Published : 29 Dec 2023, 12:43 AM
তরুণদের কারও জানার ইচ্ছা এত ব্যস্ততার মাঝেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কীভাবে মাছ ধরা কিংবা মোরগ পোলাও রান্নার সময় বের করেন, কেউ প্রশ্ন করলেন সরকারপ্রধানের গ্রাম ভালো লাগে না কি শহর; কয়েকজন জানালেন, তারা প্রধানমন্ত্রী হলে তাদের কাজের অগ্রাধিকারে কী থাকত।
বৃহস্পতিবার সম্প্রচারিত লেটস টক আয়োজনে আড্ডা আর গল্পচ্ছলে ‘নাতি-নাতনি’ সম্পর্ক পেতে তাদের সেই জানার ক্ষুধা মিটিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী; আহ্বান জানালেন উন্নত দেশের যাত্রাপথে তরুণদের কাঁধে দায়িত্ব নেওয়ার।
অনুষ্ঠানের শেষ প্রান্তে এসে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এখন মর্যাদা পেয়েছি, সেটাকে আমাদের কার্যকর করে উন্নত দেশ হিসেবে এদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের থেমে থাকলে চলবে না। আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।”
তরুণদের জ্ঞানে-দক্ষতায় প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “এই সীমিত সম্পদ দিয়েই আজকে বাংলাদেশকে কেউ আর অবহেলা করতে পারে না, বরং উন্নয়নের রোলমডেল বলে। কিন্তু এই ধারাটা অব্যাহত রাখতে হবে। আর সেটা আমি এই তরুণ প্রজন্মের হাতে দায়িত্বটা দিয়ে দিচ্ছি আজকে। তোমরাই ভবিষ্যৎ, তোমরাই করবে। এবং তোমরা পারবে।”
আওয়ামী লীগের গবেষণা উইং সিআরআই (সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন) আয়োজিত লেটস টক অনুষ্ঠানে তরুণের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
গত শুক্রবার রাতে ধারণ করা অনুষ্ঠানটি প্রায় এক সপ্তাহ পর বৃহস্পতিবার বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচার করা হয়।
অনুষ্ঠানে স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে তরুণদের ভাবনা ও তাদের চাওয়া-পাওয়াগুলো জেনে নেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সঙ্গে তাদের নানা প্রশ্নের জবাবও দেন।
২০১৮ সালে লেটস টক অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো তরুণদের মুখোমুখি হন শেখ হাসিনা। এবারের অনুষ্ঠানে তিনি আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি এবং তরুণদের নিয়ে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা ও নীতি নির্ধারণ বিষয়ে কথা বলেন।
অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহার সঞ্চালনায় দেশ গঠনে কাজ করে যাওয়া ও নিজ অবস্থান থেকে দেশের জন্য সুনাম নিয়ে আসা প্রায় ৩০০ জন তরুণ অংশ নেন।
‘এক ঝাঁক নাতি-নাতনি পেলাম’
শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপক হাসিচ্ছলে বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি তো অনেক মিটিং করেন, প্রতিদিন, সারাদিন, কত রকমের মানুষের সাথে, কত রকমের মতবিনিময় হয়। আজকে আবহাওয়াটা একটু আলাদা। এখানে পুরো বাংলাদেশ থেকে তরুণ-তরুণীরা এসেছেন, শিক্ষার্থী এসেছেন, কেউ বক্সার, কেউ ইনফ্লুয়েন্সার, কেউ ফুটবল খেলে। আপনার কেমন লাগছে আজকে এখানে এসে?“
প্রধানমন্ত্রী হাসতে হাসতে যে উত্তর দিলেন, তাতে মিলনায়তনে হাসির রোল পড়ে যায়। তিনি বলেন, “আমার নাতি নাতনীরা বিদেশে থাকে, তাদেরকে কাছে পাই না। তবে, এক ঝাঁক নাতি-নাতনি পেলাম এখানে। সেটাই আমার একটু ভালো লাগতেছে।”
‘ফ্রি ল্যান্সারদের জন্য’ শেখ হাসিনা
এরপর উপস্থাপকেরই প্রশ্নে ডিজিটাল বাংলাদেশের পথ ধরে স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্যের দিকে যাত্রার বিষয়ে কথা তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ প্রধান।
