Published : 10 Mar 2025, 12:22 PM
সঞ্চালক হার্শা ভোগলে বললেন, “…দারুণ একটি অ্যাওয়ার্ড এটি…।” সেই কথা শুনে হাতে ধরে রাখা ট্রফিতে তাকালেন রাচিন রাভিন্দ্রা। কিন্তু কোনা ভাবান্তর হলো বলে মনে হলো না। নিউ জিল্যান্ডের এই সময়ের সেনসেশন বললেন, “ব্যক্তিগত স্বীকৃতি অবশ্যই দারুণ, তবে…।”
তবে, দলীয় প্রাপ্তির ওপরে কিছু নেই। সেই কথাটিও পরে বললেন রাভিন্দ্রা। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট হয়ে মোটেও মন ভরেনি তার। তিনি চাইছিলেন সত্যিকারের ট্রফি, চ্যাম্পিয়ন হলে দল যেটি পায়!
রোববার রাত দুবাইয়ে ফিরে এলো যেন ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল শেষে লর্ডসের সেই রাত। সেবারও ফাইনাল হেরে গিয়েছিল নিউ জিল্যান্ড। পরে মলিন মুখে টুর্নামেন্ট-সেরার পুরস্কার নিয়েছিলেন কেন উইলিয়ামসন। সেই ফাইনালের মতো রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ হয়নি এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে। তবে কিউইরা লড়াই করেছে সাধ্যমতো। অতৃপ্ত মনে টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার নিয়েছেন রাভিন্দ্রা।
অথচ এই আসরের প্রথম ম্যাচটি তিনি খেলতে পারেননি। প্রস্তুতি টুর্নামেন্ট হিসেবে যে ত্রিদেশীয় সিরিজটি আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানেই ক্যাচ নিতে গিয়ে কপালে চোট পেয়ে মাঠের বাইরে ছিলেন তিনি। পরে মাঠে ফেরেন তিনি দলের দ্বিতীয় ম্যাচ দিয়ে। বাংলাদেশের বিপক্ষে সেদিন প্রিয় পজিশন টপ অর্ডারে ব্যাট করতে পারেননি। তবে চারে নেমেই উপহার দেন ম্যাচ জেতানো ১০৫ বলে ১১২ রানের ইনিংস।
পরের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে আউট হয়ে যান ৬ রানে। সেমি-ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং আক্রমণ কচুকাটা করেন ওপেনিংয়ে ১০১ বরে ১০৮ রানের ইনিংস খেলে। ফাইনালেও শুরু করেছিলেন দারুণ। তবে কুলদিপ ইয়াদাভের দুর্দানত এক ডেলিভারি তাকে থামায় ২৯ বলে ৩৭ রানে।
চার ম্যাচ খেলে আসরের সর্বোচ্চ ২৬৩ রানতার, ৬৫.৭৫ গড়ের পাশে স্ট্রাইক রেট ১০৬.৪৭। বল হাতে ওভারপ্রতি স্রেফ ৪.৬৬ রান দিয়ে নিয়েছেন তিনটি উইকেট। এর মধ্যে সেমি-ফাইনালে এইডেন মার্করাম, ফাইনালে রোহিত শার্মার গুরুত্বপূর্ণ উইকেট ছিল। ম্যান অব দা টুর্নামেন্টের লড়াইটা ছিল একরকম একতরফাই।
তবে ফাইনালে দলের পরাজয়ে নিজের এই প্রাপ্তি বড় কোনো আনন্দের উপলক্ষ আসেনি তার জন্য।
“অবশ্যই অম্ল-মধুর স্বাদ… দুর্দান্ত এক ফাইনাল ছিল… ফাইনালে আসার পথে আমরা দারুণ ক্রিকেট খেলেছি… আজকের ম্যাচ ভালো হয়েছে, ভারতকে অভিনন্দন।”
“ব্যক্তিগত এসব স্বীকৃতি অবশ্যই দারুণ। তবে দুর্দান্ত একটি দলের হয়ে খেলছি, এটা ছিল খুবই উপভোগ্য।”
টুর্নামেন্ট-সেরার ট্রফি হাতে নিয়ে ২৫ বছর বয়সী প্রতিভাবান এই ক্রিকেটারের আক্ষেপ অন্য ট্রফির জন্য।
“সত্যিকারের ট্রফিটা পেলে সোনায় সোহাগ হতো। তবে এটা তেমনই একটা ব্যাপার, ক্রিকেট কখনও কখনও এমন নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে।”
দল না পারলেও বিশ্বমঞ্চে নিজের প্রতিভা আর সামর্থ্যের প্রমাণ আরও একবার দিয়েছেন রাভিন্দ্রা। ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি চমকে দিয়েছিলেন তিন সেঞ্চুরি ও দুই ফিফটিতে ৫৭৮ রান করে। এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেঞ্চুরি করলেন দুটি। নিউ জিল্যান্ডের ইতিহাসে আইসিসি টুর্নামেন্টে তিনটির বেশি শতরান নেই আর কোনো ব্যাটসম্যানের।
