Published : 04 Jun 2025, 12:35 PM
‘দা ওয়ান, দা ওনলি ভিরাট কোহলি’, এভাবেই সাক্ষাৎকার পর্ব শুরু করলেন ধারাভাষ্যকার ও সঞ্চালক ম্যাথু হেইডেন। গ্যালারি থেকে তখন ভেসে এলো গগণবিদারী চিৎকার। দর্শকদের আবেগ আর ভালোবাসার প্রকাশ। কোহলি নিজে তো আবেগের জোয়ারে হাবুডুব খাচ্ছিলেন ম্যাচ শেষ হওয়ার আগে থেকেই! তবু নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে হেইডেনকে তিনি শোনালেন ১৮ বছরের অপেক্ষা শেষ হওয়ার অনুভূতি, যেখানে মিশে থাকল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর প্রতি তার নিবেদন, বছরে পরবছর ধরে লড়াই ও আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা, প্রাপ্তির উত্তুঙ্গ আবেগ এবং আরও অনেক কিছু।
আইপিএলে সবচেয়ে বেশি রান, সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি, এক আসরে সর্বোচ্চ রান, আট মৌসুমে পাঁচশর বেশি রান, এমন আরও অনেক রেকর্ড আছে কোহলির। ছিল না শুধু সবচেয়ে বড় পুরস্কার। কোহলির আইপিএল ট্রফি না জেতা ছিল ভারতীয় ক্রিকেট তথা বিশ্ব ক্রিকেটেরই এক আলোচিত অধ্যায়, হাহাকারের আখ্যান। অবশেষে সেই দিনটি এলো। কোহলি আর আইপিএল ট্রফি, পরস্পরের ছোঁয়ায় ধন্য হলো।
ফাইনালে বুধবার শেষ ওভারের দ্বিতীয় বলটি যখন হলো, গাণিতিকভাবেও আর বৈধ ডেলিভারিতে জেতার সম্ভাবনা নেই পাঞ্জাব কিংসের, ক্যামেরায় কাছ থেকে ধরা হলো কোহলিকে। তার চোখে তখন চিকচিক করছে জল। আনন্দাশ্রু!
ম্যাচের শেষ ডেলিভারিটি ছক্কায় ওড়ালেন পাঞ্জাবের শশাঙ্ক সিং। কিন্তু সেদিকে কারও খেয়াল নেই। ছয় রানে ম্যাচ জিতে দ্বিগ্নিদিক ছুটতে থাকলেন বেঙ্গালুরুর ক্রিকেটাররা, মেতে উঠলেন খ্যাপাটে উদযাপনে। বুনো উদযাপনে কোহলির চেয়ে সেরা আর কে আছেন! কিন্তু এ দিন একটা পর্যায়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে মাথা মাটিতে নুইয়ে দিলেন তিনি। এক ক্যারিয়ারের প্রাপ্তি, এক জীবনের অপেক্ষা শেষ হওয়ার মুহূর্তটিতে হয়তো পেছনের সব লড়াই, হতাশার একেকটি অধ্যায়, মাথা নিচু করে মাঠ ছেড়ে যাওয়া, পরের মৌসুমে আবার নতুন উদ্যমে ফিরে আবার ট্রফি ছাড়া বিদায় নেওয়া, অনেক ঘাম ঝরানো, অনেক স্বপ্নের অপমৃত্যু, সবকিছুই হয়তো এক লহমায় উঁকি দিল তার স্মৃতিতে। সেই আবেগ ঝরল চোখ বেয়ে।
এই সুখের কান্নার জন্যই তো ১৮ বছরের অপেক্ষা!
হেইডেনের সঙ্গে কথোপকথনে অবশ্য কান্নার দমক আটকে রাখতে পারলেন। তবে হৃদয়ের আগল খুলে দিলেন।
“এই জয় যতটা দলের জন্য, ততটাই সমর্থকদের জন্য। দীর্ঘ ১৮ বছর… আমার যৌবন, সেরা সময় আর অভিজ্ঞতা, সব দিয়েছি এই দলকে। প্রতি মৌসুমেই জয়ের চেষ্টা করেছি, সবটুকু নিংড়ে দিয়েছি। অবশেষে এই মুহূর্তের দেখা পাওয়া অবিশ্বাস্য এক অনুভূতি। কখনও ভাবিনি, এই দিনটি আসবে। শেষ বলটি হওয়ার পর আবেগ উপড়ে পড়ছিল। আমার প্রাণশক্তির প্রতিটি বিন্দু ঢেলে দিয়েছি এবং এখনকার অনুভূতি অসাধারণ।”
বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে ওয়ানডে বিশ্বকাপ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও দুটি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছেন কোহলি। আইপিএলের এই শিরোপাকে তিনি রাখতে চান একই কাতারে।
সেই ২০০৮ সালে আইপিএলের শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত তিনি একই দলে খেলে যাচ্ছেন। অন্য অনেক দল থেকে অনেক অর্থের হাতছানি ছিল। বছরের বছর ট্রফি না জিতে তিনিও মাঝেমধ্যে দল ছাড়ার কথা ভেবেছেন। কিন্তু পারেননি। আটকে গেছেন এই দলের ভালোবাসার জালে। অনেকে ভুলেই যান, তার নিজের শহর আসলে দিল্লি। লোকে তাকে বেঙ্গালুরুর কোহলিই মনে করেন। তিনিও এই শহর, এই দলকে আজীবনের জন্য জায়গা দিয়েছেন হৃদয়ে।
