Published : 10 Apr 2024, 12:46 AM
দুই মাসের শিশুকে কোলে নিয়ে রাস্তার পাশে একটি কংক্রিট ব্লকের উপর বসা মহিবুল্লাহ। সঙ্গে স্ত্রী ও আরেক আত্মীয়ও আছে, কিন্তু পকেটের অবস্থা বেশি ভালো না। তাই মহিবুল্লাহরা ঈদযাত্রার জন্য খুঁজছেন বগুড়ামুখী কোনো ট্রাক বা পিকআপ।
ঢাকা শহরের চৌহদ্দির একেবারে প্রান্তে আমিনবাজার সেতুর ঢালে মঙ্গলবার রাত সাড়ে দশটার দিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে অন্তত হাজার খানেক মানুষকে। তারা সবাই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রী।
বেশিরভাগই এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছেন কম টাকায় বাড়ি পৌঁছার জন্য। বাস কাউন্টারে যে ভাড়া, তার চেয়ে অন্তত ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কম টাকায় এখান থেকে গন্তব্যে যাওয়া যায়।
আবার কেউ আছেন বাসের ইঞ্জিন কভার বা ট্রাকের আশায়, তাতেও ভাড়াটা লাগে অনেক কম। তাদের কেউ পোশাক কর্মী, কেউ ঢাকা শহরে রিকশা চালান, কেউবা নির্মাণ শ্রমিক।
রিকশা চালক হাফিজুল ইসলাম যাবেন লালমনিরহাট। আরো দুজনের সঙ্গে রাস্তার পাশে বসে নির্ভাবনায় চা-বিস্কুট খাচ্ছিলেন। পান খাওয়া লাল দাঁত, মলিন শার্ট আর চিটচিটে লুঙ্গি পরা হাফিজুলের হাতে একটা মাত্র কাপড়ের পোটলা।
হাফিজুল জানালেন, ঈদের সময় টাকা রোজগার করবেন বলে মধ্য রোজাতে বাড়ি থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু গত দুই দিনে ভাড়া একেবারেই কমে গেছে। তার উপর রিকশা গ্যারেজের বেশিরভাগ লোকও বাড়ি গেছে। থাকা-খাওয়ারও কষ্ট, খাওয়ার খরচও বেড়ে গেছে। এসব কারণে ঈদের আগেই চলে যেতে হচ্ছে।
হাফিজুল বললেন, এবার প্রত্যাশিত রোজগার করতে পারেননি। বাড়িতে দুই ছেলের জন্য শার্ট-প্যান্ট কিনতে পেরেছেন, এতেই খুশি তিনি।
নুরুল ইসলামের গল্পটা অবশ্য অন্যরকম। থাকেন গাবতলীর পাশে হরিরামপুরে, গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। গাবতলীতে ঠেলাগাড়িতে চটপটি বেচেন তিনি। সেখানে ভিড় নেই; আমিনবাজার সেতুর ঢালে ভিড়- এমন খবর শুনে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এসে এখানে দোকান বসিয়েছেন। বিক্রিবাট্টাও হচ্ছে মোটামুটি।
সেখানে চটপটি খাচ্ছিলেন সেকেন্দার আলী যাবেন রংপুরের তারাগঞ্জে। জানালেন, মিরপুর এলাকায় একটি খাবার বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করেন। কাজ শেষ করে অফিসে হিসাব বুঝিয়ে গাবতলী এসেছিলেন। হাজার টাকার নিচে কোনো বাসেই টিকেট মিলছে না। অবশেষে আরেকজনের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আমিনবাজার সেতুর ঢালে এসে দাঁড়িয়েছেন। ইফতারের পর তেমন কিছু খাওয়া হয়নি, নুরুল ইসলামের দোকান থেকে এক প্লেট চটপটি খেয়ে নিচ্ছেন।
সেকেন্দার আলী বললেন, “কাউন্টারে গেলে হাজার টাকা, আর এখান থেকে সাত-আটশ টাকা দাম চাচ্ছে। ইঞ্জিন কভারে বসে গেলে সেটা ৫০০ টাকার নিচে নেমে আসবে।
“প্রথমে ভেবেছিলাম গাড়ি পাব না, এখানে এসে দেখি প্রচুর গাড়ি, রাস্তায় বাস থামিয়ে ডাকাডাকি করছে হেল্পার ও সুপারভাইজাররা।”
মূল সড়কের উপর বাস থামলেই দুই পাশ থেকে সবুজ লেজার মারছেন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। তবে কেউ কেউ পাশের নির্মাণাধীন রাস্তায় বাস থামিয়ে রাখছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে।
মানুষের ভিড় দেখে এখানে এসে দোকান দিয়ে বসছেন বাদাম-চা-সিগারেটওলা; ডিম বিক্রেতারাও।
ছোট্ট এলইডি বাল্ব জ্বালিয়ে এক ঝাঁকা বাদাম নিয়ে বসে আছেন ওসমান গনি।
ঈদে বাড়ি যাবেন না, প্রশ্ন শুনে তিনি বললেন, “ভাবছিলাম আজকে যামুগা। ঢাকা শহরে বেচাবিক্রি নাই। পরে এখানে আইসা বসছি। ভালোই বেচাবিক্রি চলতেছে। এই ঝাঁকাটা বিক্রি হইলেই যামু গিয়া।"
বিভিন্ন পরিবহনের বাস রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় যাত্রীদের দিকে ইশারা-ইঙ্গিতে গন্তব্য জানতে চাইছেন সুপারভাইজাররা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসগুলো এখানে এসে থামছে ইঞ্জিন কভারে যাত্রী তোলার জন্য।
ঠাকুরগাঁওগামী স্লিপার বাস ‘ইউরো কোচ’ এখানে এসে দাঁড়ানোর পর লোকজনের তেমন নড়াচড়া নেই। হেল্পার হেঁকে চলেছেন, রংপুর-সৈয়দপুর-ঠাকুরগাঁও। চারজনের একটা দল এগিয়ে গিয়ে দাম জিজ্ঞেস করতেই হেল্পার জানালেন, সিট নিলে আড়াই হাজার। অমনি হই হই করতে করতে সরে এলেন তারা। পুলিশের তাড়ায় লোক না উঠিয়েই বাসটি ছেড়ে গেল।
এর মধ্যেই ‘বগুড়া, বগুড়া' ডাকতে ডাকতে একটা পিকআপ ভ্যান ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। একদল গিয়ে দাম জিজ্ঞেস করতেই চালক জানালেন, দুইশ টাকা। নিচ থেকে আওয়াজ হল দেড়শ।
হেলপার হাতের ইশারায় সবাই উঠতে বললেন। অমনি দশ-এগারো জনের একটি দল পিকআপে গিয়ে বসলেন। ঈদের আগ পর্যন্ত এই জায়গায় ঘরে ফেরার যান পেতে ভিড় থাকবে স্বল্প আয়ের মানুষের।