Published : 08 Oct 2024, 10:07 PM
সাইবার নিরাপত্তায় দেশের বিদ্যমান আইনটি ‘যথাযথ ও পর্যাপ্ত’ তো নয়ই বরং এর বেশিরভাগটাই ‘নিবর্তনমূলক’ বলে মত এসেছে এক আলোচনা সভায়।
মঙ্গলবার টেলিকম খাতে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন টিআরএনবি আয়োজিত এ সভায় অংশ নিয়ে তথ্য-প্রযুক্তি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বলেছেন, আইনটি সংস্কারের ক্ষেত্রে ‘সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না’ নীতিতে জোর দিচ্ছেন তারা।
আলোচনা সভার মূল উপস্থাপনায় ২০২৩ সালের সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৪২ ধারা পুরোপুরি বাতিল এবং ২১, ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩২ ধারার সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট করার সুপারিশ করা হয়।
অন্যদিকে প্রযুক্তি খাতের প্রতিনিধিরা পুরো আইনটি বাতিল করে নতুন করে আইন তৈরির দাবি জানান। তারা ডেটার নিরাপত্তার ওপর জোর দিতে বলেন। পাশাপাশি ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষা এবং বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন।
‘সাইবার নিরাপত্তা আইন: নিরাপত্তা ও বাক স্বাধীনতার ভারসাম্য কেমন?’ শীর্ষক এ আলোচনায় সরকারি নীতি নির্ধারক এবং এই খাতের ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরাও অংশ নেন।
তথ্যপ্রযুক্তি সচিব বলেন, “সাইবার সুরক্ষা আইন হালনাগাদ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা ‘সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না’ নীতিতে জোর দিচ্ছি। সুরক্ষার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বড় ইস্যু। আইনের ভাষায় নেতিবাচক কিছু আছে কি না সেটা দেখতে হবে। আইন নিবর্তনমূলক হওয়া যাবে না। সেন্সরশিপ মানে এমন নয় যেন যা বলার কথা তা আমরা বলছি না।”
তিনি বলেন, “মাত্র তিন-চার জন ব্যক্তি দিয়ে জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ (এনসিএসএ) চলছে। অথচ একে আরও শক্তিশালী করা দরকার। একইসঙ্গে নাগরিকদের নিয়ে বেশি বেশি নাগরিক সংলাপ করতে চাই। সব পক্ষের মত নিয়েই এ আইন সংশোধন করা হবে।”
বৈঠকের আরেক প্রধান আলোচক টেলিকম খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির চেয়ারম্যান এমদাদ উল বারী বলেন, “ডেটা সুরক্ষা ও তথ্য শেয়ারিং এর ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা সহজ নয়। এরমধ্যে রয়েছে ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ভেদের দ্বন্দ্ব। এর মধ্যে সবচেয় বড় চ্যালেঞ্জ বাক-স্বাধীনতার ভারসাম্য রক্ষা।”
এ ক্ষেত্রে সমাধানটা ‘নিজেদের মত করে হতে হবে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আগে বিটিআরসি কয়েক দফায় বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ করে। পরামর্শকরা উড়ে এসে তিন-চারদিন দেশে অবস্থান করে বিভিন্ন স্টেকের সঙ্গে কথা বলে একটা পরামর্শ প্রতিবেদন দিয়ে যেতেন।”
উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “এই সহস্রাব্দের শুরুতেই জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা ঢাকার যানজট দূর করার একটি প্রকল্প নিয়েছিল। তাদের অন্যতম পরামর্শ ছিল রিকশা উচ্ছেদ করা। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ঢাকা থেকে রিকশা উচ্ছেদ করে তিন দিনও তা সামলে রাখা যায়নি। তারাতো জানে না একটি রিকশা মানে শুরু রিকশা নয়, এর সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। এক পর্যায়ে তাদের সেই প্রকল্প গুটিয়ে নিতে হয়েছে।”
বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, “আমাদের কাছে একটাই শব্দ ‘সাইবার সিকিউরিটি’। একই টেবিলে বসে একজন বিজনেসম্যান, সেবাদাতা বা টেকনোক্র্যাট যখন সাইবার সিকিউরিটির কথা বলেন, তখন তিনি আসলে সিস্টেমের নিরাপত্তার, টেকনোলজির নিরাপত্তার বিষয়টিকে বোঝান।
“আবার একই টেবিলে যখন নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিকরা ‘সাইবার সিকিউরিটির’ কথা বলেন, তখন তারা সোশাল মিডিয়ার ইম্প্যাক্টকে বোঝাতে চান। একই শব্দ দিয়ে একজন বোঝাচ্ছেন কগনেটিভ ডোমেইন, আরেকজন বলছেন টেকনোলজিক্যাল ডোমেইনের কথা। এই যে ধারণাগত পার্থক্যটা রয়েছে, এটাকে যুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।”
দেশে মোবাইল ফোনের থ্রিজি প্রযুক্তি চালুর সময় বিরোধিতা এসেছিল জানিয়ে এমদাদ উল বারী বলেন, “আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে তারা খুব আবেদন জানালেন এখন থ্রিজি না আনার জন্য। কারণ হচ্ছে, তাদের সেটা নজরদারি করার সক্ষমতা ছিল না।
“এখন এই পাশে যদি ব্যবসার দৃষ্টিতে দেখেন তাহলে ওই সময় টেলিকম খাতে ১০ শতাংশ যুক্ততা বাড়লে জিডিপি এক শতাংশ বাড়ার একটা প্রমিজ ছিল। উন্নয়নের দিক থেকে আপনি যখন এই প্রস্তাবটা বিবেচনা করবেন তখন মনে হবে কী হাস্যকর। আবার ওদের সাইড (আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী) থেকে যদি দেখেন তখন মনে হয় কতো জেনুইন আসলেই তো তারা কিছু করতে পারবে না।”
এই মত পার্থক্য দূর করতে পারলে ‘একজনের দৃষ্টিভঙ্গি আরেকজনের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা’ থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন বিটিআরসি চেয়ারম্যান।
টিআরএনবির সভাপতি সমীর কুমার দের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সাইবার নিরাপত্তা আইনের নিরাপত্তা ও বাক স্বাধীনতার ভারসাম্য নিয়ে একটি উপস্থাপনা দেন সংগঠনের প্রাক্তন সভাপতি রাশেদ মেহেদী।
তিনি বলেন, “আমেরিকার জন্য নাগরিক নজরদারির অন্যতম অনুষঙ্গ ফেইসবুক। যে ডিভাইস ও ব্রাউজার ব্যবহার করি, তাও আমেরিকার। বিশ্বজুড়েই চলছে ডেটা যুদ্ধ। তাই ক্লাউড, সার্ভেইলেন্সসহ ডেটার ব্যাবসায় শতভাগ বাংলাদেশি মালিকানা থাকতে হবে।”
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুমন আহেমদ সাবির বলেন, “রাষ্ট্রীয়ভাবে তথ্যের নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আইন করে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। ক্রসবর্ডার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমাদের বৈশ্বিক জোটগুলোর সঙ্গে যুথবদ্ধতা বাড়াতে হবে। নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন পূরণে বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।”
মোবাইল অপারেটর রবির চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদুল আলম বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৬০টি ধারার মধ্যে ৩৭টিতেই অপরাধের সাজার কথা বলা হয়েছে, এখানে ১৮ ধরনের অপরাধ তৈরি করা হয়েছে।
“চারটি ধারা করায় বিভিন্ন কন্টেন্ট ব্লক করার জন্য এনটিএমসিকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। তাই ডিজিটাল নিরাপত্তার আইনের নাম পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করে সমস্যার সমাধান হবে না। এটা পুরোপুরি বাতিল করতে হবে, নতুন করে তৈরি করতে হবে।”
অন্যদের মধ্যে বিডি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কায়সার হামিদ, মোবাইল টেলিকম সেবাদাতাদের সংগঠন অ্যামটবের মহাসচিব মোহাম্মদ জুলফিকার, বাংলাদেশের সফটওয়্যার ব্যবসায়ী ও নির্মাতাদের সংগঠন বেসিসের সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির, আনোয়ার টেকনোলজিসের কো-ফাউন্ডার ও তরুণ উদ্যোক্তা ওয়াইজ আর হোসেন আলোচনায় অংশ নেন।