Published : 05 Jun 2025, 01:16 AM
ঈদুল আজহার বাকি আর মাত্র দুই দিন। এখনো পুরোপুরি জমেনি কোরবানির পশুর হাট। প্রতিদিন হাটগুলোতে আসছে পশু, যার বেশিভাগই দেশি গরু।
এবার হাটে সব ধরনের গরু পাওয়া গেলেও আকারে ছোট ও মাঝারি গরুর চাহিদাই বেশি।
ভারত, মিয়ানমার ও ভুটান থেকে গরু-মহিষ কম আসার কারণে দেশি গরুর এমন আধিপত্য বলে মনে করছেন অনেকেই।
ঢাকার হাটগুলোতে দেশি গরুর পাশাপাশি বিদেশি বলতে রয়েছে সংকর জাতের গরু।
পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জ ক্লাবের মাঠে পশুর হাট পরিচালনা কমিটির একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিদেশি গরু এবার হাটে নাই বললেই চলে। যা দেখছেন এগুলোর বেশিরভাগই ক্রস (সংকর), দেখতে বিদেশি মনে হয়।”
বিক্রেতারা বলছেন, হাটে গরু থাকলেও খুব একটা ক্রেতা নেই।
আর ক্রেতারা বলছেন, গত বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি দাম চাচ্ছেন বিক্রেতারা। দুই থেকে আড়াই মণ ওজনের গরুর দাম হাকা হচ্ছে ৮৫ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
বুধবার পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জ, রায় সাহেব বাজার, মুরগিটোলা, খোলাই খাল, কাঠের পুল এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, পছন্দের পশুটি কিনতে অনেকেই এসেছেন হাটে, কেউ একা এসেছেন, কেউ এসেছেন দলবেঁধে। গরু নিয়ে বিক্রেতাদের উপস্থিতি অনেক বেশি থাকলেও এখনও চোখে পড়ার মত ক্রেতা হাটে আসতে দেখা যায়নি।
দুপুরে রহমতগঞ্জ ক্লাবের পশুর হাটে গিয়ে দেখা যায়, পুরো হাটে হাতে গোনা ২০ থেকে ২৫ জন ক্রেতা। এর মধ্যে অনেকেই এসেছেন দেখতে, আবার অনেকেই এসেছেন দামদর করতে। পছন্দ হলে নিয়ে যাবেন।
এ হাটে নিজের ১২ বছর বয়সী নাতিকে নিয়ে আসেন পুরান ঢাকার বেচারাম দেউরি এলাকার বাসিন্দা আকরাম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাটে গরু কিনতে আসা তো একটা উৎসবের মতো। নাতিকে নিয়ে এসেছি, দেখি তার পছন্দ আর দামের সঙ্গে মিলে গেলে নিয়ে নেব। না হলে কাল পরশু নেব।”
চার বছর বয়সী ছেলে ও ছয় বছর বয়সী মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে হাটে আসেন ইসলামবাগের বাসিন্দা প্রবাসী লায়েকুজ্জামান।
তিনি বলেন, “ছুটিতে বাড়িতে আসছি কয়দিন আগে। বাড়ির সবাইকে নিয়ে গরু দেখতে আসছি। আজকে কিনব কি না ভাবতেছি, পছন্দ হলে নিয়েও নিতে পারি।”
কেমন গরু পছন্দ করছেন জানতে চাইলে লায়েকুজ্জামান বলেন, “আমরা ছোট সাইজের দেশি গরু নেব। ছোট গরুই নিতে হবে, কিছু করার নাই। আয় হিসাব করে ব্যয় করতে হবে।”
কেরানীগঞ্জের চড়াইল বালুর মাঠ এলাকা থেকে নদী পার হয়ে ছেলেকে নিয়ে রহমতগঞ্জে আসেন ৬৫ বছর বয়সী আব্দুল আউয়াল।
ছোট আকারের দেশি গরু দামদর করতে দেখা যায় তার ছেলেকে।
তিনি বলেন, “আমি কয়েক বছর ধরে এখান থেকে গরু নিই। আমার গোষ্ঠীর বেশিরভাগ লোকজন এই এলাকার। গরু কিনতে এসে সবার সাথে দেখা হয়। ছেলেকে নিয়ে আসছি, পছন্দ হলে নিয়ে যাব, না হলে কালকে আবার আসবো।
“দেশি মাঝারি আকারের একটা দামে দরে বনলে নিতে যাব।”
