Published : 07 Apr 2025, 09:29 PM
কেবল সস্তা শ্রমকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুবিধা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হলেও সেই ধারণার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন।
সাবেক এই ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার বলছেন, বিনিয়োগ প্যাকেজে যেসব সুবিধা বাংলাদেশ দেয়, তা অন্য যেকোনো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সক্ষম।
“যে জায়গাটায় আমরা ব্যর্থ হই, বিনিয়োগকারী যখন আগ্রহ দেখায়, তারপর তাদের ল্যান্ড করানোর একটা প্রক্রিয়া আছে, তাকে আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যবোধটা দিতে হবে যে, আমরা যেটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, সে অনুযায়ী কাজ করতে পারব। এটাতে ব্যর্থ হই বলে অনেকে শেষমেশ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে না।”
বিডা আয়োজিত বিনিয়োগ সম্মেলনের প্রথম দিনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সোমবার বিকালে এক ব্রিফিংয়ে কথা বলছিলেন আশিক চৌধুরী।
তিনি বলেন, “এই জায়গাটা আমাদেরকে ঠিক করতে যে, আমরা যেন সরকার থেকে তাদেরকে সহায়তা দিতে পারি, যাতে শেষ পর্যন্ত তারা বিনিয়োগ করেন।”
বাংলাদেশে বিদেশিরা কেন বিনিয়োগ করতে আসবে–এমন প্রশ্নে বিডাপ্রধান বলেন, “কম উৎপাদন ব্যয়ের সুবিধা হিসেবে অনেকে আমাদের সস্তা শ্রমের কথা বলে থাকেন। আমি এ বিষয়টা ঠিক করে দিতে চাই।
“এটা সত্যি আমাদের উৎপাদনসক্ষমতার ইস্যু আছে, কিন্তু আমাদের শ্রমশক্তি প্রশিক্ষিত করার উপযোগী; গার্মেন্টস শিল্প সেটা খুব ভালোমত প্রমাণ করেছে।”
বাংলাদেশের ‘কস্ট অ্যাডভান্টেজ’ শুধু ‘সস্তা শ্রম নয়’ মন্তব্য করে চৌধুরী আশিক বলেন, “আমার কাছে একটা টেবিল আছে, আমি সুযোগ হলে শেয়ার করব- ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড- আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী যে দেশগুলো, তাদের পানির দাম, বিদ্যুতের দাম, গ্যাসের দাম, জমির দাম- বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি।
“দুয়েকটা ক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়া আমাদের সমান; আর এসব ইউটিলিটির দাম বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। একটা প্যাকেজ হিসাবে আমরা আর্থিক এবং আর্থিক নয় এমন যেসব সুবিধা আমরা দিয়ে থাকি, এটা অন্য যে কোনো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতাসক্ষম।”
বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর লক্ষ্য নিয়ে সোমবার চারদিনের বিনিয়োগ সম্মেলন শুরু হয়েছে। সম্মেলনের অংশ হিসাবে সকালে প্রায় ৭০ জন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীর একটি দল চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কোরীয় রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড) এবং মীরসরাইয়ের জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘুরে দেখেছেন।
সম্মেলনের মূল ভেন্যু ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেটালে ছিল সারাদেশের প্রায় দেড় হাজার নতুন উদ্যোগের (স্টার্টআপ) অংশগ্রহণে ‘স্টার্টআপ কানেক্ট’ নামের আয়োজন।
চার দিনের সম্মেলনের অংশ নেওয়ার জন্য ৪০ দেশের দেড় হাজার বিনিয়োগকারীর নিবন্ধনের তথ্য দিয়েছে বিডা। প্রথমদিন ২৫টি দেশের প্রায় ৭০ জন বিনিয়োগকারী ও ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট মিলিত হয়েছেন তরুণ উদ্যোক্তাদের সঙ্গে।
স্টার্টআপ কানেক্ট আয়োজনে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য ইক্যুইটি ইনভেস্ট হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে ৮০০-৯০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের পরিকল্পনার কথা জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। স্বল্প সময়ের মধ্যে এই তহবিলের পরিপত্র জারির কথা বলেন তিনি।
একইসঙ্গে, নতুন উদ্যোগে ঋণ হিসাবে বিতরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার আরেকটি তহবিল গঠনের পরিকল্পনার কথাও অনুষ্ঠানে বলেন গভর্নর।
বিনিয়োগ সম্মেলনে তরুণ উদ্যোক্তাদের ইক্যুইটি এবং ঋণ হিসাবে দেওয়ার জন্য ওষুধ কোম্পানি ইনসেপ্টার পক্ষ থেকে ১০ লাখ ডলারের অর্থায়নের ঘোষণা আসার কথা জানান প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।
আশিক চৌধুরী বলেন, “ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদেরকে আমরা এই বার্তাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি যে, সরকার থেকে আমরা সত্যিকার অর্থে সব লাল ফিতা দূর করার চেষ্টা করছি।
“স্টার্টআপ কমিউনিটিকেও আমরা একই রকম বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছি, যে আমরা শুধু ঢাকা-ভিত্তিক স্টার্টআপদের পাশেই নেই, আমরা সমগ্র দেশটাকে একেবারে তুলে আনতে চাই।”
