Published : 29 Oct 2023, 11:38 PM
চান্দিকা হাথুরুসিংহেকে নিয়ে কম সমালোচনা হয়নি; তারপরও তার ওপরই আস্থা রেখেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। কিন্তু অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের ভাষায় ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ’ চলার মধ্যে কোচকেই ফের ভিলেন হিসেবে দেখছেন জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক এএসএম রকিবুল হাসান।
কাঙ্ক্ষিত ফল আনার জন্য খেলোয়াড়দের ‘নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায়’ এবং দলের প্রতি তাদের ‘প্রতিশ্রুতির ঘাটতির’ কারণে কোচ হিসাবে চান্দিকা হাথুরুসিংহেকে কম নম্বর দিচ্ছেন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ইনসাইড আউটে যোগ দিয়ে কোচের এমন খোলামেলা মূল্যায়ন করে এই ক্রিকেট বিশ্লেষক বলেন, “তাকে ভালো কোচ হিসাবে মূল্যায়ন করব না আমি।”
রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয় ইনসাইড আউটের এই সর্বশেষ পর্বটি।
রকিবুল হাসান বলেন, গণমাধ্যম হাথুরুসিংহেকে ‘হেডমাস্টার’ বানিয়েছে। খুব কঠোর হেডমাস্টার হওয়া দোষের কিছু নয়। তবে, তার মধ্যেও ভালো দেখাতে হয়, যত্ন নিতে হয় এবং থাকতে হবে ‘কৌশল’।
“কিন্তু বাংলাদেশের মত দলকে সামলানোর মত কৌশল তার জানা আছে কি-না, আমার সন্দেহ। বাংলাদেশ সেই রকম বিশ্বমানের দল নয় বটে, কিন্তু এর সমর্থকগোষ্ঠী বিশাল। ১৭ কোটি মানুষ খেলা সমর্থন করে, যা অন্য কোথাও দেখা যায় না।”
‘অত বড় কোচ হলে’ হাথুরুসিংহে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড বা দক্ষিণ আফ্রিকার মত দলেরই কোচ হতেন মন্তব্য করে রকিবুল বলেন, “আমি তাকে অতেটা অবমূল্যায়ন করব না। সম্মানের সঙ্গে বলছি, কোচ হিসাবে কিছু নিয়ন্ত্রণ তিনি হারিয়েছেন।”
অবশ্য সব সময় সব কিছু কোচকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তাও মনে করেন না বাংলাদেশ দলের এক সময়ের এই ওপেনার।
তিনি বলেন, “ক্রিকেটে আপনাকে সিনিয়র খেলোয়াড়দের সম্মান দেখাতে হবে এবং প্রথম দিন থেকেই অধিনায়ককে আস্থায় আনতে হবে। কারণ অধিনায়কই মাঠে বোলিং, ফিল্ডিংয়ের মত বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত নেন।”
শ্রীলঙ্কার সাবেক ক্রিকেটার হাথুরুসিংহের কোচিং ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক অ্যাসাইনমেন্ট ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ২০১৪ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের প্রধান কোচ ছিলেন।
তার কোচিংয়ে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল এবং ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে খেলেছিল বাংলাদেশ দল।
কিন্তু সেই মেয়াদের শেষ দিকে বেশ কয়েকজন সিনিয়র ক্রিকেটারের সঙ্গে হাথুরুসিংহের টানাপড়েন দেখা দেয়। সমালোচনার মধ্যে ২০১৭ সালে কোচের পদ থেকে নাটকীয়ভাবে সরে যান তিনি। ছয় বছর পর বিশ্বকাপ সামনে রেখে চলতি বছরের শুরুতে তাকেই আবার ফিরিয়ে আনে বিসিবি।
