Published : 12 May 2024, 04:32 PM
দিনের শুরুতে যে টানা বর্ষণ হয়েছিল, তার ছাপ ছিল বিকেলেও। রাজধানীর কোথাও কোথাও রাস্তাঘাটে তখনো জমে ছিল পানি। তবু এই শহরের নানা প্রান্ত থেকে নানা বয়সের অনেক মানুষ জড়ো হলেন পূর্বাচলে, ‘একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে’ গানের স্রষ্টা অঞ্জন দত্তের টানে।
কোলাহল ছেড়ে শুক্রবার অঞ্জন দত্তের কনসার্ট' আয়োজন করা হয় পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে–সংলগ্ন ৩০০ ফিটের ঢাকা অ্যারেনার সবুজ পরিবেশে। যৌথভাবে অ্যাসেন, জির্কুনিয়ামি ও আর্কলাইট ইভেন্টস ‘অঞ্জন দত্ত মেট্রোপলিস ভলিউম-২.০’ নামের ওই কনসার্টের আয়োজন করে।
এই আয়োজনের উদ্দেশ্য অঞ্জনের ‘তোমার জংলা পাড়ের ঢাকেশ্বরী শাড়ি’ গানের চরিত্র ‘মালার’ জন্মদিন উদযাপন।
গানে গানে অঞ্জনের দেখা পেতে কনসার্টের মাঠ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পর্যন্ত ভক্তরা দাঁড়িয়ে ছিলেন লাইন ধরে।
সেই দীর্ঘ সারিতে নজর কাড়ে কালো রঙের টি-শার্ট পরা ১১ তরুণ। যাদের টি শার্টে অঞ্জন দত্তের গিটার হাতে একটি ছবি, নিচে লেখা ' তুমি আসবে বলে তাই’।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই ১১ বন্ধুর বেড়ে ওঠা অঞ্জনের গানকে সঙ্গী করে। ঢাকায় অঞ্জনের কনসার্ট অনেকবার হলেও তাদের এই প্রথম আসা।
১১ বন্ধুর মধ্যে একজন গ্লিটজকে বললেন, প্রথমবারের মত সরাসরি অঞ্জনের গান শুনবেন, তাই দারুণ রোমাঞ্চিত তারা।
সন্ধ্যা ৭টায় আহমেদ হাসান সানির গান দিয়ে শুরু হয় আয়োজন। মঞ্চে উঠে সানি গাইলেন ' আমারে উড়াইয়া দিও' গানটি। এরপর আরো ঘণ্টাখানেক নিজের আরো কয়েকটি গান করেন সানি।
সানির পর মঞ্চে ওঠার কথা ছিল 'ব্যান্ড কাকতাল' এর। কিন্তু হঠাৎ ঘোষণা আসে, মঞ্চে আসবেন অঞ্জন। তখন ঘড়িতে রাত ৮টা ৪০। দলবল নিয়ে মঞ্চে এলেন অঞ্জন দত্ত। তখনো কনসার্ট মাঠে দর্শকরা ঢুকছেন। কারণ অনেকের ধারণা ছিল, শেষ দিকে এসে কেবল অঞ্জনের গানই উপভোগ করবেন।
মঞ্চে অঞ্জন এবং তার দলের অন্যান্য সদস্য নীল দত্ত (অঞ্জনের ছেলে), অমিত দত্ত, দেবপ্রতিম ও প্রশান্ত যে যার জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে যান। সাধারণত অঞ্জন মঞ্চে গিটার হাতে দাঁড়িয়ে গাইতে পছন্দ করেন। কিন্তু চেয়ারে বসে অঞ্জন জানালেন, তিনি অসুস্থ, তাই বাধ্য হয়ে চেয়ারে বসে গাইবেন।
“আমার শরীরটা বেশি ভালো না, জানেন; কলকাতা থেকে ঢাকা আসার আগে ডাক্তার ডেকে একটা ইনজেকশন নিয়ে এসেছি, স্টেজে ওঠার আগেও একটা ইনজেকশন নিলাম। আমি আজ গাইতে আসতাম না। আপনাদের কথা দিয়ে রেখেছি, তাই এই শরীর নিয়েই চলে এলাম। আমি উঠে দাঁড়িয়ে গান গাইতে পারব না, আমি এই চেয়ারটাতেই বসে শুরু করলাম।"
গান শুরুর আগে চলচ্চিত্র পরিচালনার গুরু মৃণাল সেনকেও স্মরণ করেন অঞ্জন। বলেন, "আমি অন্তত কৃতজ্ঞ, আপনাদের সকলের কাছে, আপনারা এতদিন ধরে আমাকে ভালোবেসে এসেছেন, কিন্তু আমার কোনো কিছুই সম্ভব হত না যদি না একটা লোক আমার জীবনে আসত। যে লোকটা এ দেশের ফরিদপুরে জন্ম নিয়েছিলেন। সে মানুষটির নাম মৃণাল সেন৷ তার একশতম জন্মদিন এবং তাকে উৎসর্গ করে আমি সিনেমা বানিয়েছি।
