Published : 03 Jun 2025, 01:29 AM
আগামী বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় কাটছাঁট করে ঘাটতি কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হলেও সরকারি কর্মচারীদের জন্য ‘বিশেষ সুবিধা’ নাম দিয়ে বরাদ্দ রেখেছে অন্তবর্র্তী সরকার।
অর্থনীতি যখন ‘চাপে’ রয়েছে তখন এই ব্যয়কে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ বলছেন অর্থনীতিবদরা।
প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৬২ শতাংশের সমান।
সোমবার বেলা ৩টায় আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। চলতি অর্থবছরের চেয়ে যা ৭ হাজার কোটি টাকা কম।
তবে প্রস্তাবিত এই ব্যয় বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের (৭ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা) চেয়ে ৬.১৮ শতাংশ বেশি। টাকার ওই অংক বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১২.৬৫ শতাংশের সমান।
বিদায়ী অর্থবছরে বিগত সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর দেওয়া বাজেটের আকার ছিল ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের ১১.৫৬ শতাংশ বেশি এবং জিডিপির ১৪.২৪ শতাংশের সমান।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় কমানো হয়েছে ৩৫ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা। এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা।
উন্নয়ন ব্যয় কামানোর মধ্যে শুধু বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) খাতেই চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়েছে কমেছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। আর সংশোধিত এডিপির চেয়ে কমেছে ১৪ হাজার কোটি টাকা।
বিদায়ী অর্থবছরে এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। সংশোধন করে তা ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।
আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে কয়েকটি মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়। যার মধ্যে কয়েকটি শেষ হলেও কাজ চলমান রয়েছে কয়েকটির।
সে প্রসঙ্গ টেনে উন্নয়ন ব্যয়কে ‘গতানুগতিক’ মন্তব্য করে বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এডিপির কিছু প্রকল্পে তো অর্থায়ন করা হবে না। সুযোগও নাই। কিছু তো বাদ দিতে হবে, গুরুত্ব না থাকায়। যা কমানো হয়েছে তা খুব একটা তাৎপর্যপূর্ণ না।”
এবারের বাজেটে যেমন নতুন মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়নি, তেমনি পুরনোগুলোর চাপ কামায় উন্নয়ন ব্যয় সরকার কমাতে পেরেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ সাইফুদ্দিন খান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মেগা প্রকল্পের পেছনে তো খরচ কমে গেছে। অনেক প্রকল্পে সরকার এখন অর্থায়ন হয়ত করবে না, তাই উন্নয়ন ব্যয় কম হবে।”
উন্নয়ন ব্যয় বেশি হওয়া মানেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়ে দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ে। বাজেটে তা কমিয়ে আনায় কর্মসংস্থান বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় প্রভাব পড়ার শঙ্কা থেকে যায়।
তবে উন্নয়ন ব্যয়ে দুর্নীতি, অনিয়মগুলো সামাল দিতে পারলে কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়বে না মন্তব্য করে সাইফুদ্দিন খান বলেন, “যেকোনোভাবেই হোক দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। অনিয়ম না হলে, উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারলে সমস্যা হবে না।”
মোটা দাগে বাজেটে সর্বোচ্চ ব্যয় হয় পরিচালন খাতে। আসছে অর্থবছরের বাজেটে তা ২৮ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা।
বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয় ছিল ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। আর সংশোধিত পরিচালন ব্যয়ের আকার দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা।
সরকারি কর্মচারীদের জন্য মহার্ঘ ভাতা নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য না দিলেও তাদের জন্য ‘বিশেষ সুবিধার’ পরিমাণ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, “২০১৫ সালের পর কোনো বেতন কাঠামো না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করছি।”
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “এবারের বাজেটে পরিচালন ব্যয়ে উত্তরাধিকারের প্রভাবটাই সবচেয়ে বেশ, এই ব্যয়টা প্রশ্নবিদ্ধ। এছাড়া ব্যয় খাতে কোনো চমক দেখা যায়নি।”
সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতার পেছনে ব্যয় বৃদ্ধির সমালোচনা করেছেন সাইফুদ্দিন খানও। অর্থনীতি ‘স্বাভাবিক ছন্দে’ না ফেরায় কিছুটা ‘সংকট’ তো রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সরকার পরিচালন ব্যয় কমাতে পারতো। এই সময়ে পরিচালন ব্যয় বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল না। দুর্ভোগে তো সবাই আছে, শুধু সরকারি কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো আরো পরে করা যেত।”
প্রস্তাবিত বাজেট ঘাটতি গত ১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। এর আগে ২০১০-১১ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ছিল ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।
এর পর থেকে বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের উপরে রাখে একধারে তিন মেয়াদে সরকারে থাকা আওয়ামী লীগ।
বিদায়ী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
গত মার্চে তা সংশোধন হলে ঘাটতি দাঁড়ায় ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ শতাংশের সমান।
আগামী অর্থবছর শেষে ব্যয়ের পুরো অংশ বাস্তবায়ন করলে জিডিপির আকার দাঁড়াবে ৬২ লাখ ৪৪ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা।
ঘাটতির পূরণ কোথা থেকে?
বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৪ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্য ধরে আগের বারের চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা খরচের প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাস্তবায়ন অগ্রগতি দেখে মার্চে চলতি অর্থবছরের বাজেট ৫৩ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে সংশোধন করে, যার আকার দাঁড়ায় ৭ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা।
আসছে অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ শতাংশ।
অভ্যন্তরীণ অন্য উৎসের মধ্যে সরকার ব্যাংক খাত থেকে নিতে চায় ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এছাড়াও সঞ্চয়পত্র থেকে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার ২১ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
ঘাটতি পূরণে বিদেশি উৎস থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে চায় সরকার।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে বৈদেশিক ঋণ খাতে ধরা হয়েছিল ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। সংশোধনের পর যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৮ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
বিদায়ী অর্থবছরে যত ঋণ
বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটে অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। সংশোধন করে কিছুটা কমিয়ে ধরা হয় ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা।
এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ধরা হয়, যা সংশোধনের পর কমে হয় ৯৯ হাজার কোটি টাকা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আনা ও সরকারি অর্থ খরচ কমিয়ে আনতে ব্যাংক ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এতে সরকারের ব্যাংক ঋণ নেওয়া কমে যায় আগের অর্থবছরের তুলনায়।
এ কারণে গত জানুয়ারি থেকে সরকারের ব্যাংক ঋণ কমে যেতে শুরু করে। হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে গত ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সরকার ব্যাংক থেকে ৪২ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা ঋণ নেয় সরকার, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৪৩ শতাংশ। আগের অর্থবছরের এই সময়ে ৪৬ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা নিয়েছিল সরকার।