Published : 10 Jul 2023, 09:29 PM
কোরবানি ঈদের লম্বা ছুটি শেষে স্কুলে ফিরতে শুরু করেছে শিশুরা; তবে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার মধ্যে তাদের শ্রেণিকক্ষে পাঠিয়ে বাইরে মায়েদের উৎকণ্ঠা দীর্ঘ হচ্ছে।
ঢাকায় গত কয়েকদিন থেকে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে প্রায় সবখানেই। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার তালিকায় রয়েছে বেশির ভাগ ওয়ার্ড। প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার মধ্যে মৃত্যুর খবরও আসছে সংবাদমাধ্যমে। এরমধ্যে আক্রান্ত ও মারা যাওয়াদের মধ্যে অনেক শিশু থাকার তথ্য মায়েদের দুশ্চিন্তার বড় কারণ।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে রোববার খুলেছে ঢাকার বেশির ভাগ স্কুল। চলতি সপ্তাহেই বাকিগুলোতেও পাঠদান শুরু হবে। স্কুল খোলার আগে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) নির্দেশনাও দিয়েছে। এ রোগ নিয়ে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছে।
সোমবার দুপুরে ঢাকায় তেজগাঁওয়ে গভর্নমেন্ট সায়েন্স হাইস্কুলে গেলে কথা হয় সেখানকার দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র আব্দুল্লাহের মা আফসানা আক্তার তানিয়ার সঙ্গে; যিনি তিন বছর বয়সী কন্যা বুশরাকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন।
অন্যান্য মায়ের মতো তিনিও অপেক্ষায় ছিলেন, কখন আড়াইটা বাজবে। কারণ তখন স্কুল ছুটি হবে এবং তারপর দুই সন্তানকে নিয়ে বাসায় ফিরবেন। তবে ডেঙ্গুর চলমান প্রকোপের মধ্যে এ মায়ের শঙ্কা, তার সন্তানরা ঠিকঠাক সংক্রমণ ছাড়া থাকবে তো।
স্কুল প্রাঙ্গণে মশার উপদ্রব অনেক বেশি জানিয়ে তিনি বলেন, “আপনি এখানে কতক্ষণ বসেন, তারপর বুঝবেন যে কী পরিমাণ মশা, বসলেই কামড়ায়। কিন্তু এত ছোট বাচ্চা নিয়ে তো আমি দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না।
“এখন বর্ষাকাল। আমরা জানি যে মশা থাকবেই। কিন্তু সবখানে ডেঙ্গু হচ্ছে তো, এখন তাই ভয়টাও বেশি। এই যে ঝোপগুলা আপনি দেখছেন, এখানে সবচেয়ে বেশি মশা। অনেক বড় বড় মশা।”
দীর্ঘদিন বন্ধের পর স্কুল খুলল শ্রেণিকক্ষসহ আশেপাশের পরিবেশ নিয়ে ভয় মায়েদের। মশা কতটুকু বিস্তার লাভ করেছে, ডেঙ্গুবাহী মশা আছে কি না তা নিয়ে শঙ্কা তাদের।
বাচ্চাকে শ্রেণিকক্ষে পাঠানোর পর দুশ্চিন্তার কথা জানিয়ে তানিয়া বলেন, “ওদের ক্লাসরুমগুলো অনেক বিশাল। আপনি যদি ক্লাসে যান, সেখানেও মশা পাবেন। যদিও স্কুল চেষ্টা করে সবকিছু ক্লিন রাখতে, কিন্তু তারপরও।
“যেভাবে চারদিকে ডেঙ্গু হচ্ছে, এই যে এখানে এই বাচ্চাটা নিয়ে আমি রোজ বসে থাকি, আমরাও তো রিস্কে।”
তানিয়া যখন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এসব বলছিলেন, তখন পাশেই ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণির আরেক ছাত্র আব্দুল্লাহ আল মাহিমের মা শাহীদা তাসনিম।
আলোচনায় যোগ দিয়ে তিনি বলেন, “বাচ্চাদেরকে ক্লাসে পাঠিয়ে আমরা টেনশনে থাকি। এই ডেঙ্গুর ভয়ে কেউ কেউ কিন্তু তার বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন না।”
আরেক অভিভাবক শিউলি জামান হতাশার সঙ্গে বলেন, “আমরা বাসা-বাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখি, যাতে বাচ্চারা সুস্থ থাকে। কিন্তু রাস্তাঘাটে, স্কুলে, ক্লাসে মশা থাকলে আমরা বাবা-মায়েরা আর কিই বা করতে পারব। তবে সরকারিভাবে যদি সবখানে মেডিসিন দেওয়া হয়, তাহলে অনেক ভালো হবে।”
মশার উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য স্কুল থেকে অভিভাবকদের বিশেষ কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে আবদুল্লাহের মা তানিয়া বলেন, “স্কুল কোনো পদক্ষেপ নিছে কি না জানি না। স্কুল তো খুললোই আজ দুইদিন হইল। কোনো নির্দেশনার কথা শুনি নাই।”
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্বিতীয় শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থীর মা বলেন, “মশা সব জায়গায়ই আছে। ডেঙ্গু যে শুধু স্কুল থেকেই হয়, তা তো না। ঘরেও হয়। বাসায় যদি ফুলের টবে পানি থাকে, সেখানেও মশা হয়। আর বাচ্চারা শুধু স্কুলে আসে না। অনেক সময় খেলতে যায়। বাইরে গেলে ডেঙ্গু মশা কামড়াতে পারে।”
বিকাল ৫টার পর স্কুল প্রাঙ্গণে ওষুধ দেওয়ার তথ্য শুনেছেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “ফুল হাত শার্ট পরাইয়া দিলেই তো হয় না। কারণ এখন গরমের সিজন। যেটা দরকার, তা হল স্কুলে বেশি করে ওষুধ দেওয়া। পাশাপাশি বাসাবাড়ির আশেপাশে, রাস্তাঘাটে যেন সরকার (সিটি করপোরেশন) রেগুলার মশার ওষুধ দেয়।
“আমার বাসা নাখালপাড়া। তারা ওইখানে একদিন ওষুধ দিলে পরের দুইদিন আর দেয় না। স্কুলের আর কি দোষ?”