মোবাইল ও ইন্টারনেটের বিকাশ, সরকারি সেবার ডিজিটালাইজেশন এবং অর্থনীতিসহ বহুবিধ কর্মকাণ্ড অনলাইন মাধ্যমে হওয়ার কথা তুলে ধরার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সারদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি কথা উল্লেখ করেন তিনি।
ঘরে বসে তাদের বিদেশে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনার ব্যবস্থা তৈরি করার সময়ের কথা স্মরণ করেন শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া নির্দেশনার উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ছেলেমেয়েরা ফরেন কারেন্সি নিয়ে আসছে, এত প্রশ্ন করার দরকার কী? অস্বাভাবিক অ্যামাউন্ট হলে সেটা আপনারা ধরবেন। জঙ্গিবাদে ব্যবহার হলে সেটা ধরবেন। ২০০, ৫০০, ১০ হাজার ২০ ডলার আনবে, সেটার জন্য এত প্রশ্নের তো দরকার নাই।”
ফ্রিল্যান্সারদের যে পরিচয়ের কারণেও বহুক্ষেত্রে বিড়ম্বনার শিকার হতে হত, সেটা দূর করতে উদ্যোগ নেওয়ার প্রসঙ্গে বিয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা পড়ার কথা তুলে ধরে হাস্যরসের সৃষ্টি করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “সমস্যা হয় কি-না, দেখেন। কাজ করতে গেলে, যেমন বিয়ের বাজারে। নিশ্চয় শ্বশুর বাড়ি কিছুতেই মানবে না, ছেলে তো কামাই করে না। যখন বলে ফ্রিল্যান্সার ওটা আবার কী। ফ্রি আবার কী? সে তো ফ্রি কাজ করে তাকে আমি কেন ইয়ে করব।“
আরেকবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে বার্তা এল, ফ্রিল্যান্সার হওয়ার কারণে নিয়মিত আয় না থাকার কারণে বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারছেন না। পরে ছেলে সজীব ওয়াজেদের জয়ের মাধ্যমে সেই সমস্যা দূর করেন তিনি।
সেই অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমার কাছে মেসেজ আসল, ‘বাচ্চাকে ভর্তি করাবে না। বলে, আপনার তো কোনো কামাই নাই।’ আমি বলি, ‘আমি তো ফ্রিল্যান্সার।’ ও বলে, ‘আপনার এটা কোনো ইনকাম না’।
“মহা মুশকিল! আমি আবার জয়কে ধরলাম, তোমাকে একটা কিছু করতে হবে। নিবন্ধন করা, স্বীকৃতি দেওয়া। তোমরা রেডি করো, আমি নিজে দিব।”
এরপর নিজেও বক্তৃতায় এই বিষয় বলতে শুরু করার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি নিজে বক্তৃতায় বলতে শুরু করলাম, এটাকে আরও জনপ্রিয় করার জন্য যে, না এটাও একটা ইনকামের সুযোগ।”
কোভিড-১৯ মহামারীর প্রযুক্তির দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত হওয়ার পথ তৈরি করেছে উল্লেখ করে এর বিকাশে ‘এই নাতিপুতিদের’ জন্য আরও উদ্যোগ নেওয়ার কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করবে। আমাদের ছেলেমেয়েরা শিখবে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমাদের আজকে আমাদের নাতিপুতিরা সব ভবিষ্যতে ৪১ এর কর্ণধার হবে।”
ব্যাডমিন্টন খেলা আর মাছ ধরা
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মজার গল্পে তার ব্যাডমিন্টন খেলা ও মাছ ধরার ভিডিওর বিষয়ে জানতে চান উপস্থাপক সেঁজুতি সাহা।
তিনি বলেন, “আমি অনেকগুলো ভিডিওতে দেখেছি আপনি ব্যাডমিন্টন খেলছেন, মাছ ধরছেন। আমি একটু জানতে চাই, আসলে কি আপনি অবসর সময়ে ব্যাটমিন্টন খেলেন, নাকি শীতের সময়?”
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “এক সময় তো খেলতাম। তো এখন বয়স হয়ে গেছে না! খেলতে আমার ভালো লাগে। ঠাস করে পড়ে যদি আবার ঠ্যাং ভেঙে পড়ে থাকি তখন কী হবে?
“তারপরেও যখন ছেলেমেয়েরা, নাতিপুতি সব আসে। তো তার সাথে ধরি একটু, ব্যাডমিন্টনটা ধরি, ভালোই লাগে ওদের সাথে, ছোটদের সাথে খেলতে তো লাগে।”
মাছ ধরার বিষয়ে তিনি বলেন, “যখন বিকেলে প্রোগ্রাম থাকে না আমরা বিকেলে হাঁটি, ২০ মিনিট বা আধাঘণ্টার মতো হাঁটি।
“হেঁটে বাকিটা ওই লেকের পাড়ে বসি সিপ ফেলে। সময় বেশি পাই না। হয়তো আধাঘণ্টা হচ্ছে বা ২০ মিনিট, ৪০ মিনিট, কখনো সময় থাকে। ওর মধ্যে মাছটাছ পেলেই ধরে ফেলি।”
গণভবনকে রীতিমতো খামারবাড়িতে পরিণত করার কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “সেখানে মাছ চাষ হচ্ছে, মুক্তা চাষও শুরু করেছি। এক সময় আমাদের দেশে পিংক পার্ল ছিল তো, খুব নাম করা।
“মেঘনা নদীতে বিশেষ করে পিংক পার্লটা খুব হত। তারপরে ওই সময় থেকে আমি রিসার্চ শুরু করি এবং কাজে লাগাই। এখন কিন্তু অনেকেই মুক্ত চাষ করে, পুকুরে মুক্ত চাষ করে পয়সা কামাচ্ছে এবং ভালোই হচ্ছে আমাদের।”
রান্না করার গল্প
প্রধানমন্ত্রীর সেরা রান্না কোনটি, তা জানতে চান ফুড ব্লগার রাফসান। তিনি এও জানতে চান, বাইরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর খেতে ইচ্ছে করে কি না, বাইরের খাবার খাওয়ার সুযোগ আছে কি না।
জবাবে নিরাপত্তার কারণে বাইরে খেতে যেতে না পারার আফসোসের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি নিজের অম্লমধুর রান্নার গল্পও শোনান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “আসলে আমাদের এই সিকিউরিটির নামে বন্দি করে রাখে। আমি তো বলতে পারব না ঢাকায় কোনো একটা ভালো রেস্তোরাঁ আছে বা কোথাও যেতে পারছি বা কোথাও খেতে পারছি। এমনকি বাইরে গেলেও একই অবস্থা দাঁড়ায়। ওই নিরাপত্তা, নিরাপত্তা বলে বলে সব আর কেড়ে নেয়, এটি সমস্যা।”
ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের পছন্দ হওয়ায় মোরগ পোলাও, পিৎজা, লাজানিয়া প্রভৃতি খাবার রান্না করার কথা তুলে ধরেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, “আমি রান্না করি। কারণ, আমার ছেলে মেয়ে, নাতিরা খুব পছন্দ করে। আমি যাই রান্দি, ওদের কাছে ভালো লাগে। তো সেই জন্য বাচ্চারা যখন আসে, তখন তাদের জন্য রান্না করি। মোরগপোলাও রান্না করি। আবার মাছ করি, তারপর মাঝে মাঝে যখন ইতালিয়ান কিছু পিজ্জা, লাজানিয়া সেগুলোও করি।”
একবার মোজারেলা চিজ তৈরি করতে গিয়ে মনের ভুলে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথাও জানান প্রধানমন্ত্রী। ভাগনে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের স্ত্রীর জন্য সেই খাবার তৈরি করার সময় এই ভুল হয়।
তিনি বলেন, “ওটা তৈরি করে একটু ভিজিয়ে রেখে দিতে হয় ফ্রিজে। আমি রেখে তারপরে ভুলেই গেলাম, যে ওটা রেখে দিয়েছি। অনেকদিন পরে মানে হঠাৎ আমার ছোট বোনটা যখন আসল, ওটা (চিজ) বের করে দেখে যে পুরা ফাঙ্গাস পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।
“সেটি ছিল আমার সবচেয়ে খারাপ দিক। যে আমি আর ওটা বানাতে পারলাম না।”
এরপর মোজারেলা চিজের তৈরির চেষ্টাটা আর করেননি জানিয়ে হাসতে হাসতে তিনি বলেন, “আমি এটা চেষ্টাই করব না, যা!”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার এক ছোট্ট নাতনিতো রান্না করার জন্য ‘হুকুমই’ করে বসে। বলে, ‘তুমিই রান্না করবা..’।
প্রধানমন্ত্রীও তার কথা ফেলে দেন না।
তিনি বলেন, “ববির ছেলে। বলছে, ‘তুমি রান্না করবা।’ আবার সে আবার অনেক সময় আমার কোলে চড়ে বসে বলে, ও শিখবে।
“ডটার্স টেলেও আছে দুজন বসে। প্রত্যেকটা জিজ্ঞেস করছে, ‘কি দিলা এখন? এখন কি দিলা?’ মানে তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। তো যাই হোক আমার ভালো লাগে।”
‘এত পড়াশোনা করতে হয়!’
