Published : 23 Jan 2024, 08:13 AM
হাতে সময় নেই দশ দিনও; বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে চলছে জোর প্রস্তুতি। বাঁশের খুঁটির ওপর টিনের ছাউনি দিয়ে চলছে সারি সারি স্টল বানানোর কাজ। খুঁটিনাটি অঙ্গসজ্জার কাজও শুরু হয়ে গেছে কোনো কোনো স্টলে। যথারীতি ভাষার মাসের প্রথম দিন পর্দা উঠবে অমর একুশে বইমেলার।
২০২৪ সাল অধিবর্ষ, তাই ফেব্রুয়ারিজোড়া এই বইমেলা এবার হবে ২৯ দিনের। প্রতিবারের মত এবারও ১ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টায় মেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দেশের সবচেয়ে বড় এই বই উৎসব পরিণত হয় লেখক পাঠক মিলনমেলায়। মূল মঞ্চে থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মাসব্যাপী সেমিনার। পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের জন্য থাকে চিত্রাঙ্কন, সংগীত ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন।
তালিকাভুক্ত ৬০১টি প্রকাশনা সংস্থা ছাড়াও প্রায় ৬০টি নতুন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে স্টল বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করেছে। মঙ্গলবার ডিজিটাল লটারির মাধ্যমে পুরানো এবং নতুন তালিকাভুক্ত প্রকাশনার জন্য স্টল বরাদ্দ করা হবে। এবার ২০টির বেশি নতুন প্রকাশনা সংস্থা মেলায় স্টল পেতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির কর্মকর্তারা।
গত বছরের মত এবারও মেলার মূল মঞ্চ হচ্ছে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে; বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ও ‘লেখক বলছি’ মঞ্চ তৈরি করা হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে। রমনা কালী মন্দিরের পাশে থাকছে ‘শিশু চত্বর’।
বইমেলার স্টল বিন্যাস গতবারের মতই থাকছে। ইতোমধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৬০ শতাংশের মত প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে নজরুল মঞ্চের পাশেই চলছে মেলার মূল মঞ্চ তৈরির কাজ। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টল থাকছে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকবে সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা ও লিটলম্যাগ চত্বর। সে অনুযায়ী স্টলের অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে।
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি থাকছে না
গত কয়েক বছর মেলার স্টল বিন্যাস, প্রবেশদ্বার নির্মাণসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কোনো ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে। এবার তা হচ্ছে না। মেলা আয়োজনের পাশাপাশি সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলা একাডেমি নিজেদের হাতেই রেখেছে।
বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "সূচনালগ্ন থেকে বাংলা একাডেমিই বইমেলা আয়োজনের পাশাপাশি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সামলে আসছিল। শুধু গত কয়েক বছর মেলার ব্যবস্থাপনায় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে যুক্ত করা হয়। তাদের কাজ নিয়ে কিছু সমালোচনা হয়েছে। সেজন্য এবার কোনো কোম্পানিকে যুক্ত করা হয়নি।"
তিনি জানান, গতবছর মেলা শেষ হওয়ার পরপরই এবারের মেলার প্রস্তুতি শুরু হয় এবং তিন ধাপে কমিটি গঠন করা হয়। প্রস্তুতি পর্বের জন্য কমিটি, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য কমিটি এবং মাসব্যাপী মেলা পরিচালনার জন্য আলাদা কমিটি কাজ করছে।
বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে, ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন মেলা শুরু হওয়ার পরও স্টল নির্মাণের কাজ চলতে থাকে। মেলা শুরুর আগেই যেন স্টল নির্মাণসহ ব্যবস্থাপনার সব কাজ সম্পন্ন করা হয়, সেটি প্রত্যাশা জানালেন লেখক, প্রকাশকরা।
সময় প্রকাশনের কর্ণধার ফরিদ আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘গেল কয়েক বছর আমরা দেখেছি, মেলা শুরুর পরও কিছু খাবারের দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়। হুট করে কোনো স্টলের সামনে বা হাঁটার পথে একটা কফির দোকান বসিয়ে দেওয়া হয়। সেটা লোকজনের চলাচলে বিড়ম্বনা বাড়ায়। এবার আশা করব গোছানো বইমেলা হবে।”