রহমতগঞ্জ ক্লাবের গরুর হাটে চারটি ছোট আকারের গরু নিয়ে এসেছেন ফরিদপুর সদরপুরের ব্যবসায়ী সোহেল মাতব্বর।
বুধবার দুপুর পর্যন্ত একটাও গরু বিক্রি করতে পারেননি তিনি।
সোহেল মাতব্বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন লোকজন আসে, দরদাম করে চলে যায়। বেচাবিক্রি এখনও শুরু হয়নি। আমার এখানে যে চারটা গরু আছে এগুলো ক্রেতারা ৬৫ থেকে ৭০ হাজার পর্যন্ত দামদর করছে। কাল পরশু দেখি। তুলনামূলকভাবে এবার গরুর দাম একটু কম যাবে বলে মনে হয়।”
এই বাজারে কুষ্টিয়া থেকে আটটি দেশি গরু নিয়ে এসেছেন আব্দুল হামিদ নামের এক ব্যবসায়ী।
তিনি বলেন, “শনিবার সকালে হাটে গরু নামছে, আজকে থেকে হয়ত বেচাকেনা শুরু হবে। আমি এই বাজারে গত আট বছর ধরে গরু নিয়ে আসি। আমার এখানে এক লাখ ৬০-৭০ হাজার টাকা দামের গরুই বেশি। লোকজন দামদর করছে, কেউ কেউ এক লাখ ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বলছে।”
কুষ্টিয়ার খাজানগর থেকে ১৮টি দেশি গরু নিয়ে এসেছেন ব্যবসায়ী নওয়াব আলী। তিনি বলেন, “আমার এখানে সবগুলোই দেশি বড় গরু। দরদাম হচ্ছে, কেউ কেউ ২ লাখ ২০ হাজার, দেড় লাখ বলছেন।”
নাটোরের সিংড়া থেকে আটটি সংকর জাতের গরু নিয়ে এসেছেন মো. বাবু।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বছর এই বাজারে প্রথম আসছি, লাভ হবে কি না বুঝা যাচ্ছে না, এখনও বেচাকেনা শুরু হয়নি। বড়টা কয়েকজন ৩ লাখের মত দামদর করেছে। আর ছোটটা ২ লাখ বলেছে।”
রহমতগঞ্জের এই হাটে গরুকে খাওয়ানোর পানির সংকটের কথা বলেছেন এই ব্যবসায়ী।
তিনি বলেন, “শনিবার রাতে এসেছি, প্রতিদিন এক একটা গরুর প্রায় আধামণ পানি লাগে। এখানে পানির খুব সমস্যা। লাইন ধরে বসে থাকতে হয়। অনেক সময় লাইনে পানি থাকে না। যার ফলে গরুকে পানি খাওয়ানো নিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।”
মেহেরপুর থেকে তিনটি গরু নিয়ে এই বাজারে দুই দিন আগে এলেও বুধবার দুপুরে একটি গরু বিক্রি করার কথা বলেছেন ব্যবসায়ী মো. সাজেদুর রহমান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিনটা নিয়ে আসছি, এর মধ্যে একটা ২ লাখে বিক্রি করেছি।”
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলা থেকে ১১টা সংকর জাতের গরু নিয়ে এসেছেন খলিলুর রহমান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের প্রত্যেকটা গরুই বড়। এখনও বিক্রি হয়নি। আমরা ৪ লাখ ৫০/৬০ হাজার টাকা চাইছি। কিন্তু তিনের উপরে এখনও উঠছে না। দেখা যাক কি হয়, আরও তো সময় আছে।”
রহমতগঞ্জ ক্লাবের গরুর হাট পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, “অন্য সময়ের তুলনায় এবার গরু খুবই কম এসেছে। প্রায় ৪০ ভাগ কম। আর বেচাকেনা এখনও শুরু হয়নি। কাল থেকে ভালোভাবে শুরু হবে।”
পুলিশের একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ও আনসারের একটি দল সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছে, বলেন তিনি।
পুরান ঢাকার সাদেক হোসেন খোকা মাঠের দক্ষিণ পাশের খালি জায়গা ও ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল এলাকায় গরুর হাট বসলেও এর বিস্তার ছড়িয়ে পড়ে রায় সাহেব বাজার মোড় থেকে শুরু করে টং মার্কেট, নারিন্দা, মুরগিটোলা, কাঠের পুল এলাকার দুই পাশের রাস্তায়।