এ বিষয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক রহিমা আক্তারের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, তারা নিয়মিত স্কুল পরিষ্কার করেন।
তার ভাষ্য, “প্রতিদিন বাগান পরিষ্কার করাই। আজকেও আমি সব প্যাকেট, বোতল পরিষ্কার করিয়েছি। কিন্তু বাচ্চারা তো আসলে ছোট, কথা শোনে না। ওরা চিপস খায়, খেয়ে প্যাকেটটা যেখানে সেখানে ফেলে দেয়। আবার পানি খেয়ে বোতলটা নির্দিষ্ট জায়গায় রাখে না। বৃষ্টি হলে তো এগুলাতে পানি জমে।
“আজকে টিফিনে ওদেরকে রুটি দিয়েছি এবং বলেছি যে প্যাকেটটা যেন ব্যাগে করে বাসায় নিয়ে যায়। তারপরও দেখা যাবে, কেউ কেউ ওটা বাসায়ও নেবে না, বিনেও ফেলবে না। এদিক সেদিক ফেলবে। তবে চেষ্টা করছি আমরা।”
স্কুল প্রাঙ্গণে নিয়মিত মশার স্প্রে করার বিষয়ে তিনি বলেন, “সিটি করপোরেশন থেকে মশার ওষুধ তো প্রতিদিনই দিয়ে যায়। কিন্তু কালকে দেয় নাই। ফোন বন্ধ ছিল তাদের।”
এখন পর্যন্ত তার জানামতে স্কুলের একটা বাচ্চাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, “আমার মনে হয় এখানে ডেঙ্গু মশা নাই। যদি থাকত তাহলে আমায় একটা না একটায় কামড়াতো। কারণ বিকালেও তো আমি থাকি এখানে।
“এগুলা তো আসলে পরিষ্কার পানিতে হয়। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি স্কুল ক্লিন রাখতে। কিন্তু স্কুলের সামনেটা তো আমরা ক্লিন করতে পারব না। এই মেট্রোরেলের কাজের জন্য স্কুলের সামনের রাস্তার যে অবস্থা, যে পরিমাণ চিপসের খোসা, ডাবের খোসা ছড়ানো; এত এত গর্ত, ময়লা ওখানেও মশা থাকতে পারে।”
স্কুলে মশা নিধনের বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, “যার যার স্কুলের দায়িত্ব তার তার। রাস্তার দায়িত্ব আমার। আমি বাউন্ডারির ভেতরে ঢুকব না। সব বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকে স্প্রে করা তো অসম্ভব আমাদের জন্য।”
প্রত্যেক স্কুলের নিজ নিজ ফগিং মেশিন থাকা উচিৎ জানিয়ে তিনি বলেন, “স্কুল কর্তৃপক্ষ টাকা নিচ্ছে। বেতন নিচ্ছে। ওরা ফগিং মেশিন কিনবে। যার দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে। তবে হ্যাঁ, হঠাৎ করে কেউ অনুরোধ করলে সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু প্রতিদিন যদি প্রতিটা স্কুল চায়, সেই অবস্থা তো নাই।”
ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী বলছে মাউশি
ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ দেখা দেওয়ায় দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করার নির্দেশনা দিয়ে গত ৬ জুলাই বিজ্ঞপ্তিতে মাউশি বলেছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলার মাঠ এবং ভবনগুলোর মাঝে সাধারণত পানি জমে থাকে।
এছাড়া স্কুলের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য থাকা ফুলের টবেও পানি জমে। এইডিস মশার প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে এগুলো উপযুক্ত স্থান। এ কারণে এগুলোকে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
বর্ষাকালে মাঠে বা ভবনে পানি জমা স্বাভাবিক হলেও তা দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে।
একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদেরকে নিয়মিত ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায় জানাতে স্কুল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিয়েছে অধিদপ্তর।