রান্না করতে ভালো লাগলেও কাজের চাপ আর সরকারি ফাইল পর্যালোচনার কারণে সেই ফুরসৎ কম পাওয়ার আফসোস করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “সারাক্ষণ এই ফাইল আর কাজ যার পড়াশোনা। এত পড়াশোনা করতে হয়, আগে যদি জানতাম! স্কুলে থাকতে যদি এত পড়তাম, তো প্রত্যেকবার ফার্স্ট হতাম। কিন্তু আমরা তো অত পড়ি নাই, এইজন্য এই বৃদ্ধ বয়সে এসে শুধু পড়তে হয়। এটাই সবচেয়ে কষ্টের।
“গল্পের বই পড়তে ভালো লাগে বা ম্যাগাজিন পড়তে ভালো লাগে। কিন্তু এই ফাইলের বই, রিপোর্ট এটা সেটা, সব দেখ, পড়, মন্তব্য দাও, আবার কারেকশান কর, অনেক ঝামেলা।”
বাইরে যেতে না পারা আফসোসের সঙ্গে জেলজীবনের কথা স্মরণ করেন তিনি। বলেন, “তখন একটা ছোট জেলে, এখন একটা বড় জেলে।”
“আমার গ্রামেই ভালো লাগে”
বিদেশ থেকে এসে বাংলাদেশে কনটেন্ট তৈরি করছেন মারিয়া, যার কাছে গ্রামের জীবনযাপন বেশ আকর্ষণীয়। প্রধানমন্ত্রী গ্রামে গিয়ে থাকতে চান কি না কিংবা গ্রামীণ জীবনযাপন তার কাছে কেমন লাগে, তা জানতে চান মারিয়া।
আট বছর পর্যন্ত গ্রামে বেড়ে ওঠা এবং পরে ঢাকায় আসলেও ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “সেখানে দুটো নদী, মধুমতি নদী এবং বাঘের নদীর কূলে। ঢাকা থেকে যেতে প্রায় ২২ থেকে ২৪ ঘণ্টা লাগত স্টিমারে। অবশ্যই স্টিমারে যাওয়াটাও খুব মজার ছিল।
ওই বিদেশি কনটেন্ট ক্রিয়েটরকে শেখ হাসিনা বলেন, “আমার গ্রামেই জন্ম হয় এবং আমি প্রায় আট বছর বয়স পর্যন্ত গ্রামেই ছিলাম আমার দাদা-দাদির সাথে। কারণ, আমার বাবা রাজনীতি করতে যেয়ে বারবার জেলে।”
পরে ঢাকায় আসলেও স্কুল ছুটিতে নিয়মিত গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা জানিয়ে সেই সময়ের মজার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন তিনি।
তিনি বলেন, “আমাদের বিদ্যুৎ ছিল না, রাস্তা ছিল না। ওই, পুকুরের পানি বা খালের পানি ব্যবহার করতে হতো, ওতে আমাদের কোনো দুঃখ ছিল না। ওটাই আমাদের মজার ছিল।”
গ্রামে ‘খুবই মজা’ হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এই যে আম-টাম পেড়ে খাওয়া, শীতকালে বরই, কচি কচি তেঁতুল। এখন তো অবশ্য বুড়ো হয়ে গেছি। এগুলি খেতে পারি না। কিন্তু একসময় তো ওইগুলি খেতে ছুটতাম।”
বাগান থেকে বইচি তুলে খাওয়ার স্মৃতিচারণ করে তা কীভাবে খেতে হয়, তা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “বইচি খাওয়ার একটা খুব মজা আছে। ওইটার শক্তটা ভালো লাগে না। ওটা পেড়ে ওই হাত দিয়ে ডলে ডলে নরম করতে হয়। তারপর খেতে মজা। এরকম বহু কিছু সেই গ্রামের স্মৃতি। আমার গ্রামেই ভালো লাগে।”
গ্রাম ভালো লাগার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি কিন্তু ঢাকা শহরে আমার কোনো বাড়ি টাড়ি কিছু নাই। আমি করিনি। কারণ আমি গ্রামেই থাকব আর এখন তো পদ্মা সেতু হয়ে গেছে তাড়াতাড়ি চলে যাব।”
প্রধানমন্ত্রী এত সময় কোথায় পান?