পুরান ঢাকার ডাল পট্টি মোড়ের বাসিন্দা মো. আলিফ মিয়া তার মাকে নিয়ে আসেন নারিন্দা মোড়ের গরুর হাটে।
আলিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুই দিন ধরেই আম্মুকে নিয়ে গরু দেখতেছি। এখনও কিনতে পারি নাই। মাঝারি আকারের দেশি গরু নেব। দামে মিলতেছে না। তাছাড়া এত আগে নিয়ে গেলে বাসায় রাখাও সমস্যা।”
ওয়ারীর বাসিন্দা আবু সাইদ কয়েকটি বাড়ির মালিক। তিনি প্রতি বছর একাধিক গরু কোরবানি দিয়ে থাকেন। সব সময় বড় গরু কোরবানি দিলেও এবার মাঝারি আকারের গরুই তার পছন্দ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার তো আর পরিস্থিতি ভালো না, বেশি বড় আকারের গরু নেব না। দেখতেছি, মাঝারি আর ছোট আকারের মিলিয়ে কয়েকটা নিয়ে যাবো।’
লক্ষ্মীবাজার এলাকার বাসিন্দা মো. নাসির দুই দিন ধরেই গরুর হাটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত ৮৫ হাজার টাকা দিয়ে ছোট আকারের একটি দেশি গরু কিনে নিয়ে যেতে দেখা যায় তাকে।
নাসির বিডিনিউজ টোয়েন্টফোর ডটকমকে বলেন, “ছেলেকে নিয়ে দুই দিন ধরে হাটে গরু দেখতেছি। আজকে আমারও পছন্দ হয়েছে, তাছাড়া ছেলেও বায়না ধরেছে আজকেই নেবে, তাই নিয়ে নিলাম।”
রায় সাহেব বাজার হাটে ৬টি বড় আকারের গরু নিয়ে এসেছেন কিশোরগঞ্জের ব্যবসায়ী মো. হৃদয় মিয়া।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা আজকে সকালে গরু নামাইছি। আমাদের গুরুগুলো হলস্টেইন ফ্রিজিয়ান জাতের। এগুলো বিদেশি প্রজাতির, অনেকে অস্ট্রেলিয়ার গরু বলে। এখনও বেচাকেনা শুরু হয়নি।”
ঝিনাইদহ থেকে ১৮টি গরু নিয়ে এসে টং মার্কেট এলাকায় রাস্তার উপরে বিক্রির জন্য ক্রেতার অপেক্ষায় মো. সাইদুল ইসলাম।
একটি গরু এক লাখ ৮৫ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন জানিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখনও লোকজন দেখে দেখে চলে যায়, এর মধ্যে আমি একটি দেশি গরু বিক্রি করেছি। কাল পরশু কী হবে সেটা আল্লায় জানে।”
ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু থেকে ৪টি ছোট আকারের গরু নিয়ে এসেছেন মো. খায়রুল ইসলাম।
নারিন্দা মোড়ের রাস্তায় গরুর খাবার দিচ্ছিলেন তিনি। খায়রুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার দাম একটু কম মনে হচ্ছে। কী হবে এখনও বুঝতে পারছি না। লোকসানে তো আর বেচা যাবে না। অবশ্য সময় আছে বেচাকেনার।”
কাঠের পুল হাটে ১৩টি গরু নিয়ে এসেছেন মো. রুবেল আলী। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার গরুগুলো সবই ছোট বা মাঝারি আকারের। একটার দাম আমি বলছি এক লাখ ৩০ হাজার, কাস্টমার বলছে ৯৫ হাজার। সময় তো আছে, দেখি কী হয়।”
মুরগিটোলা মোড়ের হাটে হাসিল আদায়ের কাউন্টারে বসা আবু সালেহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেচাকেনা তো এখনও শুরু হয়নি। দুই দিন ধরে একটা দুইটা বিক্রি হয়েছে। আজকেও কয়েকটা বিক্রি হয়েছে। বিকাল থেকে বেচাবিক্রি বাড়বে। আমাদের কেনা-বেচা মূলত কাল পরশু সারা রাত হবে।”
আরও পড়ুন: