Published : 25 May 2025, 11:34 PM
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে সমর্থন জানিয়ে তাকে সহযোগিতা করার কথা বলেছেন ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল ও সংগঠনের নেতারা।
হঠাৎ করে তৈরি হওয়া অস্থিরতার মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় দফায় রোববার তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সন্ধ্যায় এ বৈঠকের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এ নেতারা সরকারপ্রধানের প্রতি তাদের সমর্থন জানানোর বিষয়টি তুলে ধরেন।
সেখানে ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, “আমরা তাকে (মুহাম্মদ ইউনূস) বলেছি, আপনি যদি পরাজিত হন, তাহলে আমরাও পরাজিত হব। তবে মাঝপথে আপনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন—এটা কোনোভাবেই হতে পারে না, এটা আপনি মাথায় আনবেন না।’’
তিনি বলেন, সংস্কার, নির্বাচন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। প্রধান উপদেষ্টাকে তারা বলেছেন, “আমরা দেশ ও জনগণের প্রয়োজনে আপনাকে নিয়ে এসেছিলাম একটি সুন্দর দেশ গড়ার জন্য। আপনার ওপর যে বিভিন্ন রকম মানসিক নির্যাতন চলছে, তা আমরা অনুভব করছি। আপনাকে সহজভাবে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না, সেটাও আমরা বুঝতে পারছি।”
প্রয়োজনীয় সংস্কার না হলে, সামনে যে জাতীয় নির্বাচন হবে সেখানে কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাব পড়বে, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে চরমোনাই পীর রেজাউল করিম বলেন, “ফলে আগের যে কলঙ্কিত নির্বাচনের ইতিহাস, সেটা ফিরে আসবে। এটা পুনরায় হোক, তা আমরা চাই না। এই কারণেই আমরা বলছি সংস্কার হোক। আমরা বলেছি, যদি স্থানীয় নির্বাচন আগে হয়, তাহলে সেখানে যেন কালো টাকা এবং পেশিশক্তির প্রভাব না থাকে— সে বিষয়ে আপনারা দৃষ্টি রাখবেন।”
তিনি বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, ২০২৬ সালের জুনের ৩০ তারিখের পরে তাদের কেউ থাকবেন না। তার সঙ্গে কথা বলে আমাদের ভেতরে যে একটা ভয় ছিল, তা কেটে গেছে। পাশাপাশি আমরা বলেছি, যেসব বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়, সে বিষয়ে আপনারা সতর্ক হয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।”
বিকালে সরকারপ্রধানের বাসভবন যমুনায় শুরু হওয়া দ্বিতীয় দফার বৈঠকে সন্ধ্যা ৭টার দিকে বিভিন্ন দলের নয় নেতার সঙ্গে বসেন সরকারপ্রধান।
হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব সাজিদুর রহমান বলেন, “আমাদের পক্ষ থেকে পরামর্শ ছিল—আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে ফ্যাসিবাদ আমাদের কিছুই করতে পারবে না। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, বিপদ আসলে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হয়, ধৈর্য ধরতে হয়।”
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় হেফাজতের বিরুদ্ধে করা মামলা গত নয় মাসেও মামলা প্রত্যাহার না হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, আগামী ছয় মাসের মধ্যে যেন এই মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয়। পাশাপাশি আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, কোরআন-সুন্নাহর বাইরে কোনো প্রস্তাবনা বাংলাদেশে পাস হবে না।”
নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব বলেছেন, তারা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন সংখ্যা গরিষ্ঠতার মতের বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মামুনুল হক বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন—আমরা সকলে যদি তাকে সহযোগিতা করি, তাহলে তিনি দেশ ও জাতিকে একটি গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে তার দায়িত্ব শেষ করবেন। পাশাপাশি দেশ ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে তিনি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে চান।
“তিনি আমাদের জোর দিয়েই বলেছেন, ২০২৬ সালের জুনের ৩০ তারিখের পর এক ঘণ্টাও তিনি ক্ষমতায় থাকবেন না—এর আগেই তিনি নির্বাচন শেষ করবেন।”
তিনি বলেন, “আমাদের পক্ষ থেকে আমরা তিনটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করেছি। প্রথমত, আমরা বলেছি, সংস্কারের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আমরা এখনো কাঙ্ক্ষিত কোনো লক্ষণ দেখতে পাইনি। এরকম অনিশ্চিত লক্ষ্যের দিকে হাঁটা ঠিক নয়। তাই তাকে আমরা বলেছি, সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করুন—সংস্কারগুলো কী করছেন।
