Published : 05 Jun 2025, 11:45 PM
কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে ১০টি বড় আকারের গরু নিয়ে গাবতলী পশুর হাটে এসেছেন আরিফুল আলম সোহেল।
হাটে গরু নামিয়েছেন রোববার; এরপর কেটে গেছে আরও চার দিন। তবে বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত শুধু একটি গরু বিক্রি করতে পেরেছেন। সময় দ্রুত কমে আসছে। এখন কী করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না।
আক্ষেপের সুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “একটা গরু দেড়-দুই লাখ টাকা দিয়ে কেনার পর লালনপালন করে খাবার খরচ মিলিয়ে যা পড়ে সেই দামও কেউ বলছে না। এখন পর্যন্ত একটি চার লাখ টাকা বিক্রি করেছি। বাকিগুলোর কী হবে বুঝতেছি না।”
নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে সোহেল বলেন, “কুষ্টিয়া থেকে গাবতলীতে গরু নিয়ে আসা, এখানে নামানোর পরও খরচ আছে। সেই খরচ ওঠাতো দূরের কথা গরুর দাম শুনেই ক্রেতারা চলে যায়। এমন অবস্থা আমার কোনো সময় হয় নাই। বাকিগুলো বিক্রির আশাই তো দেখতাছি না।”
দিনভর বৃষ্টি আর বৈরী আবহাওয়ায় গাবতলী হাটে ক্রেতা কম আসা ভুগিয়েছে তার মত বড় গরু নিয়ে আসা ব্যাপারী ও খামারিদের। তবে ঈদের ছুটি শুরুর পর বৃহস্পতিবার দুপরের আগেভাগে ক্রেতা-দর্শনার্থী বাড়তে থাকায় বিক্রেতারা আশাবাদী হয়ে ওঠেন।
তবে হাটে লোকজন বাড়লেও গরু দেখে দাম জিজ্ঞাসা করেই চলে যাচ্ছেন তারা। এতে সোহেলের মত বড় গরু নিয়ে আসা বিক্রেতারা দুর্ভাবনার মধ্যে পড়েছেন। অন্যান্যবার ঈদের দিন কয়েক আগেই বেশির ভাগ গরু বিক্রি হয়ে যায়। বলছেন, এবারের মত অবস্থায় তারা অনেক বছর পড়েননি। এবার সত্যিকার অর্থেই মাথায় হাত দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বড় আকারের গরু নিয়ে আসা পাইকার, ব্যবসায়ী, ব্যাপারী ও খামারিদের।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা গরু, মহিষ, ছাগল ও দুম্বাসহ নানা ধরনের কোরবানির পশুতে ভরে গেছে রাজধানীর গাবতলী হাট। ছুটি শুরু হওয়ায় বৃহস্পতিবার ক্রেতা-বিক্রেতাদের সরব উপস্থিতিতে সরগরম হয়ে উঠেছে রাজধানীর সবচেয়ে বড় এ হাট। বেচাবিক্রি চলবে ঈদের দিন শনিবার ভোর পর্যন্ত।
গাবতলী হাটের নির্ধারিত এলাকা ছাড়িয়ে ইট-বালু বিক্রির জায়গাতেও ত্রিপলের ছাউনি ও প্যান্ডেল খাটিয়ে গরু রাখা হয়েছে। গরু নিয়ে আসা পাইকার, ব্যবসায়ী ও খামারিরা নিজেদের গরু এসব ছাউনির নিচে বেঁধে রেখেছেন।
হাটে ঢোকার আগে থেকেই গরু আনা নেওয়ার কভার্ড ভ্যান সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। এসব ভ্যানে করে কেউ গরু বাজারে আনছেন, আবার কিনে নিয়ে বাসার পথ ধরছেন অনেকে।
বৃহস্পতিবার দুপুরের পর মূল প্রবেশপথেই ক্রেতাদের বিপুল সমাগম দেখা গেছে। কেউ পছন্দের গরু কিনে বাড়ি ফিরছিলেন, কেউবা সবেমাত্র হাটে ঢুকছিলেন। দুপুর ১২টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত কয়েকশত ক্রেতাকে পছন্দের পশু কিনে ওই ফটক দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখা গেছে।
এরমধ্যে ছোট ও মাঝারি আকারের গরু বেশি বিক্রি হতে দেখা গেছে। এগুলোর দাম ৬৫ হাজার থেকে আড়াই লাখের মধ্যে বলে ক্রেতারা জানিয়েছেন।
এই সাড়ে চার ঘণ্টায় মাত্র দুজনকে বড় আকারের গরু কিনে প্রধান ফটক দিয়ে বের হতে দেখা গেছে। এরমধ্যে আমিন বাজারের কাউদিয়া থেকে আসা চার্টার্ড অ্যাকাউটেন্ট তিন ভাইকে একটি বড় গরু নিয়ে বের হতে দেখা গেল। তাদের একজন সজীব আলম বললেন, “৪ লাখ ৪০ হাজার দিয়ে কিনেছি।”
গাবতলী হাটে বড় গরু নিয়ে আসা বিক্রেতারা বলছেন, হাট বসার পর থেকেই সাধারণত বিক্রি বাড়তে থাকে বড় গরুর। তবে এবার তেমন বিক্রি হচ্ছে না। এতে তারা লোকসানের শঙ্কায় পড়েছেন।
