Published : 01 Jun 2025, 11:39 PM
নতুন অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনার উদ্যোগকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে দেখলেও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এখনও ‘স্পষ্ট নয়’ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, ঘাটতি কমাতে সরকারের পরিচালন ব্যয়ে লাগাম টানার সুযোগ নেই বললেই চলে। আবার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) হাত দিলে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
ফলে রাজস্ব আদায় বাড়ানোকে ঘাটতি কমানোর ‘সবচেয়ে ভালো উপায়’ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। কিন্তু রাজস্ব বাড়াতে হলে আহরণের সক্ষমতা বাড়াতে হবে সরকারকে। সেটা করতে না পারলে ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যটা অধরাই থেকে যেতে পারে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের ঘাটতি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার, যা গত ১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
বাজেট ঘাটতি সবশেষ ৪ শতাংশের নিচে ছিল ২০১০-১১ অর্থবছরে; ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। এর পর থেকে প্রতিটি বাজেট ঘাটতি ছিল ৫ শতাংশের বেশি।
এবার বাজেটের আকার আগেরবারের প্রস্তাবিত বাজেটের চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকায় রাখার আভাস মিলেছে। তাতে ঘাটতি ধরা হচ্ছে প্রায় সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা।
ঘাটতিটা কমবে কোথায়
বাজেট ব্যয়ের একটা বড় অংশ যায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ সরকারের পরিচালন ব্যয়ে। এ ব্যয় কমানো যে কঠিন, সে কথা সংবাদমাধ্যমে বলেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরীও তাই মনে করেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘সরকারের পরিচালন খরচ কমানো একটু কঠিন। কারণ খরচের প্রায় সবটুকু যায় বেতন-ভাতায়। এবার মহার্ঘ ভাতাও বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে। তাই অপচয় কমানো বা খরচ কমানোর বেশি চাপ যাবে এডিপিতে।’’
এডিপির সঙ্গে অবকাঠামো উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের বিষয়টি উঠে আসে। সেই বাস্তবতায় এডিপির আকার কমিয়ে বাজেট ঘাটতি শূন্যে নামিয়ে আনার প্রভাব অর্থনীতিতে কতটা পড়বে এবং কীভাবে পড়বে, সেটা বিশ্লেষণ করাটা জরুরি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তবে প্রকল্প নেওয়ার আগে এর উপযোগিতা এবং অর্থের সংস্থান নিয়ে ভাবলে এডিপিতেও ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন কেউ কেউ।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান মনে করেন, “বাজেট ঘাটতি যা ধরা হচ্ছে, যতটুকু জানতে পেরেছি, ঠিকই আছে। তবে উন্নয়ন ব্যয় বাস্তবায়ন ও দারিদ্র্যের হার কমানোর মত বিষয়গুলো নিয়ে সরকার কী ভাবছে, তা বাজেটে স্পষ্ট করা প্রয়োজন মনে করছি।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাজেট ব্যয়ের কৌশলে সরকার কোন কোন খাতে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে, তা স্পষ্ট থাকাটা জরুরি।’’
বাজেট ব্যয় ও এডিপির আকার কমিয়ে আনার সঙ্গে বাস্তবায়ন সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট জাহিদ হোসেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এই সরকারের তো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের প্রকল্প নেই। তাই আয় অনুযায়ী ব্যয় করার বাজেট দেওয়ারও সুযোগ ছিল। জানি, সেটা করবে না। আমি চাইব ঘাটতি বাজেট না দেওয়া।’’
তিনি বলেন, ‘‘শুধু প্রকল্প নিলেই তো হবে না। বাস্তবায়ন সক্ষমতা কতটা বাড়ল, এসব প্রকল্পের আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল কিনা, তাও বিবেচনার দাবি রাখে। রাজনৈতিক সরকার তো অনেক প্রকল্প নিয়ে কত কাণ্ড ঘটিয়েছে, তা সংবাদমাধ্যমে দেখেছে সবাই।’’
শুধু বাস্তবায়ন ও অর্থায়নযোগ্য প্রকল্প নিয়ে উন্নয়ন বাজেট সাজাতে পারলে বাজেটের আকার ৯০ হাজার কোটি টাকার মত কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন।
বাড়াতে হবে রাজস্ব আদায়
জুলাই অভ্যুত্থানের আগে-পরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেশ লম্বা সময় স্থবিরতা ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ১০ মাস পার হলেও সেই স্থবিরতা কাটেনি।
পোশাক শ্রমিকদের বকেয়া-বেতন ভাতার আন্দোলন সামলাতে সরকারকে সেনাবাহিনী নামানোসহ টাস্কফোর্স গঠন করতে হয়।
শ্রমিক অসন্তোষ থামতে না থামতেই সচিবালয় ও শাহবাগসহ রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক দখল করে আন্দোলন-সংগ্রাম লেগেই আছে।
নির্বাচন ও রাষ্ট্র সংস্কারসহ নানা বিষয়ে বিভাজন প্রকট হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে।
এমন প্রেক্ষাপটে নতুন অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
এখানে রাজনৈতিক অচলাবস্থা না কাটলে সরকারের ব্যাংক ঋণ ফের বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখছেন জাহিদ হোসেন।
তার ভাষায়, ‘‘পরিচালন ব্যয় তো বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। মাস গেলে বেতন দিতেই হবে। আপনি চাইলে প্রকল্প অর্থায়ন স্থগিত রাখতে পারেন। তাই রাজস্ব আদায় কম হলে সরকারকে ঋণ করতেই হবে।’’
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, রাজস্ব আদায় চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭১ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে রয়েছে। ঘাটতিতে থাকলেও আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি সোয়া তিন শতাংশের মত।
পুরো অর্থবছরে এনবিআরকে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয় ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের মাঝপথে তা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি করা হয়।
গত ১০ মাসে রাজস্ব আদায় হয় ২ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আদায় হয় ২ লাখ ৪৯ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা।
ব্যাংক ঋণের কী হবে
ঘাটতি অর্থায়নে বরাবরই সরকারকে ব্যাংকমুখী হতে হয়। এবার এ খাত থেকে জোগান ধরা হচ্ছে সোয়া লাখ কোটি টাকা। বাকিটার জোগানে নির্ভর করতে হচ্ছে বিদেশি অর্থায়নের ওপর।
রাজস্ব আদায় পরিকল্পনা মাফিক না এগোলেই ব্যাংক ঋণের চাপ বেড়ে যায় সরকারের। গত কয়েক বাজেটে সে প্রবণতাই দেখা গেছে।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। সংশোধন করে কিছুটা কমিয়ে ধরা হয় ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা।
এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ধরা হয়, যা সংশোধনের পর কমে হয় ৯৯ হাজার কোটি টাকা।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আনা ও সরকারি অর্থ খরচ কমিয়ে আনতে ব্যাংক ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
এতে গত জানুয়ারি থেকে সরকারের ব্যাংক ঋণ কমে যেতে শুরু করে। হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে গত ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সরকার ব্যাংক থেকে ৪২ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা ঋণ নেয় সরকার, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৪৩ শতাংশ।
আগের অর্থবছরের এই সময়ে ৪৬ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা নিয়েছিল সরকার।
বন্ধ করতে হবে করছাড়
সরকারকে ঘাটতি কমাতে করহার না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ তৌফিকুল ইসলাম খান।
তিনি বলেন, “অনেক খাত এখনও কর ভর্তুকি বা কর ছাড় পায়। সাধারণ মানুষের এসব টাকা এনবিআর কীভাবে ছাড় দেয়?
“সরকার তো সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ঠিকই সব কর নিচ্ছে। তাহলে ব্যবসায়ীদের কেন এত ছাড় দিতে হবে! কিছু খাত অনেক দিন ধরেই সুবিধা নিচ্ছে। সেসব খাতকে সুবিধা দেওয়া বন্ধ করতে পারলে সরকারের কর আদায় বেড়ে যাবে।”
আইএমএফের ঋণ চুক্তিতেও করছাড় কমিয়ে শূন্যে নামিয়ে আনার শর্ত রয়েছে।
২০২৩ সালে তৈরি করা এনবিআরের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু এক অর্থবছরেই আয়কর, ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক, আমদানি শুল্ক ও আবগারি শুল্ক মিলিয়ে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৪১০ কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হয়।
জাহিদ হোসেন বলেন, “এটা জনগণের টাকা। কিন্তু সরকার ছাড় দিয়ে কোনো শিল্প খাতকে দাঁড় করাবে, এটা ঠিক আছে। অর্থনীতিতে এর প্রয়োজনীয়তাও আছে। কিন্তু প্রশ্নটা হল, আপনি কাকে কতদিন ছাড় দিচ্ছেন।’’
সবচেয়ে বেশি করছাড় দেওয়া হয় ভ্যাট খাতে। এজন্য আইএমএফ করছাড় বন্ধের পাশাপাশি এসব বিষয় জাতীয় সংসদে তোলার পরামর্শ দিয়েছে।
ঋণচুক্তি বাস্তবায়নে সরকার ইতোমধ্যেব্যবসায়ীদের করছাড় পর্যায়ক্রমে তুলে নেওয়ার আভাস দিয়েছে।
এলডিসি থেকে উত্তরণে ২০২৭ সালের শেষ দিকে কর ছাড় সুবিধা পুরোপুরি তুলে নেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের।
করছাড় সুবিধা দীর্ঘদিন চলতে পারে না মন্তব্য করে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘‘নতুন কিছু খাতকে সুবিধার আওতায় আনা যেতে পারে সাময়িক উৎসাহ দেওয়ার জন্য। কিন্তু এগুলো কখনোই চিরকাল থাকবে না। শুধু এই দীর্ঘদিন ধরে ছাড় সুবিধা বন্ধ করলেই বাজেট ঘাটতি থাকবে না।”
এতে সরকারের আর্থিক খাতেও শৃঙ্খলা ফিরবে বলে মনে করেন তিনি।