Published : 04 Apr 2023, 10:44 PM
আগের রাতেই অর্ডার করা ১৪ লাখ টাকার নতুন মালামাল তুলেছিলেন গুদামে। ঈদকে সামনে রেখে এজন্য বড় অঙ্কের ঋণও নিয়েছিলেন ব্যাংক থেকে। এক সকালের আগুনেই সব এলোমেলো হয়ে গেছে মাঈনুদ্দিন আহমেদের।
মঙ্গলবার সকালের ভয়াবহ আগুনে বঙ্গবাজারের এ ব্যবসায়ীর পুঁজির বড় অংশই গেছে; সঙ্গে ব্যাংক ও স্থানীয় সমিতি থেকে নেওয়া ২৫ লাখ টাকার মালামালও পুড়েছে।
ঋণের এ বাড়তি বোঝা আরও চাপ তৈরি করেছে মহা এ বিপদের কালে, ভারাক্রান্ত করে তুলেছে মাঝবয়সী মাঈনুদ্দিনকে।
দুই দশক ধরে বঙ্গবাজারে জিন্সের প্যান্ট, ট্রাউজার ও টি শার্টের পাইকারি এই ব্যবসায়ী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকালে ম্যানেজার ফোন দিয়ে জানাল আগুন লেগেছে মার্কেটে। আমি আসতে আসতে বঙ্গবাজারের কাঠের মার্কেট পুড়ে শেষ।’’
এসএমই ঋণের আওতায় ব্র্যাক ব্যাংক থেকে সবশেষ ১২ লাখ টাকা নিয়ে সোমবার রাতেই মালামাল তুলেছিলেন মাঈনুদ্দিন। গুদামে থাকা পণ্য পুড়ে এখন অর্থ পরিশোধের নতুন দুশ্চিন্তা চেপেছে তার মাথায়।
তিনটি দোকান ও গুদামের সঙ্গে রাজধানীর শনির আখাড়ায় কারখানা থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ``গোডাউনের সব মাল পুইড়া শ্যাষ। সমিতি থেকেও টাকা নিছি। সমিতি আর ব্যাংক মিইল্যা ২৫ লাখ টাকা হইব।’’
মঙ্গলবার ভোর ৬টা ১০ মিনিটে দেশের অন্যতম বড় কাপড়ের মার্কেট বঙ্গবাজারে আগুন লাগে। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস মিনিট দুইয়ের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলেও বাতাসের মধ্যে ঘিঞ্জি ওই মার্কেটের আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিটের চেষ্টায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর আগুনের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণে এলেও ততক্ষণে কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি তিন তলা বঙ্গবাজার মার্কেট, মহানগর শপিং কমপ্লেক্স, আদর্শ মার্কেট ও গুলিস্তান মার্কেট পুরোপুরি পুড়ে যায়।
বঙ্গবাজারে থাকা সব পণ্য পুড়লেও মহানগর শপিং কমপ্লেক্স ও এনেক্সকোতে থাকা দুই দোকান থেকে কিছু মালামাল বের করার পর তা বস্তায় করে আরেক গুদামে পাঠানোর সময় মাঈনুদ্দিন বলেন, ‘‘সবকিছু মিলিয়ে ৩০ শতাংশ মাল বের করতে পারছি। এখন তা আরেক গোডাউনে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’’
তার মতো ব্যাংক ও স্থানীয় সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে ঈদের আগে পণ্য তুলেছিলেন আরও অনেকে। পণ্য যাওয়ার পর এখন ঋণ পরিশোধের নতুন চিন্তার ভাঁজ তাদের কপালে।
