Published : 21 Oct 2022, 11:25 PM
চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ আয়োজিত গণশুনানিতে বর্ধিত গৃহকর কমাতে সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগের কর্মীদের বিরুদ্ধে ঘুষ দাবির অভিযোগ তুলেছেন নগরীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা।
শুক্রবার বিকেলে নগরীর কদমতলি মোড়ে করদাতা সুরক্ষা পরিষদের আয়োজনে ‘গলাকাটা হোল্ডিং ট্যাক্স বাতিলের দাবিতে’ এই গণশুনানি হয়।
গণশুনানিতে ১৫ জন করদাতা গৃহকর নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন। তাদের দাবি আগের তুলনায় ৫ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে আগের হোল্ডিং ট্যাক্স দিতেই হিমশিত খাচ্ছেন জানিয়ে তারা বলেন, নতুন হারে কর দেওয়া ভবন মালিকদের পক্ষে অসম্ভব।
মোগলটুলী এলাকার বাসিন্দা মো. আবু তাহের গণশুনানিতে বলেন, “৮৫৫ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট আছে আমাদের। ভবনটি নির্মিত হয়েছে দুই বছর আগে। এই ফ্ল্যাটের জন্য গৃহকর নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৮ হাজার টাকা।
“চা-পানি খেতে ১৭ হাজার টাকা দিলে, হোল্ডিং ট্যাক্স কমিয়ে ৩০-৩৫ হাজার টাকা করে দেওয়ার আশ্বাস দেন সিটি করপোরেশনের মহসিন নামে এক কর আদায়কারী।”
ওই টাকা দিতে রাজি হননি বলে শুনানিতে জানান মো. আবু তাহের।
আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকায় একটি চারতলা ভবনের মালিক মো. মোজাম্মেল হোসেন শুনানিতে বলেন, “চারতলার চারটি ইউনিটের জন্য গৃহকর নির্ধারণ করেছে ৩ লাখ ১৪ হাজার টাকা। অথচ আগে ছিল ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।
“কিন্তু চুক্তি করলে এটা ১ লাখ টাকা করার আশ্বাস দেন সিটি করপোরেশনের রাজস্ব শাখার সুজন নামের একজন কর্মচারী। এরজন্য ঘুষ দাবি করেন ওই কর্মচারী। এতে রাজি না হওয়ায় হোল্ডিং ট্যাক্স কমানোর বিষয়টি ঝুলে আছে।”
রামপুর ওয়ার্ডের সবুজবাগ এলাকার বাসিন্দা মো. খুরশীদ আলম বলেন, “এক কাঠা জমিতে আমাদের পৈতৃক দোতলা বাড়ি। ওপরের তলা আবার টিনের ছাদ। বর্ষার সময় নিচের তলা পানিতে ডুবে যায়।
“তাই তিন ভাইয়ের কেউ নিচ তলায় থাকে না। এই রকম বাড়ির জন্য ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা গৃহকর নির্ধারণ করা হয়েছে! এটা দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না।”
গত বছরের সেপ্টেম্বরে নগরীর আগ্রাবাদে নালায় পড়ে মারা যান ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া। তার নানা হাজী জামাল শুনানিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “সিটি করপোরেশন গলাকাটা ট্যাক্স নিচ্ছে। কিন্তু মানুষের নিরাপদ যাতায়াত ও হাঁটাচলার জন্য কোনো কিছু করছে না।
“আমার নাতনির মৃত্যুর দায় সিটি করপোরেশন ও সিডিএ একে অপরের ঘাড়ে চাপাচ্ছে। অথচ নালার পাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিলে আমার নাতনির মৃত্যু হত না।”
গণশুনানিতে অতিথি সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আকতার কবির চৌধুরী বলেন, “বর্তমান মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী চট্টগ্রামের জন্য বিপজ্জনক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। উনার আশপাশে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজরা বসে আছেন। মেয়র তাদের সুরক্ষা দিচ্ছেন।”
করদাতা সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি নুরুল আবছারের বিরুদ্ধে মেয়রের একান্ত সহকারীর করা মামলার সমালোচনা করেন আকতার কবির বলেন, “সহ্য ক্ষমতা না থাকলে চেয়ার ছেড়ে দেন। ভাড়ার ওপর ধার্য করা হোল্ডিং ট্যাক্স বাতিল করে আয়তনের ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে।”
শুনানিতে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান বলেন, “কয়েকজন অভিযোগ করেছেন ঘুষ দেওয়ার পর গৃহকর কমে। বাস্তবে তাই ঘটছে। হোল্ডিং ট্যাক্সের নামে সিটি করপোরেশনের লোকজন ভবনমালিকদের হয়রানি করছেন।
“এদিকে হোল্ডিং ট্যাক্স কমাতে হলে আপিল করতে বলছেন মেয়র। এভাবে নগরবাসীকে হয়রানি না করে আয়তনের ভিত্তিতে গৃহকর নেওয়া হোক।”
ডা. সুশান্ত বড়ুযা বলেন, “গৃহকর বাড়লে শুধু ভবনমালিকেরা চাপ পড়বে না, ভাড়াটিয়ারাও চাপে পড়বে। তাই সবাইকে সোচ্চার হতে হবে এর বিরুদ্ধে। তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
করদাতা সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি নুরুল আবছারের সভাপতিত্বে গণশুনানিতে আরও বক্তব্য দেন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি সুভাষ বড়ুয়া, আইনজীবী ভুলন ভৌমিক। গণশুনানি সঞ্চালনা করেন করদাতা সুরক্ষা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহম্মদ আমির উদ্দিন ও সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর জান্নাতুল ফেরদৌস।
গৃহকর নিয়ে বর্তমান কার্যক্রম বাতিলের দাবিতে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গণ মতবিনিময় সভা, স্থানীয় সরকারমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।
হোল্ডিং ট্যাক্স কমাতে ভবন মালিকদের কাছ থেকে ঘুষ দাবির বিষয়ে সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কেউ ঘুষ দাবি করলে উচিত ঘুষ চাওয়া ব্যক্তিকে আটকে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে খবর দেওয়া।
“২০১৭-১৮ সালে যে অসঙ্গতিপূর্ণ হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করা হয়েছে সে কথা সত্য। সেটা কমিয়ে নগরবাসীর আয়ত্তের মধ্যে আনতেই আমি ইতোপূর্বে আপিল বোর্ড করে দিয়েছি। কেউ ঘুষ চাইলে কেন দেবেন? কোনো লেনদেন করবেন না। প্রয়োজনে আপিল বোর্ডের কাছে যাবেন।”
মেয়র রেজাউল করিম বলেন, “আয়তনের ভিত্তিতে হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ হলেও তা প্রত্যাশিত পর্যায়ে কমবে না। সে চেষ্টা অতীতে একবার হয়েছিল। কারো ১০ হাজার টাকার গৃহকর ২ লাখ টাকা হলে আপিলে যেন তা ১৫ বা ২০ হাজার টাকা হয় সে নির্দেশনা আমি দিয়েছি। এটা সহনীয় পর্যায়ে আনতেই আমার উদ্যোগ।
“যথযাথ প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়া মুখের কথায় হোল্ডিং ট্যাক্স কমে যাবে না।”