Published : 26 May 2025, 12:32 PM
শনিবার বিকেলে ট্রেন্ট ব্রিজে শোয়েব বাশিরকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে উইকেট হারান সিকান্দার রাজা। একটু পরই অলআউট হয় দল, ইনিংস ব্যবধানে হেরে যায় জিম্বাবুয়ে। সতীর্থরা যখন পারফরম্যান্সের কাটাছেঁড়া নিয়ে ব্যস্ত, রাজার আশ্চর্য ভ্রমণের তখন শুরু। তাকে লাহোরে পৌঁছতে হবে পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) ফাইনাল শুরুর আগে!
এমনিতে এই ফাইনাল খেলার কোনো সম্ভাবনা ছিল না রাজার। ফাইনালের দিনটি তো ইংল্যান্ড-জিম্বাবুয়ে টেস্টের চতুর্থ দিন! তবে টেস্ট ম্যাচ শেষ হয়ে গেল তিন দিনেই। রাজা শুরু করলেন নতুন অভিযান।
পিএসএল ফাইনাল শুরু হতে তখন ২৪ ঘণ্টারও কম সময় বাকি। নটিংহ্যাম থেকে এক বন্ধুর গাড়ীতে চড়ে তিনি ছুটলেন বার্মিংহামের পথে। নিকটস্থ বিমানবন্দর সেখানেই। বিজনেস ক্লাসের কোনো টিকেট ছিল না বিমানে, ইকোনমি ক্লাসেই খুশি মনে দুবাইয়ের পথে উড়াল দিলেন রাজা। সেখানে ছয় ঘণ্টার বিরতি।
দুবাই থেকে আবার গাড়ীতে তিনি রওনা হলেন আবু ধাবির পথে। লাহোরের ফ্লাইট সবচেয়ে কাছাকাছি ছিল সেখানেই। গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে যখন পিএসএল ফাইনালের টস হলো, রাজা তখনও মাঠে নেই। লাহোর বিমানবন্দর থেকে তখন তিনি মাঠের পথে। তবে লাহোর কালান্দার্সের একাদশে তাকে রাখা হয়েছে ততক্ষণে।
টসের মিনিট দশেক আগে বিমানবন্দরে নেমে টসের পর মাঠে আসা সেই রাজাই শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠলেন ফাইনালের শেষ সময়ের রাজা। লাহোরের রুদ্ধশ্বাস জয়ের নায়ক!
রাজাকে পাওয়া যাবে কি না, এই অনিশ্চয়তায় দুটি একাদশ তৈরি রেখেছিল লাহোর। একটিতে ছিলেন রাজা, অন্যটিতে রাজার জায়গায় সাকিব আল হাসান। বিমান ঠিক সময়ে লাহোরে আসায় এবং সব প্রক্রিয়া দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হওয়ায় রাজাকে নিয়েই মাঠে নামতে পারে লাহোর।
বল হাতে রাইলি রুশোর গুরুত্বপূর্ণ উইকেট নেন রাজা। পরে ছয় নম্বরে যখন ব্যাটিংয়ে নামেন, ম্যাচ তখন লাহোরের প্রায় নাগালের বাইরে। জয়ের জন্য ২০ বলে প্রয়োজন ছিল ৫৭ রানের। বোলিং করছিলেন কোয়েটা গ্ল্যাডিয়েটর্সের সেরা বোলার মোহাম্মাদ আমির।
তবে ক্রিজে গিয়ে প্রথম বলেই আমিরকে চার ও পরের বলে ছক্কায় রাজা জানিয়ে দিলেন, ম্যাচ এখনই শেষ নয়!
পরের দুই ওভারে ঝড় তুললেন কুসাল পেরেরা। খুররাম শাহজাদকে দুটি ছক্কা মারলেন তিনি, ১৯তম ওভারে আমিরের বলে মারলেন দুটি চার ও একটি ছক্কা। সমীকরণ চলে এলো নাগালে।
শেষ ওভারে প্রয়োজন ১৩ রানের।
প্রথম তিন বলে এলো পাঁচ রান। বাকি তিন বলে যখন প্রয়োজন আট রান, ফাহিম আশরাফের বলে অসাধারণ এক শটে ডিপ পয়েন্টের ওপর দিয়ে ছক্কা মেরে দিলেন রাজা। পরের বলটিতেই চার মেরে হুঙ্কার ছুড়লেন তিনি, মেতে উঠলেন খ্যাপাটে উদযাপনে। তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে বাধঁনহারা উল্লাসে মেতে উঠল সতীর্থরা।
৭ বলে অপরাজিত ২২ রান। ২০২ রান তাড়ায় ৬ উইকেটে জিতে যায় লাহোর কালান্দার্স। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ফাইনালে সবচেয়ে বেশি রান তাড়ার রেকর্ড এটিই।
নিয়তিই যেন ঠিক করে রেখেছিল, রাজার হাত ধরে ট্রফি জিতবে লাহোর!
