Published : 28 Jul 2024, 11:49 PM
কোটা সংস্কার আন্দোলন ও কারফিউয়ের কারণে কাজে যেতে পারেননি নির্মাণ শ্রমিক আবু সালেহ; এক সপ্তাহেরও বেশি সময় বেকার বসে থাকায় ধারকর্জ করেই চলতে হয়েছে তাকে।
পরিস্থিতি খানিকটা স্বাভাবিক হলে শুক্রবার কাজে যোগ দেন তিনি। তবে ধারের টাকা আর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসারের খরচ চালাতেই এখন হিমশিম অবস্থা তার।
সালেহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন যা আয় করতেছি, তা দিয়ে চাল কিনলে তরকারি কিনতে পারছি না। তরকারি কিনলে চাল কিনতে পারছি না। বউ-বাচ্চা আছে, এমনে চলা যায়?
“দেশে যাই হয়, সব গরিবের ওপর দিয়েই যায়।”
ঢাকার মিরপুর ১২ নম্বরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন এ শ্রমিক। সাড়ে ৫ হাজার টাকা বাসা ভাড়া আর নিজের খরচই যখন মিটছে না, এমন অবস্থায় গ্রামে মা-বাবাকে টাকা পাঠানো নিয়েও দুশ্চিন্তা তার চোখে-মুখে।
তার ভাষ্য, “দিনে ৫০০ টাকা পাই মাত্র। এ কয়দিন যে ঋণ হইছে, সেটা দেব না কি নিজে চলব, বুঝতেছি না। এর মধ্যে বাসা ভাড়া সাড়ে ৫ হাজার টাকা, সামনের মাসের ভাড়াও মনে হয় দিতে পারব না।
“নিজেরই খাওয়ার অবস্থা নাই, এ কারণে বাড়িতে বাপ-মারেও টাকা দিতে পারছি না।”
সালেহর মত অবস্থা মিরপুরের সাগুফতা এলাকার জাহানুর বেগমেরও। সাভারের বিরুলিয়া থেকে শাক এনে মিরপুরের কালশী এলাকার অলিতে-গলিতে বিক্রি করেন তিনি।
জাহানুর বলেন, ঢাকায় আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতা আর কারফিউয়ের কারণে এক সপ্তাহ ধরে বেচাকেনা বন্ধ ছিল তার। ফলে তিন নাতি আর মেয়েকে নিয়ে এখন খাবার খরচ জোগাতেই পেরে উঠছেন না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “খেয়ে, না খেয়ে আছি। আমাদের দেখার কেউ নাই। টেনশনে এমন অবস্থা হিসাবও মনে রাখতে পারি না।
“এমনিতেই শাক বেচে যা আয় করি, তাতে বাসা ভাড়া দিয়ে মাত্র দুই-তিনশ ট্যাকা থাকে। এখন তো সেটাও নাই। কত আর মানুষের থেকে চাওয়া যায়? ছোট নাতিটার বয়স দুই বছর, এর জন্য সুজি কিনতে হয়। এই কয়দিন কিনতে পারি নাই।”
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে দেশজুড়ে কারফিউ জারি হলে কাজকর্ম বন্ধ হয়ে দুর্ভোগে পড়েন জাহানুর ও সালেহের মত অনেকেই। আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যে দেনা হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতেই অপেক্ষা আর কষ্ট করতে হবে আরও।
হাই কোর্টের রায়ের পর জুলাইয়ের শুরু থেকে কোটা বাতিলের আন্দোলন শুরু হলেও পরে তা কোটা সংস্কারের এক দফা দাবিতে রূপ নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে আরও অনেক স্থানে। পরে শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন কর্মসূচিকে ঘিরে একপর্যায়ে তা সহিংসতায় গড়ায়।
আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাতের মধ্যে এক সপ্তাহে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর আসে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে দেশজুড়ে কারফিউ শুরু হয়। এখন দিনের বেশিরভাগ সময়টাতেই কারফিউ শিথিল থাকছে। বিকাল থেকে চলছে সান্ধ্য আইন।
‘পরিবারের খরচা আছে, ছেলেদের স্কুল আছে, খাই কইত্তে’
আন্দোলন ঘিরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি আর কারফিউয়ের কারণে রুটি-রুজিতে টান পড়েছে রাজধানীর প্রজাপতি বাসের হেল্পার নজরুল মিয়ার। দুই ছেলে, স্ত্রী, ভাই-বোন ও মাসহ সাতজনের সংসারের খরচ চলে তার আয়ে। থাকেন মোহাম্মদপুরে ভাড়া বাসায়।
নজরুল বলেন, আন্দোলন ও কারফিউয়ের কারণে সাত-আটদিন ঘরে বসেই কাটাতে হয়েছে। পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক হলেও আয় হচ্ছে কম।
“চলতে খুব কষ্ট হইতাছে। এখন রোডে বের হইছি, লোকজন তো নাই। টাকা খুব কম পাই। যা পাই তা দিয়ে চলেই না। একটা পরিবারের তো দৈনিক ৫০০ টেকা খরচা আছে, ছেলেদের স্কুল আছে, খাই কইত্তে?”