“আমি আর নীল দুইজনের পয়সা দিয়ে সিনেমাটা করেছি মৃণালদার জন্য। এবং এই সিনেমাটা আমার ইচ্ছেমত একইদিনে একই সময় বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষে মুক্তি দিয়েছি। হইচই প্ল্যাটফর্মে সিনেমাটি আপনারা দেখবেন। মৃণালদাকে উৎসর্গ করে এই সিনেমায় একটি গান লিখেছিলাম, সেই গানটি দিয়ে শুরু করলাম।"
তারপর অঞ্জন গাইলেন মৃণাল সেনকে নিয়ে বানানো সিনেমা 'চালচিত্র এখন' এর 'এই পোড়া শহরে' গানটি। পরের গান 'স্যামসন'।
এরপর শিল্পী বলে উঠলেন, “আসলে বুঝতেই পারছেন, আমি উঠতে পারছি না, ঝুঁকে সামনে যেতেও পারছি না। আমার ভালো লাগছে আপনারা হাত তালি দিচ্ছেন, আমি কৃতজ্ঞ।“
অঞ্জন আরও গাইলেন দার্জিলিং নিয়ে লেখা ‘খাদের ধারের রেলিংটা’, ‘রঞ্জনা’, ‘আমি বৃষ্টি দেখেছি’ এবং ‘মালা’।
তারপর গাইলেন 'ম্যারিঅ্যান', 'তবুও এমন সকাল আসবে'।
এই দুটো গানের পর গায়ক আবারও দর্শকের উদ্দেশে বললেন, “আমি কালকে সেরে যাব, কিন্তু আপনাদের তো আর কাল পাব না।“
এ কথা বলেই শুরু করলেন বেলা বোসকে নিয়ে তার বিখ্যাত গান 'এটা কি ২৪৪১১৩৯' গানটি। এই গানে দর্শকদের মধ্যে দারুণ সাড়া পড়ে যায়। অনেকে অঞ্জনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইতে থাকেন।
এই গান শুরু করার পর দর্শকের উচ্ছ্বাস বেড়ে যায়। শেষ করে পাঁচ মিনিটের বিরতি নিয়ে স্টেজ থেকে নেমে যান অঞ্জন।
যাওয়ার আগে তিনি বলেন, "বাংলাদেশে এসে আমি যখন গান শুরু করি, নীল দত্ত আমার ছেলে তখন অনেক ছোট ছিল, এখন নীল আমার পাশে বসে গান গাইতে পারে। আমাদের দুজনের একটা অ্যালবামও বের হয়েছে। আপনারা তার গান শুনন কিছুক্ষণ।"
নীল দত্ত শুরু করলেন 'বন্ধু' গানটি দিয়ে, এরপর গাইলেন আইয়ুব বাচ্চুর 'সেই তুমি, কেন এত অচেনা হলে?'
নীলের গাওয়া শেষ হতেই ফের মঞ্চে আসেন অঞ্জন। ঢাকাকে নিয়ে অঞ্জন গাইলেন, ' চোখের জল কিম্বা পানি', 'চ্যাপ্টা গোলাপ ফুল', 'আমি বৃষ্টি দেখেছি'।
পুরো কনসার্ট জুড়ে চোখ খুলে তাকাতে পারেননি অঞ্জন দত্ত। চোখ বন্ধ করে গেয়েছেন তিনি। অসুস্থতায় চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। তবুও গান দিয়ে মঞ্চে দর্শক বুঁদ করে রেখেছেন রাত ১০টা ৪৮ পর্যন্ত।
ব্যান্ড ‘কাকতাল’ এর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে অঞ্জন বলেন, “আমি কাকতালের প্রতি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব, কারণ তাদের জায়গাটা তারা ছেড়ে দিয়ে আমাদের দিয়েছে। তাই এই গানটি কাকতালের জন্য।“
‘কাকতাল’র জন্য অঞ্জন গাইলেন 'রঞ্জনা আমি আর আসব না'। তারপর একে একে গাইলেন 'এখনও তাই', 'দার্জিলিং', 'তবু যদি তুমি আসতে চাও', 'কত কিছু করার ছিল যে'।
তারপর গাইলেন মালাকে নিয়ে ‘তোমার জংলা পাড়ের ঢাকেশ্বরি শাড়ি’, যে গান বেঁধে দুই বাংলার দর্শকদের অঞ্জন মাতিয়ে রেখেছেন সেই কত বছর ধরে।
‘মালা’ গানেও কণ্ঠ মেলান দর্শক। সবাই ভেবেছিল অঞ্জন বুঝি ‘মালা’ গেয়ে মঞ্চ ছাড়বেন। কিন্তু এই গানটি করে মালার জন্মদিনের কেক কাটেন অঞ্জন।
তারপর বলেন, “এবার আমায় একটু রিলিফ দেন। বেশি পাওয়া একদম কিন্তু ভালো নয়।“
তবুও চলে না গিয়ে দর্শক অনুরোধে তিনি গাইলেন, “আজ হোক না রং ফ্যাকাসে আমার আকাশে, চাঁদের হাসি যতই হোক না”। গান শেষ হতে মঞ্চ থেকে নেমে যান অঞ্জন দত্ত।
রাত ১১ টার পর মঞ্চে পারফর্ম করে ‘কাকতাল’, তারা গায় 'কিছু নেই', 'চরকি' সহ আরও কয়েকটি গান।