রকিবুল হাসান বলেন, “প্রথমবারও তার (হাথুরুসিংহে) সমস্যা ছিল। তিনি মাশরাফির সঙ্গে শুরু করেছিলেন। সাকিব, তামিমের সঙ্গে তার সমস্যা ছিল। মাহমুদুল্লাহর সঙ্গে তার সমস্যা ছিল, তিনি তাকে দল থেকে বাদ দিতে চেয়েছিলেন।”
এটাকে ‘ওপেন সিক্রেট’ হিসাবে মন্তব্য করে রকিবুল বলেন, “একটা দল করার জন্য আপনি যদি কোনো পরিকল্পনা করেন, তাহলে আপনার পরিকল্পনা গোপন থাকবে। কেননা, আপনাকে বুঝতে হবে, আপনার পরিকল্পনার উল্টোটাও হতে পারে। আর যদি উল্টে যায়, তাহলে পুরো দেশ আপনার পেছনে লাগবে এবং আপনার সমালোচনা করবে। সেটাই ঘটেছে।”
প্রথম দফায় দায়িত্ব পালনের মাঝপথে হাথুরুসিংহের হুট করে চলে যাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে সাবেক এই অধিনায়ক বলেন, ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে আর আসেননি কোচ, পরে পদত্যাগ করেন।
“বেশি টাকার জন্য শ্রীলঙ্কা গেলেন। কী হল? প্রকৃতির বিচার বলে একটা কথা আছে। পরে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ডে তাকে বলল, ‘চলে যাও’। যখন দল হেরে যায়, তখন তিনি অভিযোগ করলেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস এর জন্য দায়ী। আর সেটা শ্রীলঙ্কায় উত্তাপ তৈরি করেছিল।”
হাথুরুসিংহে বাংলাদেশ বা অস্ট্রেলিয়ার মত দলের জন্য ‘যোগ্য নন’ মন্তব্য করে রকিবুল বলেন, অনুর্ধ্ব ১৯ দল কিংবা প্রথম বিভাগ দলের কোচ হতে পারেন তিনি, যেখানে ‘কঠোর’ হওয়া বেশ দরকার।
“সেখানে জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করতে হবে না আপনাকে। কারণ সেখানে সবাই সমবয়সী।”
বিশ্বকাপ বাংলাদেশ দলের অবস্থা নিয়ে
বাংলাদেশকে এমন ছন্নছাড়া অবস্থায় দেখা যায়নি অনেক দিন। বিশ্বকাপে দশ দলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯ নম্বরে। এ পর্যন্ত খেলা নয় ম্যাচের পাঁচটিতেই হেরেছেন সাকিবরা, এমনকি নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও এসেছে বিব্রতকর হার।
বাংলাদেশ দলের এমন শোচনীয় অবস্থা দেখে রকিবুল হাসানও বিস্মিত। তিনি বলেন, “আমি কখনো ভাবিনি ওরা বরাবরের চেয়ে খারাপ খেলবে। এটা ঠিক যে, সব দলই বিশ্বের এই সর্বোচ্চ ও বড় ক্রিকেট প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে।
“আমার মনে হয়, কোথাও এক জায়গায় ক্লিক করছে না। যখন ব্যাটিং ক্লিক করছে, বোলিং করছে না। উপমহাদেশের অবস্থা বাংলাদেশের কাজে আসবে ভেবেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ সেই সুযোগও নিতে পারেনি।”
বিশ্বকাপে তামিম ইকবালের বাদ পড়া এবং সাকিবের সঙ্গে তার পাল্টাপাল্টি বক্তব্য এই হতশ্রী অবস্থায় ভূমিকা রেখেছে কি-না, এমন প্রশ্নে রকিবুল বলেন, ক্রিকেট মানসিক খেলা, এটা প্রভাব রাখতেও পারে।
বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশার চাপও তরুণ খেলোয়াড়দের উপর পড়তে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমাদের তরুণ দলটি অতটা অভিজ্ঞ নয়। যদি তামিম থাকত, তাহলে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন হয়ত হতে পারত।
“তবে, আমাদের অনুর্ধ্ব-১৯ দলের চার-পাঁচজন রয়েছে, দুর্ভাগ্যক্রমে তারা ক্লিক করতে পারেনি, পারফর্ম করতে পারেনি। ক্রিকেট বড় মঞ্চ, বিশ্বকাপ, হয়ত তারা সেভাবে ভালো অবস্থায় যেতে পারেননি।”