আন্দোলনের আগে দিনে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা আয় করতেন নজরুল। এখন দিনে ৫০০ টাকা পাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
তার ভাষ্য, “কোনো দিন তাও পাই না; আন্দোলন শুরুর পর থেকেই এ অবস্থা। তার মধ্যে আমাদের একদিন পরপর গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার নিয়ম। জিনিসপত্রের দাম এমনি বেশি, এখন আরও বাড়ছে। একার আয়ে এত বড় পরিবার চালানোটা মুশকিল।”
মহাখালীর আমতলীতে চা-পান বিক্রি করেন ফাতেমা আক্তার। তিনি বলেন, ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন বেচা-বিক্রি চালিয়ে গেলেও সংঘর্ষ শুরুর পর থেকেই বিক্রি কমে আসে, যা এখনও আগের অবস্থায় ফেরেনি।
তিনি বলেন, “একদিন পুরা দোকানদারি করতেই পারি না। মানুষের কাজকর্ম নাই, কর্ম করতে পারলে না খাইতো। না বেচতে পারলে কষ্ট তো হইবই, জিনিসপত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়িও করতে হইছে।”
স্বামী-সন্তান নিয়ে ফাতেমা থাকেন মহাখালীর করাইলে। বাসা ভাড়া দিতে হয় ৩ হাজার ২০০ টাকা। দুর্ঘটনায় পায়ে ব্যথা পাওয়ার পর দুই মাস ধরে রিকশা চালাতে পারছেন না তার স্বামী।
ফাতেমার ভাষ্য, “দুই মাসের ঘর ভাড়াও বাকি রয়ে গেছে। এ কয়দিন যে বিক্রি করতে পারলাম না, সামনে কেমনে চলব বুঝতেছি না।”
গত ১২ জুলাই জরুরি কাজে গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙায় যান মহাখালীর ঝালমুড়ি বিক্রেতা আকমন আলী। আন্দোলন আর সহিংসতার কারণে সেখানে আটকা পড়েন। ১৩ দিন পর ফিরে বৃহস্পতিবার দোকান খোলেন তিনি।
দুই ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে আকমনের পরিবার। বাকি সদস্যরা গ্রামে থাকলেও তিনি ২ হাজার টাকা ভাড়ায় থাকেন মহাখালীর সাততলা বস্তিতে।
তিনি বলেন, “ঋণ করে চলা লাগছে এই কয়দিন। আগের ঋণ তো আছেই, নতুন করে আরও হাজার পাঁচেক ঋণ হইছে। লোন নিয়ে কিস্তির মাধ্যমে শোধ করব, নইলে তো সম্ভব না।
“কোনো পাশেই মানুষ নাই, কোন পাশে যে যাব, বুঝতেছি না। বাড়িতেও টাকা পাঠাতে পারতেছি না।”
আন্দোলনের কয়েক দিনে ধারের কারণে তা শোধ করা নিয়েই বেশি দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি।
তার ভাষ্য, “এই কয়দিনে এক মাসের পিছে পড়ে গেলাম, একমাসেও টেনে উঠতে পারব কি না, জানি না।
“দোকান থেকে বাকি নিয়ে খাইছি এতদিন, আস্তে আস্তে সেটা দেওয়া লাগতেছে।”
ঢাকার মিরপুরের ১২ নম্বরে ফল বিক্রি করেন বাবুল মিয়া। নিজের খরচ সামলিয়ে বাকি টাকা পাঠান গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে।
তিনি বলেন, “আন্দোলনের সময়ে কয়েকদিন দোকান খুলতে পারিনি; এরপর কারফিউর কারণেও কয়েকদিন বন্ধ রাখছি। কারফিউ শিথিলের সময় খুললাম, কিন্তু মানুষ আর আগের মত আসে না।
“আল্লাহ যেভাবে চালায়, এভাবেই চলে যাচ্ছি।”