“দ্বিতীয়ত, আমরা বলেছি—শাপলা চত্বর থেকে শুরু করে জুলাই বিপ্লব পর্যন্ত যত হত্যাকাণ্ড হয়েছে, সেখানে হাসিনা ও তার প্রধান সহযোগীদের বিচার কার্যক্রমের দৃশ্যমান অগ্রগতি হোক। তিনিও আমাদের এ বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন। অতি দ্রুত আমরা এ বিষয়ে সুসংবাদ পাব বলে আশা করছি।
“করিডরের বিষয়ে তিনি বলেছেন, দেশবিরোধী কোনো কার্যক্রম তার দ্বারা সংঘটিত হবে না—তিনি এ বিষয়ে তার ওপর বিশ্বাস রাখতে বলেছেন। যদি এমন কিছু হয়ে থাকে, তাহলে সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই তা করা হবে।”
রাজনীতিতে যে অনৈক্য সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করতে প্রধান উপদেষ্টা যেন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঘন ঘন আলোচনা করেন সেই পরামর্শ দেওয়ার কথা তুলে ধরে মামুনুল হক বলেন, “এ বিষয়ে তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।
“নির্বাচনের বিষয়ে আমরা জোর দিয়ে বলেছি, সুনির্দিষ্ট একটি সময় যেন নির্ধারণ করা হয়, যাতে জনগণের মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি তৈরি না হয়। সেই প্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন, জুনের মধ্যেই আমরা নির্বাচন ব্যবস্থা করব।”
গণধিকার পরিষদের নুরুল হক নূর বলেন, “আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি—যেসব উপদেষ্টাকে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, বিশেষ করে ছাত্র আন্দোলনের মধ্য থেকে যারা সরকারে রয়েছেন, তারা যদি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাহলে তাদের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে সরিয়ে দিলে সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষা পাবে।”
একটি মহল সামরিক বাহিনীসহ প্রশাসনকে সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে দাবি করে তিনি বলেন, “আমরা উপদেষ্টাকে বলেছি, আপনি সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনকে আস্থায় নিয়ে কাজ করবেন।”
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা কিছুটা ‘হতাশা’ ব্যক্ত করেছেন তুলে ধরে নুর বলেন, “তিনি বলেছেন, আগামীতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক ঘন ঘন হবে।”
করিডরের বিষয়ে সরকারকে কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার আহ্বান জানানো কথা বলেছেন ডাকসুর সাবেক এই ভিপি।
নির্বাচনের রোডম্যাপ বিষয়ে সরকার যা বলেছে—ডিসেম্বর থেকে জুন, তা অস্পষ্ট মন্তব্য করেন নুর বলেন, এই সময়ের মধ্যে রোজা আসবে, ঈদ আসবে, ইজতেমা আসবে।
“তাই আমরা বলেছি—আপনি একটি সুনির্দিষ্ট মাসের কথা বলেন, যে মাসে নির্বাচন হবে। আমরা রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে সকল বিষয়ে সহযোগিতা করব। যত দ্রুত নির্বাচন দেওয়া সম্ভব, তত দ্রুত এই সংকট কেটে যাবে। এখন নতুন কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই।”
সন্ধ্যার বৈঠকে তারা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ইসলামি বক্তা সাদিকুর রহমান, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মুসা বিন ইযহার এবং ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব সাখাওয়াত হোসাইন রাজী।
ছাত্রজনতার প্রবল আন্দোলনে গত বছর ৫ অগাস্ট সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার তিন দিন পর ৮ অগাস্ট নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
সম্প্রতি বিএনপি ও এনসিপি পাল্টাপাল্টি করে কয়েকজন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেন। বুধবার সেনানিবাসে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার বিষয়ে কথা বলেছেন বলে খবর প্রকাশ পেয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার ‘পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশের’ গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লে রাজনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হয়।
এ অবস্থায় শনিবার বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও শিক্ষার্থীদের নেতাদের নিয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির সঙ্গে তিন দফায় আলাদাভাবে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। তারই ধারাবাহিকতায় রোববার দুই দফায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করলেন তিনি।