাকেনা কম। এরচে অন্য ব্যবসা, অন্য কাম ভালা (ভালো)। অন্য কাজে খাটনি (পরিশ্রম) থাকলেও পয়সা আছে, এইহানো পয়সা কম খাটনি বেশি- এর লাইগ্যা ছাইড়া দিছে অনেকে।”
বাড়ির দুজনের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “এরা বন্ধ কইরা দিলে আমরার বাড়িতও আর এই কাম থাকত না।”
ওমর চন্দ্র পালের একমাত্র ছেলে দর্জির কাজ করছেন।
তিনি বলেন, “আমার ঘর আমিই শেষ যে মাডির কাম করতাম। পরে আর কেউ পারে না। তারা শিখতও চায় না। অহন আবার সবাই পড়ালেহা করে। ইশকুলে যায়, কলেজে অনার্স করে।”
অষ্টমী রাণী পাল বলছেন, “আগে মাটির খেলনা কিনত, পোলাপানের হাত থেকে পইরা ভাইঙ্গা যায়গা। প্লাস্টিকেরটা নিলে ফালাইয়া-টালাইয়া খেললেও ভাঙে না। এর লাইগ্যা ওইটাই কিনে, মাটিরটা কিনে না।”
অষ্টমী রাণী পালের দুই ছেলে আর চার মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে, এক ছেলে স্বর্ণকার আর আরেক ছেলে দেশের বাইরে থাকেন।
তিনি বলেন, “ঠিকঠাক দাম যদি পাওয়া যাইত, তাইলে যত পরিশ্রমই হোক সবাই করত। পরিশ্রম বেশি, এর লাইগ্যা পোলাপানও এই কাম পছন্দ করে না।”
ছায়া রাণী পালের তিন ছেলেও এই পেশাকে বেছে নেয়নি। তারা স্বর্ণের অলংকার তৈরি আর দর্জির কাজ করেন।
একটা সময় মাটির হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করাটা বেঁচে থাকার পেশা হলেও এখন আর নয় বলে মনে করছেন কুমার বাড়ির স্বর্ণকার প্রদীপ চন্দ্র পাল।
তিনি বলেন, “আমার আব্বা কোনো রকমে এইগুলা বেইচ্যা টিইক্যা রইছে। আমারারে পড়ালেহা করাইত পারছে না, স্বর্ণের কাম কইরা আমি আমার ছেলে মেয়েরে পড়ালেহা করাইতে পারছি। এর লাইগ্যাই আমরা এই কাম ছাইড়া স্বর্ণের কাম ধরছি। আয় থাকলে বাপ-দাদার পেশায় থাকা যাইত।”
পরিশ্রম অনেক, কিন্তু আয় কত?
অষ্টমী রাণী ও ছায়া রাণীকে মাটির হাঁড়ি, পাতিল, ঢাকনা, হাতি, ঘোড়া আর খেলনাসহ গৃহস্থালির বিভিন্ন জিনিস তৈরি করতে দেখা গেল।
এগুলো তৈরি করার জন্য প্রথমে তাদের মাটি তুলে আনতে হয়, এরপর কোদাল দিয়ে সেটাকে ছোট ছোট করে কোপানো হয়। পরে সেটাকে পানি দিয়ে চেপে রেখে আবার কোপানো হয়। এরপর পা দিয়ে মাড়িয়ে মাটিটাকে পাত্র তৈরির উপযুক্ত করা হয়। পরে ওই মাটি দিয়ে হাঁড়ি, পাতিল তৈরি করে রোদে শুকানো হয়।
অষ্টমী বলেন, শুকানোর পর রঙ দেওয়া হয়। তারপর বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে স্তূপ করে দুইদিন ধরে পোড়াতে হয়। তখন অনেক লাকড়ি লাগে।
তিনি বলেন, “বানাইতেই ২০ হাজার টাকা খরচ। পরিশ্রম তো আছেই। বেচার হিসাব নাই। একটা দুইটা কইরা বেচলে হিসাব রাহন যায় না। এক লগে বেচলে লাভ-লোকসান বোঝা যাইত৷”
“এইবায় চলাটা খুব কষ্টের৷ কোনোভাবে চলি”, নিজের পেশা নিয়ে খুশি নন অষ্টমী।