Published : 22 Dec 2024, 08:48 AM
দুটি সুইমিংপুল নির্মাণ, পার্ক ঘিরে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে দ্বন্দ্ব, সুইমিংপুল দুটি ভাঙা, নতুন প্রকল্প গ্রহণ- সব মিলে পেরিয়ে গেছে এক যুগ। অবশেষে আবার সবার জন্য খুলতে চলেছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের জাতিসংঘ পার্ক।
নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে তিনমাস আগেই। কিন্তু পার্ক পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় দীর্ঘায়িত হচ্ছে অপেক্ষা।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরীর প্রাণকেন্দ্রের একটি পার্ক ঘিরে উন্নয়নে এভাবে এক যুগ পার হওয়া ‘খুবই দুঃখজনক’। পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে এমন ‘টানাপড়েন’ নজিরবিহীন। এতে শিশু-কিশোররা বঞ্চিত হয়েছে চরমভাবে।
অবিলম্বে জনবল নিয়োগ করে পার্কটি নগরবাসীর জন্য উন্মুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা গণপূর্ত অধিদপ্তর বলছে, প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ হলে মাসখানেক পর খুলে দেওয়া যাবে পার্কটি।
চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রে ৬৯ একর আয়তনের পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকাটি গণপূর্ত অধিদপ্তরের দায়িত্বে। ১৯৫৪ সালে আবাসিক এলাকাটির জন্য জমি বরাদ্দ দেয় সংস্থাটি। এর মাঝে ২ দশমিক ১৭ একর আয়তনের ওই উদ্যানের নাম শুরুতে ছিল ‘পাঁচলাইশ পার্ক’।
১৯৮৮ সালে মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী মেয়র থাকাকালে গণপূর্ত অধিদপ্তর সংস্কার ও ব্যবস্থাপনার জন্য পার্কের দায়িত্ব দেয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হাতে। ২০০২ সালে সেসময়ের মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী পার্কের নাম দেন ‘জাতিসংঘ পার্ক’।
আর পরের মেয়র মনজুর আলমের মেয়াদে ২০১২ সালে সিটি করপোরেশন পার্কে দুটি সুইমিংপুল ও একটি জিমনেশিয়াম নির্মাণ শুরু করলে সেখানে জনসাধারণের চলাচল বন্ধ থাকে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সুইমিংপুল নির্মাণ শেষ হলেও সেটি খুব বেশিদিন ব্যবহার হয়নি।
পরের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ২০১৬ সালে বেসরকারি এক কোম্পানির কাছে পার্কটি ইজারা দিতে চাইলে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। তারপর সিটি করপোরেশন ও গণপূর্তের দ্বন্দ্বে আরো কয়েক বছর গড়িয়ে যায়। তখন থেকে পার্কটি অব্যবহৃত ছিল।
এভাবে অব্যবহৃত পড়ে থাকায় পার্কের ভিতর জমেছিল আবর্জনা। মাঠ জুড়ে ছিল বড় বড় গর্ত। এক পর্যায়ে পার্কটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
সবশেষ ২০২২ সালে ১২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পার্কটির আধুনিকায়নে ‘জাতিসংঘ সবুজ উদ্যান’ প্রকল্পটি হাতে নেয় গণপূর্ত অধিদপ্তর।
ওই প্রকল্পের আওতায় ভূমি উন্নয়ন শেষে মাঠের মাঝখানে তৈরি করা হয় একটি দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা। পার্কের চারপাশ ঘিরে তৈরি করা হয় ২৯৪০ বর্গফুট হাঁটার পথ (ওয়াকওয়ে)।
স্থাপন করা হয়েছে বসার জন্য ৪৪টি বেঞ্চ, দুটি প্রবেশপথ, শিশু-কিশোরদের খেলার সরঞ্জাম, ব্যয়ামের জন্য হরাইজন্টাল বার ও মেটাল পেরগোলা, ড্রেনেজ সিস্টেম, ডাস্টবিন, টয়লেট ব্লক, আলোকায়নের জন্য কম্বাইন্ড লাইট ও স্ট্রিট লাইট, সিসিটিভি ক্যামরা, সোলার পাওয়ার সিস্টেম ও বজ্রনিরোধক।
এছাড়া পার্ক জুড়ে নতুন করে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ও ঘাস লাগানো হয়েছে। এতে একসময়ের পরিত্যক্ত হয়ে পড়া পার্কটি আবার যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
জানতে চাইলে গণপূর্ত ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের চট্টগ্র্রাম অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুল হাসান খান (সার্কেল-১) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পার্কের নির্মাণ কাজ শেষ। গত ২৮ নভেম্বর উপদেষ্টা মহোদয় দেখে গেছেন। পার্ক চালু করতে জনবল অনুমোদন চেয়ে আমরা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি।
“পার্ক চালু করলে আমাদের গার্ড ও মালি প্রয়োজন হবে। তিন শিফটে চারজন করে মোট ১২ জন গার্ডের প্রয়োজন হবে। জনবল নিয়োগ শেষে পার্ক চালু করতে মাসখানেক লাগতে পারে। পার্কটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।”
নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি আশিক ইমরান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটি খুবই দুঃখজনক যে প্রায় গত এক যুগ পার্কটি ব্যবহার উপযোগী ছিল না। এত বড় শহরে শিশু-কিশোরদের জন্য একটি পার্কও এখন খোলা নেই। এখন প্রস্তুত হওয়ার পরও জনবলের অভাবে পার্কটি খোলা যাচ্ছে না, সেটাও দুঃখজনক।
“সিটি করপোরেশন যে সুইমিং পুল নির্মাণ করেছিল, সেই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। পার্ক ওভাবে হয় না। পার্কে হাঁটাচলা ও নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য খোলা জায়গা থাকতে হয়। গণপূর্ত অধিদপ্তরের নকশাটি ভালো হয়েছে। দ্রুত জনবল নিয়োগ করে এটি সবার জন্য খুলে দেওয়া উচিত।”
পাশাপাশি পার্কের ভেতরে কোনো দোকান যেন বরাদ্দ দেওয়া না হয় সেই দাবি জানিয়ে স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, “এতে পার্কের পরিবেশ নষ্ট হবে।”
শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরীর সংগঠক প্রকৌশলী রূপক চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিশুদের উপযোগী উন্মুক্ত স্থান শহরে নেই বললেই চলে। পার্কে সুইমিং পুল নির্মাণ করে সরকারি অর্থের অপচয় করা হয়েছে।
“গণপূর্ত যদি অতীতে এই পার্কের আধুনিকায়ন করত, তাহলে অনেক কম খরচে তা করা সম্ভব হত। সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতায় সাধারণ মানুষের করের টাকা খরচ করেও এতদিন পার্কটি কেউ ব্যবহার করতে পারেনি। এক যুগ আগে যারা শিশু ছিল, তারা এখন বড় হয়ে গেছে। নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্তহীনতায় একটা প্রজন্ম খেলাধুলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।”
এই পার্কটি অবিলম্বে খুলে দেওয়ার পাশাপাশি শিশুদের উপযোগী খেলার মাঠ ও পার্কগুলো দ্রুত ব্যবহারোপযোগী করতে উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানান তিনি।
পুরনো খবর