ঢাকার বাইরের প্রকল্প বিনিয়োগকারীদের দেখানোর উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “পরিদর্শন শেষে একটা আস্থা তারা পাবেন। আমি আগেও বলেছি, বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত একদিনে হয় না। উনারা বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তা করছেন, তাই বাংলাদেশে এসেছেন।
“এই সফর করে কালকেই গিয়ে বিনিয়োগের চুক্তি সই করবেন, আমি এটাও মনে করি না। উনারা একটা ইতিবাচক ধারণা নিয়ে ফেরত যাবেন, হেড অফিসে গিয়ে বলবেন ‘আমি জায়গাটা দেখে এসেছি, জায়গাটা কাজ করছে’।”
বিডা চেয়ারম্যান বলেন, “আমাদের কাজ হবে, যে ৬০-৭০ জন গিয়েছেন, তাদেরকে পৃথকভাবে ট্র্যাক করব এখন থেকে। প্রত্যেকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব আগামী ৬ মাস, ১২ মাসে এটাকে বাস্তবিক বিনিয়োগে রূপান্তরিত করার জন্য।”
কেইপিজেডের ‘জমির জটিলতা’ যেভাবে মিটল
বিনিয়োগকারীরা সোমবার পরিদর্শনে গেলে তাদেরকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান কেইপিজেডের নির্মাণ ও পরিচালনাকারী কোরীয় কোম্পানি ইয়াংওয়েন করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সুং।
কেইপিজেডের জমির নামজারি সংক্রান্ত জটিলতা দ্রুততার সঙ্গে মিটিয়ে দেওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশংসা করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের নতুন প্রশাসনের উপর আপনারা ভরসা রাখতে পারেন।”
পরে বিকালের ব্রিফিংয়ে কেইপিজেডের প্রায় ১০ বছর ধরে ঝুলে থাকা ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ ‘দুই মাসের মধ্যে’ মেটানোর গল্প তুলে ধরেন বিডা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী।
তিনি বলেন, “কিহাক সুং বাংলাদেশের সঙ্গে অনেক নিবিড়ভাবে যুক্ত, কিন্তু বাংলাদেশ তাকে যেভাবে মূল্যায়ন করেছে, সেটা সঠিক ছিল না।
“এই রকম একটা গল্প আছে, স্যামসাংকে উনি বাংলাদেশে প্রায় নিয়েই এসেছিলেন। স্যামসাংয়ের ২২ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ যেটা ভিয়েতনামে গেছে ২০১২-১৩ সালের দিকে, ওই বিনিয়োগটা বাংলাদেশে হওয়ার কথা ছিল।”
ভূমির নামজারি সংক্রান্ত জটিলতায় সেই বিনিয়োগ বাংলাদেশে না হওয়ার কথা তুলে ধরে বিডা চেয়ারম্যান বলেন, “উনি যখন এটাকে নিয়ে এলেন, কোরিয়ান ইপিজেডের জমির নামজারি সংক্রান্ত ইস্যুটা ছিল, উনারা মনে করেছিলেন যে, এটা আপাতত কোরিয়ান ইপিজেডকে দেওয়া যাবে না, উনাদের ঝুলিয়ে রাখতে হবে, উনাদেরকে নামজারির কাগজপত্র দেওয়া যাবে না।
“স্যামসাং যখন ডিউ ডিলিজেন্স করার চেষ্টা করল, তখন দেখল যে জমির কাগজপত্র নেই; তখন বলল যে, ‘আপনি এটা কবে দিতে পারবেন?’ বললেন যে, ‘আমি বলতে পারি না, আমি আপনাকে কবে কাগজপত্র দিতে পারব’। এভাবে স্যামসাং বাংলাদেশ থেকে বাইরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।”
বিডা চেয়ারম্যান বলেন, “এই রকম অনেক ঘটনা আছে, এই রকম অনেকে আসতে চেয়েছেন, তাদেরকে আমরা সেই সহায়তাটা দিতে পারিনি।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে কিহাক সুংয়ের আলোচনার সূত্রপাতের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “উনি এসে বললেন যে, আমাকে বছরের পর বছর ধরে এটা বলা হচ্ছে, করা হচ্ছে; তুমি আমাকে যদি সঠিক উপায়গুলো দিতে পারো, আমি আরও বিনিয়োগ আনতে পারব।”
এটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বিষয় হওয়ার কারণে বিডার ভেতরে ‘প্রজেক্ট অ্যাম্বাসেডর’ নামে একটা দল গঠনের কথা তুলে ধরে আশিক চৌধুরী বলেন, “ওই টিমটার কাজ ছিল, উনি আমাদের একজন সমালোচক, তাকে আমরা কীভাবে শুভেচ্ছাদূতে পরিণত করতে পারি।
“সেখানে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের আরও কিছু লোককে যোগ করা হল। প্রধান উপদেষ্টা তার কাছে অঙ্গীকার করেছিলেন, ৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সরকার থেকে যা যা কাগজপত্র লাগে সব করে দেব। চট্টগ্রামের ডিসি থেকে শুরু করে অনেককে সম্পৃক্ত করে ঠিক ৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কেইপিজেডকে সরকারি সব কাগজপত্র বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
এ কারণে ইয়াংওয়ান চেয়ারম্যান যে সরকারের প্রতি ‘বেশ কৃতজ্ঞ’, সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “যেটা তিনি ১০ বছর ধরে বের করতে পারেননি, সেটা আমরা দুই মাসের মধ্যে করে দিয়েছি।
“আসলে সরকারের মধ্যে সদিচ্ছা থাকলে অনেক কিছু করা সম্ভব। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের অধিনস্ত বিরোধকে পাশে রেখে সরকারের ভেতরে সবাই যদি একসঙ্গে কাজ করে, তাহলে কর্মসংস্থানের যে চ্যালেঞ্জ সেটা মোকাবেলা সম্ভব।”
বিডা চেয়ারম্যান বলেন, “উনি এখন কোরিয়া থেকে ৩১ জন বিনিয়োগকারীকে ধরে নিয়ে এসেছেন বিনিয়োগ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য। এভাবে আমাদেরকে ভবিষ্যতে কাজ করতে হবে।”