ফাইনাল জয়ের পর রাজা শোনালেন তার রোমাঞ্চকর অভিযানের গল্প।
“আমি এখানে এসেছিলাম কিছু করতে এবং ইশ্বর না করুক, আজকে যদি আমরা হেরেও যেতাম, অন্তত নিজের মনের ভেতর আমি জানতাম যে এই সময়ে আমার ভাইদের পাশে ছিলাম। আমাদের স্বত্বাধিকারীরা ও অধিনায়ক গত ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টায় যা যা করেছেন, আমি জানি যে, আমার দল কতটা মরিয়া হয়ে আমাকে এখানে চাইছিল। সত্যি বলতে, এটা অবিশ্বাস্য।”
“কালকের আগের দিন ২৫ ওভার বোলিং করেছি (ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টে), কালকে ২০ ওভার ব্যাটিং করেছি। ডিনার করেছি বার্মিংহামে, ব্রেকফাস্ট দুবাইয়ে, গাড়ীতে করে আবু ধাবিতে পৌঁছে লাঞ্চ করেছি, বিমানে উঠেছি, এরপর আবার ডিনার লাহোরে। একজন পেশাদার ক্রিকেটারের জীবন এরকমই এবং আমি সত্যিই আপ্লুত ও ধন্য এই জীবনটা পেয়ে।”
টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই লাহোর কালান্দার্সে ছিলেন রাজা। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে টুর্নামেন্ট স্থগিত হলে দেশে ফিরে যান। আবার যখন আসর শুরু হয়, ইংল্যান্ড-জিম্বাবুয়ে টেস্ট শুরু হতে তখন স্রেফ চার দিন বাকি। এর মধ্যেও পাকিস্তানে ফিরে একটি ম্যাচ খেলেন তিনি, যে ম্যাচ জিতে প্লে-অফে জায়গা করে নেয় লাহোর। এরপর এই নাটকীয়ভাবে তার ফাইনালে খেলা।
রাজা বললেন, ব্যাট হাতে ক্রিজে গিয়ে সব ভাবনা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলেছিলেন তিনি।
“চেষ্টা করেছি আবেগটাকে দূরে রাখতে। টেস্ট ম্যাচটি এবং এখানে আসার পথে গোটা ভ্রমণ আমাকে একদিক থেকে সহায়তাও করেছে, কারণ মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রায় নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিলাম। মাঠে নেমে নিজেকে স্রেফ বলছিলাম, ‘বলে চোখ রাখো, ব্যস।’ মাথা একদম ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। বল কোথায় থাকতে পারে, আমি কী করব, এসব কোনো অনুমান করছিলাম না বা ভাবছিলাম না। শুধু মাথায় ছিল, বল যেখানেই থাকুক, সেরা শটটি খেলতে হবে।”
দলের শিরোপা জয়ের পাশাপাশি ব্যক্তিগত প্রাপ্তিও ছিল রাজার। টুর্নামেন্টের সেরা অলরাউন্ডারের পুরস্কার জেতেন তিনি।
পরে তিনি লাহোর কালান্দার্সের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আবার শোনালেন অকল্পনীয় সেই ভ্রমণের গল্প।
“আমার এই ফাইনাল খেলার পেছনের গল্প অবিশ্বাস্য। একটু আগেই আরেকটি সাক্ষাৎকারে বলেছি, ভেবে দেখুন, নটিংহ্যাম থেকে দেড় ঘণ্টা ড্রাইভ করে বার্মিংহামে গিয়েছি, ডিনার করেছি সেখানে, ওখান থেকে দুবাইয়ে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করেছি, গাড়ীতে করে আবু ধাবিতে গিয়েছি, কারণ পরের ফ্লাইট ছিল সেখান থেকেই, সেখানে লাঞ্চ করেছি, সেখান থেকে লাহোরে উড়ে এসেছি।”
“ফ্লাইট বিমানবন্দর ছুঁয়েছে ৬টা ৫০মিনিটে (টস ছিল সাতটায়)। সামিন ভাই (স্বত্বাধিকারী সামিন রানা) ও শাহিন (অধিনায়ক শাহিন শাহ আফ্রিদি) যখন জানতে পেরেছে, আমি বিমানবন্দরে পৌঁছেছি, একাদশে তখন আমাকে রেখেছে, ড্রেসিং রুমে এসেছি ৭টা ২০ মিনিটে (খেলা শুরু সাড়ে সাতটায়), দ্রুত পোশাক বদলেছি, সৌভাগ্যবশত খেলার আগে জাতীয় সঙ্গীতের সময় থাকতে পেরেছি এবং খেলার প্রথম বল থেকে শেষ বল পর্যন্ত দলের সঙেগ থাকতে পেরেছি। এই ফাইনাল খেলার পছনের গল্প তাই অবিশ্বাস্য, যা আমি মনে রাখব অনেক দিন।”