প্রধানমন্ত্রীর সময় ব্যবস্থাপনার বিষয়ে প্রশ্ন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নবনীতা চক্রবর্তী জানতে চান, “আপনি এত ব্যস্ত থাকেন। রাষ্ট্র পরিচালনাসহ নানান রকমের কাজ করেন। আবার বাড়িতে গিয়েও আপনি আপনার পরিবারের সঙ্গে চমৎকার সময় কাটান। এই যে সময়ের ব্যবস্থাপনা, সেটা কীভাবে করেন? কোন ম্যাজিকে করেন? আসলে এটা জাদু মন্ত্র কী?”
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “ম্যাজিক কিছু নাই। কথা হচ্ছে সময় করে নেওয়া। আর কাজের ফাঁকে ফাঁকেই কিন্তু এভাবে সময় করে নিতে হয়।
“হ্যাঁ, ব্যস্ত খুবই থাকতে হয়। কারণ, বাংলাদেশের মতো একটি জায়গা, যেখানে আমার ১৭ কোটি মানুষ, আমার তো ১৭ কোটি মানুষের দায়িত্ব নিতে হয়। তারপরে এত ডেভেলপমেন্টের কাজ আমরা হাতে নিয়েছি, সেগুলো করতে হবে।”
আওয়ামী লীগের মতো বড় রাজনৈতিক দল এবং সহযোগী সংগঠনকে দেখভাল করার দায়িত্বও থাকার কথা জানান শেখ হাসিনা।
এসবের মধ্যে সবার সঙ্গে এক ধরনের যোগাযোগ থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এই ফাঁকে ফাঁকে সকলের কথা, কেউ অসুখ বিসুখ বিয়ে সাদি যার যা কিছু আছে সেগুলো আমাকে খোঁজ রাখতে হয়। যাতে যতটুকু পারি সহযোগিতা করে যাচ্ছি।”
শেখ হাসিনা বলেন, “সময় করে নিতে হবে। আমি সবসময় একটা কথা বলি, নিজের ইচ্ছাশক্তি… সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আত্মবিশ্বাস। নিজের উপর একটা বিশ্বাস থাকা।”
এর বাইরে এখন বিরোধী দলের জ্বালাও-পোড়াও এবং অগ্নিসন্ত্রাসের কারণে ‘দুশ্চিন্তায়’ থাকতে হয় বলে জানান তিনি।
‘আমি যদি প্রধানমন্ত্রী হতাম’
লেটস টকের ‘আমি যদি প্রধানমন্ত্রী হই’ শীর্ষক পর্বে নিজেরা প্রধানমন্ত্রী হলে কী করতেন, তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন তিনজন। তাদের বক্তব্যের বিষয়ে পরে নিজের অবস্থান জানান শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী হলে বিদেশে মেধাপাচার ঠেকানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে প্রকৌশলী শুভাশীষ ভৌমিক বলেন, “এদের বেশির ভাগই পড়াশোনার জন্য বা বিভিন্নভাবে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং ব্রেইন ড্রেইন হচ্ছে। আমি প্রথমে যেটা করতাম, এই মেধাবীদেরকে ধরে রাখার জন্য। আমি প্রণোদনার ব্যবস্থা করে দিতাম এবং এদের জন্য এমন কিছু ইনসেনটিভ রাখতাম, যাতে দেশে এসে ভালো কাজ করলেই এরা এর একটা বড় রকমের বেনিফিট পেত এবং দেশে থাকত এবং দেশের উন্নয়নে সহায়তা করত।”
ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজমের শিক্ষার্থী, উপস্থাপক সাদিয়া রশ্মি সূচনা বলেন, “আমি যদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কখনো সুযোগ পাই বা নীতিনির্ধারক হওয়ার সুযোগ পাই, আমি প্রথম এই সমস্যাটির সমাধান করব যাতে অন্যান্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা আমাদের সবখানে অগ্রাধিকার পায়।
“যাতে তাদেরকে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে শহরে না আসতে হয়, তারা যাতে প্রত্যেকটা জায়গায় উপজেলা পর্যায় থেকে শুরু করে গ্রাম-নগর সবখানে সকল সুবিধা তারা নিশ্চিত করতে পারে।”