“সত্যি বলতে, এটা (শিরোপা) শীর্ষ কাতারেই থাকবে। যেটা বললাম, গত ১৮ বছরে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছি। এই দলের প্রতি অনুগত থাকার চেষ্টা করেছি, যা কিছুই হোক না কেন। কিছু কিছু মুহূর্তে অন্যরকমও ভেবেছি। তবে শেষ পর্যন্ত এই দলকেই আঁকড়ে রেখেছি, তাদের পাশে থেকেছি, তারাও আমার পাশে থেকেছে। এই দলের হয়ে শিরোপা জয়ের স্বপ্নই সবসময় দেখেছি। অন্য যে কোনো দলের চেয়ে এখানে জেতাটাই অনেক অনেক বেশি স্পেশাল, কারণ আমার হৃদয়, আমার আত্মা মিশে গেছে বেঙ্গালোরের সঙ্গে।”
“যেমনটি বলেছি, আইপিএলে আমার শেষ দিনটি পর্যন্ত এই দলেই খেলে যাব। কাজেই এই অর্জন একদম ওপরের সারিতেই থাকবে। কারণ, একজন ক্রীড়াবিদ হিসেবে যখন কোনো কেউ লড়াই করে লেগে থাকে… এরকম তীব্র তাড়নার এত উঁচু মানের টুর্নামেন্টে, যে আসরকে এখন ক্রিকেট বিশ্বে অনেক মূল্য দেওয়া হয়… এবং আমি এমন একজন, যে সবসময়ই বড় টুর্নামেন্টে, বড় উপলক্ষ জিততে চাই… এটার শূন্যতা ছিল। আজকে রাতে আমি শিশুর মতো ঘুমাব।”
যতদিন আইপিএলে খেলবেন কোহলি, ইম্প্যাক্ট প্লেয়ার হয়ে অর্ধেক ভূমিকা রাখতে চান না। ব্যাটিংয়ের মতো ফিল্ডিংয়েও নিজের সেরাটা দিতে চান শেষ দিন পর্যন্ত। খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করার পরও অন্য ভূমিকায় এই ফ্র্যাঞ্চাইজিতে থাকার আভাস দিয়ে রাখলেন ৩৬ বছর বয়সী কিংবদন্তি।
“খুব বেশি বছর আর এই খেলাটি খেলার সুযোগ পাব না। আমাদের ক্যারিয়ারে শেষের দিনটি আসবেই। যখন পথচলা থামাব, বাড়িতে বসে এটুকু বলতে চাই যে, নিজের সবটুকু দিয়ে খেলেছি। এজন্যই সবসময় উন্নতি করা উপায় খুজি। আমি কখনোই ইম্প্যাক্ট প্লেয়ার হিসেবে খেলতে পারব না। আমি ২০ ওভার ফিল্ডিং করতে চাই, মাঠে ছাপ রাখতে চাই। সবসময় এই ধরনের ক্রিকেটারই ছিলাম এবং ইশ্বর আমাকে সেই প্রতিভা ও সে প্রেক্ষিত দিয়েছেন।”
“ইশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা, অবশেষে এই ট্রফিকে আমার আলিঙ্গনে আনার জন্য। আমি স্রেফ মাথা নিচু রাখতে চাই, বিনয়ী থাকতে চাই ও যতটা সম্ভব কঠোর পরিশ্রম করতে চাই। এরপর তো নানাভাবে দলকে সহায়তা করার সুযোগ আছেই।”
এই ফ্র্যাঞ্চাইজিতে কোহলি ছাড়াও সবসময় তারকার হাট বসেছে। কিন্তু চূড়ান্ত সাফল্য ধরা দেয়নি। এবার নিলামের পর তাদের দল নিয়ে সংশয় ছিল অনেকের। কোহলি বললেন, নিজেদের ওপর তাদের আস্থা ছিল। লক্ষ্য পূরণ করার পর তিনি কৃতজ্ঞতা জানালেন সবার প্রতি।
“এই ম্যানেজমেন্ট, এই ক্রিকেটাররা অসাধারণ। উপযুক্ত ধরনের ক্রিকেটার, ম্যাচ জেতানোর ক্রিকেটার আছে এই দলে, যারা খেলাটাকে এগিয়ে নেয়। নিলামে অনেকেই আমাদের কৌশল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু নিলামের দুই দিন শেষে আমরা খুশি ছিলাম আমাদের প্রাপ্তি নিয়ে। এই দলের শক্তিমত্তায় বিশ্বাসের কমতি ছিল না আমাদের।”
“এই দলকে বিরাট কৃতিত্ব দিতে চাই। তাদের কাউকে ছাড়া এটা সম্ভব হতো না… সেরা একাদশ, বাইরের সবাই, ম্যানেজমেন্ট সবসময় পাশে থেকেছে ক্রিকেটার, কঠিন সময়ে সবাইকে ইতিবাচক রেখেছে। এই সাফল্য সবার। এখানে দাঁড়িয়ে শুধু নিজের কথা বলব না। আমাকে নিয়ে অনেক বলা হয়েছে এর মধ্যেই। এই জয় বেঙ্গালোরের জন্য, প্রতিটি ক্রিকেটার, তাদের পরিবার ও পুরো ম্যানেজমেন্টের জন্য।”
কথোপকথনের শেষে হেইডেন বললেন, “এভাবেই মাঠের ভেতরে-বাইরে আমাদের হৃদয় রাঙিয়ে যাচ্ছেন…।” এর চেয়ে উপযুক্ত কথা আর বুঝি হয় না!