তাদের দাবি, গরু পালাপোষায় খরচ বেড়েছে। বড় গরুর পেছনে খরচও বেশি। অথচ ক্রেতা নেই। গরুর পরিচর্যা করে যে খরচ হয়েছে সেই টাকাই উঠবে না বলে আশঙ্কায় তারা।
মৌসুমী ব্যাপারি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, যতটা আশা করে বড় গরু নিয়ে হাটে এসেছেন, সেখানে ব্যবসা তো দূরের কথা পুঁজিও উঠবে না।
ফরিদপুর থেকে সাতটি গরু নিয়ে গাবতলী হাটে এসেছেন খামারী আব্দুল ওহাব মিয়া। তিনটি শাহিওয়াল আর চারটি ফ্রিজিয়ান (সংকর) প্রজাতের এসব গরু নিজের খামারে পেলে বড় করেছেন।
এগুলোর মধ্যে একটি সাত লাখ টাকায় বিক্রির তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, “অন্যান্য বছর আমাদের গরু বিক্রি নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা থাকে না। আমাদের গ্রাহক আলাদা। বেশির ভাগ গরু কোনো না কোনো ফার্ম-খামারের লোকজন এসে নিয়ে যায়। এবার কোনো ফার্মের লোকজন যায় নাই।
“তাই বাধ্য হয়ে বাজারে নিয়ে আসতে হয়েছে। এখন বাজারের যে অবস্থা; মনে হয় না সবগুলো বিক্রি হবে। তাছাড়া খরচ উঠবে বলেও মনে হয় না।”
মেহেরপুর থেকে ২৮টি গরু নিয়ে এসেছেন পাইকার মামুন মিয়া। বলেন, “মাত্র তিনটি বিক্রি হয়েছে, যেগুলো ছোট সাইজের- চার সাড়ে চার লাখ টাকার। বড়গুলো এখানে আনাসহ খরচই পড়েছে সাড়ে পাঁচ লাখের উপরে। কিন্তু এগুলো দেখে শুধু দাম জিগায়। কেনার গ্রাহকইতো দেখতাছি না।
“এসব গরু খামারে পেলেপুষে তো বিপদে পড়ে গেলাম, খুবই খারাপ অবস্থা।”
ঢাকার শেরাটন হোটেলের চাকরি ছেড়ে আড়াই বছর আগে কুষ্টিয়ার গাংনিতে নিজের বাড়িতে গরুর খামার দিয়েছেন রনি বিশ্বাস।
তিনি বলেন, “আমি ও বাড়ির লোকজন দিন রাত গরুর খামারে পড়ে থাকি। খাওয়া দাওয়া সব খামারেই করি। অন্যান্য বছর বড় খামারিরা আমাদের কাছ থেকে গরু নিয়ে যায়। হাটে আসতেই হয় না। এবার কেউ যায় নাই। বাধ্য হয়ে আসতে হল। এসে দেখি এসব গরুর ক্রেতা নাই।”
তিন দিন আগে ২ জুন ১০টি গরু নিয়ে এ হাটে আসার তথ্য দিয়ে রনি বিশ্বাস বলেন, “একেবারে হাতেগোনা কয়েকজন এসে দাম জিজ্ঞাসা করে কিন্তু পরে চলে যায়। এখনও একটাও বিক্রি করতে পারি নাই। আমার ছেলে মেয়েদের যেভাবে বড় করি, এই গরুগুলোকেও সেভাবেই বড় করেছি।
”এখানে গরুগুলোও অনেক কষ্ট করছে। কিন্তু বিক্রি করতে পারছি না। লস দিয়ে হলেও বিক্রি করতে হবে। আমরা তো আর ব্যবসায়ী না, যা ক্ষতি হবে সব গায়ের উপরে। বছর ধরে পরিশ্রমই বৃথা।”
মেহেরপুরের গাংনি থেকে ৯টি গরু নিয়ে এসেছেন মো. এনামুর রহমান। তিনি বলেন, “খুবই খারাপ অবস্থা। বাজারের খারাপ অবস্থা দেখে পুঁজি উঠলেই বিক্রি করে দিচ্ছি। চারটা কম দামে ছেড়ে দিয়েছি। লাভের হিসাব পরে, আগে পুঁজি উঠুক না। বড় গরু আমরা যারা তৈরি করি তাদের বিরাট খারাপ অবস্থা।”
গাবতলী পশুর হাটের দুই নং হাসিল ঘরের দায়িত্বে থাকা জাকিরুল আলম বলেন, “আজকে বেচাকেনা ভালো। তবে সব মাঝারি ও ছোট আকারের গরু। বড় গরুর হাসিল খুবই কম। শতকরা এক দুইটা।”
মিরপুর সাড়ে এগারো এর বাসিন্দা বাসিন্দা আমজাদ হোসেন গাবতলী পশুর হাট থেকে গরু কিনে হাটের হাসিল আদায় কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
এ বছর হাটে গরুর দরদাম নিয়ে নিজের সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আড়াই লাখ দাম চেয়েছিল, পছন্দ হওয়ায় এক লাখ ৭০ হাজার বনিবনা করে নিয়েছি।“
মোহাম্মদপুর থেকে আসা শেখ রাফিউল ইসলাম বড় আকারের গরুর দাম করতেছিলেন।
তিনি বলেন, “আমাদের এক ভাই ও এক বোন আমেরিকায় থাকেন। বললো বড় দেখে একটি গরু কোরবানির জন্য কিনতে। দেখি দামদর করতেছি, সাড়ে সাত লাখের মধ্যে একটা পছন্দ করে আসছি। আরও দেখতেছি।”