পথশিশুদের জন্য বরাদ্দের টাকা ঠিকমত ব্যয় ও তা তদারকির ব্যবস্থা করার কথা তুলে ধরে মজার স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আরিয়ান আরিফ বলেন, “আমি যদি প্রধানমন্ত্রী হতাম, তাহলে আমি যে জিনিসটা করতাম বা করতে চেষ্টা করতাম, এই পথশিশুদের জন্য এই যে টাকাটা, যেটা বরাদ্দ আছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সেটা যথাযথভাবে এমন একটা প্ল্যানিং করতাম যে, ৫-১০ বছর পরেও নিখুঁতভাবে চলবে।
“এবং আমি এমন একটা রিপোর্টিং সিস্টেম করতাম যে, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা ওই রিপোর্টি দিতে বাধ্য থাকত। এই ১০ বছরে কী ধরনের ইমপ্রুভমেন্ট পথশিশুদের জীবনে এসেছে। এবং তারা মূলস্রোতে কতটুকু যুক্ত হয়েছে। এবং দেশের যে বোঝা হত, সে কীভাবে সম্পদে পরিণত হয়েছে।”
তাদের কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমি সত্যিকার অর্থে ধন্যবাদ জানাই, অনেক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মতো যোগ্য ছেলেমেয়ে এখানে আছে।
“এই যে মানুষকে নিয়ে চিন্তা, প্রতিভা ধরে রাখার কথা, এখানে সাধারণ মানুষের সাথে মেশা এবং তাদের সুখ-দুঃখের সাথি হওয়া বা তাদেরকে সহযোগিতা করা, বা শিশুদের কথা।”
এসব বিষয়ে নোট নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “এর মধ্যে অনেকগুলো ইতোমধ্যে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।”
বিদেশে পড়তে বা চাকরি করতে যাওয়াকে মেধাপাচার হিসাবে বিবেচনা করার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি কিন্তু ব্রেইন ড্রেইনে বিশ্বাস করি না। কারণ, আমরা তো কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে পাঠাই এবং অনেকে কিন্তু বাইরে কিছু ট্রেইনিং নিয়ে আবার ফেরত আসে।
“আমি এখন অনেক তরুণ সমাজকে দেখেছি, তারা ফিরে এসেছে দেশে। যেটা আসলে ভালো হয়। একবার বাইরে গেলে মনটাও বড় হয়ে যায়। জানার সুযোগ পায়। বাইরে যাওয়াটা বন্ধ হোক, সেটা আমি চাই না। ডিজিটাল সিস্টেম, বাইরে বসেও কাজে লাগাতে পারে। সেটা তারা করবে।“
তিনি বলেন, “আমাদের ১৭ কোটি মানুষের দেশ। তরুণ সমাজ বেশি, কত আমরা তাদেরকে কাজের সুযোগ দিতে পারি। নিজেরা যে যেভাবে করতে পারে, আমাদের হবে।”
অটিজমের বিষয়ে মানুষের মনোভাব পরিবর্তনের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আগের মতো বাবা মাকে লুকিয়ে রাখতে হয় না। সমাজে একটা অবস্থান পেয়েছে। সেই ব্যবস্থাটা হচ্ছে এবং মানসিকতাটা আরও পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করি।”
অনুষ্ঠানের শেষপ্রান্তে শেখ হাসিনা বলেন, “এই সীমিত সম্পদ দিয়েই আজকে বাংলাদেশকে কেউ আর অবহেলা করতে পারে না, বরং উন্নয়নের রোলমডেল বলে। কিন্তু এই ধারাটা অব্যাহত রাখতে হবে। আর সেটা আমি এই তরুণ প্রজন্মের হাতে দায়িত্বটা দিয়ে দিচ্ছি আজকে। তোমরাই ভবিষ্যৎ, তোমরাই করবে। এবং তোমরা পারবে।”
এরপর আনন্দের আবহে এই কাজ করতে পারবে কি-না, সেই আত্মবিশ্বাস তরুণদের কাছ থেকে শুনতে চেয়ে প্রধানমন্ত্রী জানতে চান, “পারবে না বল?”
তখন সবাই সমন্বরে বলল, “পারব।”
প্রধানমন্ত্রী আবার বলেন, “বলো আমরা পারব।’”
সবাই একসঙ্গে ‘আমরা পারব’ বলার পর শেখ হাসিনা বলেন, “স্যালুট!”
আরও পড়ুন:
সবাই নিজের পায়ে দাঁড়াবে, সেই নিশ্চয়তা দিতে চাই: প্রধানমন্ত্রী