প্রস্তুতি চলছে প্রকাশকদেরও
সময় প্রকাশন এবারও মেলায় ৫০টির বেশি নতুন বই নিয়ে আসবে জানিয়ে ফরিদ আহমেদ বলেন, "বইমেলা তো প্রতি বছরই হয় এবং আমরা তার জন্য একটা প্রস্তুতি নিয়েই রাখি। এবারও আমরা সেভাবে কাজ করছি।"
অন্যদিকে প্রকাশনা সংস্থা বাতিঘর এর কর্ণধার দীপঙ্কর দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আমরা তো সারা বছরই বই প্রকাশ করি। গত মেলার পর থেকে নিয়মিতই নতুন বই প্রকাশ হচ্ছে, সব মিলিয়ে ২৫টির মতো বই এসেছে। আরও ২৫টির মত বই আসবে। সব মিলিয়ে মেলায় ৫০টির মতো নতুন বই থাকবে বাতিঘরে।"
মেলার সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে দীপঙ্কর বলেন, “গেল কয়েক বছর তো নানা কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না, করোনার একটা প্রভাব প্রকাশনা শিল্পে পড়েছে। এবার সেটা কাটিয়ে উঠে বইমেলা প্রাণবন্ত হবে বলে আশা করি।"
মেট্রোরেল সংযোগ
গত ২০ জানুয়ারি সকাল থেকে রাত ৮টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত চালু হয়েছে মতিঝিল উত্তরা মেট্রোরেল। আর বইমেলা প্রাঙ্গণের কাছেই মেট্রোরেল স্টেশন। তাতে এবার বইমেলায় আসা-যাওয়ায় সুবিধা হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রকাশক ফরিদ আহমেদ বলেন, "এবার মেট্রোরেল থাকায় অনেকে মেলায় আসবেন। উত্তরা থেকে যারা যানজটের চিন্তা করে মেলায় আসতেন না, তারাও এবার আসবেন। ফলে মেট্রোরেল বইমেলায় নতুন সংযোজন, এটা বলা যায়।”
বাতিঘরের দীপঙ্কর দাশও বলেন, “মেট্রোরেল এবার বইমেলার যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটা নতুন সংযোজন হয়েছে। উত্তরা, মিরপুর থেকেও অনেকে খুব সহজে মেলায় আসতে পারবেন। মেট্রোরেলে করে টিএসসি স্টেশনে নামলেই তো বইমেলা। ফলে মানুষের প্রাণে প্রাণ মেলাবার মত একটা মেলা হবে বলেই প্রত্যাশা করি।
ইতিহাসের পাতায়
১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির গেইটে চট বিছিয়ে বই বিক্রি শুরু করেন মুক্তধারা প্রকাশনীর মালিক চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭৭ সালে তার সঙ্গে আরও অনেকে যোগ দেন।
১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে এ বইমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। পরের বছর মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি।
১৯৮৩ সালে মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকার সময় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে এ মেলা আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও তা করা যায়নি। পরের বছর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সূচনা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র।
মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের মাস ফেব্রুয়ারিজুড়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের এই বইমেলা এখন বাঙালির মননের মেলায় পরিণত হয়েছে।
১৯৮৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নাম দিয়ে ধারাবাহিকভাবে মেলা পরিচালনা করছে।
২০২০ সালের মেলার উদ্বোধনপর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে ‘গ্রন্থমেলা’র পরিবর্তে ‘বইমেলা’ শব্দটি ব্যবহার অধিক শ্রুতিমধুর ও পাঠকপ্রিয় হবে বলে মত প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায়কে সাদরে গ্রহণ করে ২০২১ সালে বইমেলার প্রাতিষ্ঠানিক নামকরণ হয় ‘অমর একুশে বইমেলা’।
কোভিড ভাইরাস সংক্রমণের বিধিনিষেধের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতাকে গুরুত্ব দিয়ে ২০২১ সালে শুরু হয় মার্চে; আর পরের বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্দা ওঠে বইমেলার।
তারও আগের বছর ২০২০ সালে মেলা শুরু হয়েছিল একদিন পিছিয়ে। প্রতিবছর ১ ফেব্রুয়ারি পর্দা উঠলেও সেবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ভোট থাকায় তা একদিন পিছিয়েছিল।
কয়েকবারের ওই বিভ্রাট বাদ দিলে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনই বইমেলার উদ্বোধন হয়ে আসছে।