বৈশ্বিক আসরে যেখানে অনেক বড় ক্রিকেটারও অনেক সময় খেই হারান, রাভিন্দ্রা সেখানে ক্যারিয়ারের শুরুতেই দারুণ উজ্জ্বল। তিনি অবশ্য খুব কৃতিত্বের কিছু দেখাতে চাইলেন না এখানে।
“জানি না (বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে ভালো করার কারণ)… হয়তো স্রেফ খুব ভালো উইকেটে খেলতে পারছি বলেই…। তবে এই ধরনের টুর্নামেন্টে খেলতে পছন্দ করি আমি। কারণ টুর্নামেন্টের আগে যে ধরনেরকাজ করা হয় এবং আরেকটি ব্যাপার, সবার একটিই লক্ষ্য থাকে, সবসময় প্লে-অফ বা নকআউটে যেতে চায় সবাই, ফাইনাল খেলতে চায়। এসব ব্যাপার উপভোগ করি আমি।”
২০২৩ বিশ্বকাপে তিনি গিয়েছিলেন আনকোরা এক তরুণ ক্রিকেটার হিসেবে। দলে চোট-সমস্যা না থাকলে একাদশেও সুযোগ হতো না তার। সেই টুর্নামেন্ট রাঙানোর পর এখন দলের অপরিহার্য অংশ তিনি। যদিও অভিজ্ঞতা তার এখনও কম। তবে এই ধরনের টুর্নামেন্টে তরুণ আর অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের পার্থক্য দেখেন না তিনি।
“আমি তা বলব না। আমার মনে হয় স্কোয়াডের সব সদস্য, ১৫ জনেরই কিছু না কিছু ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। ব্ল্যাক ক্যাপস স্কোয়াডের দারুণ ব্যাপার এটিই। এখানে প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটার বা নবীন বলে তেমন কিছু নেই। আমাদের আবহের সৌন্দর্যই এটি। আমরা তাই স্রেফ মাঠে নেমে চেষ্টা করি নিজেদের কাজ করতে ও দলে অবদান রাখতে। এগিয়ে চলার পথে অবশ্যই অভিজ্ঞতা বাড়ে এবং এই ধরনের পরিস্থিতিতে আরও বেশি সহায়তা করা যায়।”
প্রতিভা, পারফরম্যান্স, টেম্পারামেন্ট, মানসিকতা, সব দিক থেকেই বলা যায় কেন উইলিয়ামসনের বিদায়ের আগেই বিশ্ব ক্রিকেটকে আরেকটি রত্ন উপহার দিয়েছে নিউ জিল্যান্ড। টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুটাও দারুণ হয়েছে তার। গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২৪০ রানের ইনিংস খেলছেন মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে। ভারত সফরে গত অক্টোবরে খেলেছেন ১৪০ রানের আগ্রাসী ইনিংস। সব ঠিকঠক থাকলে নিউ জিল্যান্ডের হয়ে আরও অনেক বছর আলো ছড়াতে দেখা যাবে তবে।
তার শেকড় অবশ্য ভারতে। এটি নিয়েও আলোচনা হয়েছে নানা সময়ে দেদার। তার বাবা-মা, দুজনই ভারতীয়। বাবা রাভি কৃষ্ণমূর্তিও ছিলেন ক্রিকেটার। বেঙ্গালুরুতে ক্লাব ক্রিকেট খেলেছেন জাভাগাল শ্রীনাথের মতো তারকার সঙ্গে। বেঙ্গালুরুর অনেক ক্রিকেট তারকাই তার বন্ধু। তবে ক্রিকেটে তিনি বেশিদূর এগোতে পারেননি। বরং মন দেন সফটওয়ার সিস্টেম আর্কিটেক্ট হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ায়।
সেই ক্যারিয়ারই রাভিকে নিয়ে যায় ইংল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়ায়। নানা দেশ ঘুরে শেষে তিনি থিতু হন নিউ জিল্যান্ডে। ১৯৯৯ সালে রাভিন্দ্রার জন্ম সেখানেই, ওয়েলিংটনে। বেড়ে উঠেছেন সেখানকার ক্রিকেট কাঠামোয়। অনেকবারই তিনি বলেছেন, নিজেকে পুরোদস্তুর নিউ জিল্যান্ডের একজনই মনে করেন তিনি। তবে শেকড়ের প্রতি সম্মানের কথাও বলেন সবসময়। এবার ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট হয়েও তার কণ্ঠে সেই কৃতজ্ঞতার সুর।
“সবসময়ই বলি, অতীত নিয়ে আমি গর্বিত। এত এত মানুষকে ধন্যবাদ জানানোর আছে, এখন বলতে গেলে ঘণ্টাখানেক সময় লেগে যেতে পারে। চলার পথে আমাকে যারা সহায়তা করেছেন, সবার প্রতিই কৃতজ্ঞ।”