এবারের বিশ্বকাপে সাকিব কেন নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারলেন না, সেই প্রশ্নে রকিবুল বলেন, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ছিল সাকিবের বিশ্বকাপ। সেবার তার দুটি শতক, ছয় শতাধিক রান এবং বেশ কিছু উইকেট ছিল।
“কিন্তু এ বছর সে পারফর্ম করতে পারছে না। জীবনে একটা জিনিসকে আপনি পরাজিত করতে পারবেন না, সেটা হল বয়স। এটা একটা দিক।”
ক্রিকেটের বাইরের নানা কর্মকাণ্ডে জড়ানোর বিষয়টিও তার পারফর্মেন্সে প্রভাব রাখতে পারে মন্তব্য করে রকিবুল হাসান বলেন, “আপনি যদি আপনার জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বেশি সম্পৃক্ত হয়ে যান, তাহলে ক্রিকেটে আপনার ফোকাস অবশ্যই প্রভাবিত করবে। আপনি জানেন, সাকিব তারা ব্যক্তিগত বিষয়, এনডোর্সমেন্ট ও বিজ্ঞাপন নিয়ে অনেক বেশি মনোযোগী।”
এসবে ‘দোষের কিছু না থকালেও’ অধিনায়ক হিসাবে তার মনোযোগ কম থাকায় দলের ওপর প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন রকিবুল হাসান।
কলকাতায় ম্যাচের আগে সাকিবের দেশে আসায় দোষের কিছু দেখছেন না রকিবুল হাসান। তিনি মনে করেন, মাত্র আধা ঘণ্টার ফ্লাইট হওয়ার সুযোগটা দলের অধিনায়ক নিয়েছেন।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “সত্যি বলতে, এটাতে কোনো ভুল নেই। তবে, অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ হলে সে কি আসত? তার কোচের পরামর্শ নিয়ে আসতে পারত? আসা-যাওয়ার তিন দিন?
“কোনো উপায় নেই। যেহেতু পরবর্তী ম্যাচ কলকাতায়, বাংলাদেশ থেকে মাত্র আধা ঘণ্টার ফ্লাইট, সে কারণে এসে তার বিকেএসপি কোচের কাছে এসেছে।”
বিশ্বকাপে ফেভারিট কে?
রকিবুল হাসান মনে করেন, বোলিং, ব্যাটিং ও ফিল্ডিংয়ে সব দিক থেকে ভারত এবার ‘সবচেয়ে সমন্বিত দল’, তারাই ফেভারিট।
“তাদের রয়েছে বিশ্বমানের সব ব্যাটসম্যান, পেস বোলার, স্পিনার। বাঁহাতি একজন লেগ স্পিনারের কারণে ভারত আধিপত্য করছে, সে প্রত্যেক ম্যাচে উইকেট পাচ্ছে। ফিল্ডিংয়েও ভালো করছে। পাশাপাশি, ঘরের মাঠ এবং রয়েছে বিপুল সমর্থন।
“আরেকটা কারণে ভারত আমার ফেভারিট। কারণ, তারা ক্লান্ত নয়। আপনি যদি অন্য দলগুলোর দিকে তাকান, তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন।”
বড় টুর্নামেন্ট এবং নয়টি করে ম্যাচ খেলার কারণে কয়েক শহরে আসা-যাওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “মনে হয়, শুধু বাংলাদেশ ছাড়া প্রত্যেক দলের খেলোয়াড়রা বিশ্বের নানা প্রান্তে ফ্র্যান্সাইজ ক্রিকেট খেলে এসেছে।
“কিন্তু ভারত খেলোয়াড়দের বাইরের ফ্র্যান্সাইজ ক্রিকেট খেলতে দেয় না। তারা বলে, তুমি কত টাকা আয় করবে, আইপিএলে খেলে তুমি দ্বিগুণ টাকা পাবে। এবং আমি জানি, তাদের ঘরোয়া ক্রিকেটও বেশ ভালো। সুতরাং তারা এতে খুশি।”
তবে, ফেভারিটরা যে সবসময় জিততে পারে না, সেটাও স্মরণ করালেন বাংলাদেশ দলের সাবেক এই অধিনায়ক।
গতবার কোনো ম্যাচে না হেরেও সেমি ফাইনাল থেকে ভারতের বাদ পড়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “ক্রিকেট মজার খেলা। তবে আমার ফেভারিট হবে ভারত কিংবা অস্ট্রেলিয়া।”