বঙ্গবাজারের আদর্শ মার্কেটে দুই সাটারের একটি দোকান ছিল নজরুল ইসলামের। সব হারিয়ে দোকানের কর্মচারীদের নিয়ে এনেক্সকো ভবনের সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘এক টাকার মালও বের করতে পারেনি। সব শ্যাষ হইয়া গেছে। আসার পর শুধু আগুন দেখলাম।’’
এরপর আর কথা এগোতে পারলেন না। চোখের পানি গাল বেয়ে গড়াতে শুরু করে। কান্না লুকাতে দ্রুত সরে যান সেখান থেকে। কর্মচারীরাও নিরব হয়ে পড়েন।
ঈদ উপলক্ষে বরাবরের মত বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে দোকানে মালামাল তুলেছিলেন মিজানুর রহমান। আগুন লাগার পর সেসব মালামালের কিছুই উদ্ধার করতে পারেননি বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান তিনি।
“দুই কোটি টাকা ঋণ নিয়েছি ব্যাংক ও স্বজনদের কাছ থেকে ঈদ উপলক্ষে মালামাল তুলতে। সাত দোকানে ৮-১০ কোটি টাকার মালামাল ছিল। কিন্তু এক সুতাও উদ্ধার করতে পারিনি।”
ঈদের আগ মুহূর্তে দোকানের মালামাল খুইয়ে চিন্তাগ্রস্ত আরেক ব্যবসায়ী আম্মার হোসেন বিলাপই করছিলেন।
পাশে থাকা কর্মচারীদের উদ্দেশ্য বলছিলেন, “ক্যামনে আবার সোজা হমু। চালানতো সব শ্যাষ । কারখানায় বাকি আছে। মাল বেইচ্যা ট্যাকা দেওনের কথা। এহন হেতেরা কী মানবো। ট্যাকা পামু কই?
পাঁচ লাখ টাকা ফেরত পাওয়ার দুশ্চিন্তা রহিমের
বঙ্গবাজারের স্মরণকালের ভয়াবহ এ আগুনে দিশেহারা আরেক ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম। তার দুশ্চিন্তা অন্যদের কাছে থাকা বকেয়া টাকা উদ্ধার নিয়ে। আগুনে দোকানে থাকা পণ্যের সঙ্গে তিনি যাদের কাছ থেকে পণ্য বিক্রি বাবদ টাকা পাবেন সেই তালিকা পুড়ে গেছে।
পোড়া মার্কেটের দিকে তাকিয়ে হতাশ কণ্ঠে তিনি জানান, ওই খাতায় বিভিন্ন ব্যক্তিদের নাম-ফোন নম্বর ছিল, যাদের কাছে তিনি পাঁচ লাখ টাকার বেশি পাবেন।
“ওদের এখন কীভাবে পাব? ফোন নম্বরই বা পাব কই?”- কাতর শোনাল যুবক এ ব্যবসায়ীর কণ্ঠ।
সিঙ্গাপুর ফেরত এ ব্যবসায়ীর আরও গেছে দোকানের ভেতর থাকা নগদ দুই লাখ টাকা।
প্রায় পাঁচ বছর সিঙ্গাপুরে শ্রম দিয়ে আব্দুর রহিম কিছু টাকা জমিয়ে জিন্সের প্যান্টের দোকান দিয়েছিলেন মহানগরী মার্কেটে। সেখানের দোতালায় দুটি দোকান ছিল তার। ঈদ সামনে রেখে বেশি করে প্যান্ট তুলেছিলেন।
আগুন লাগার খবর পেয়ে সকাল ৭টার দিকে জুরাইনের বাসা থেকে এসে দেখেন মার্কেট জ্বলছে। দোকানে যাওয়া যাচ্ছে না।
“চোখের সামনে দেখি জ্বলছে, হা হুতাশ ছাড়া কিচ্ছু করার ছিল না। এমন দৃশ্য জীবদ্দশায় দেখিনি। নিজের সম্পদ পুড়ে যাচ্ছে কী করব বলেন?”
আরও পড়ুন
ঈদের স্বপ্ন ছাই করে দিল বঙ্গবাজারের আগুন
‘সব তো দোকানে দিছি, এখন তো কিছুই নাই’
বঙ্গবাজারে আগুন নেভাতে গলদঘর্ম ফায়ার সার্ভিস
আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যবসায় ফেরাতে দরকার ৭০০ কোটি টাকা: হেলাল উদ্দিন