Published : 08 Jun 2025, 08:28 PM
মানিক থেকে সত্যজিৎ রায় হওয়ার দীর্ঘ পথপরিক্রমায় যিনি এই কিৎবদন্তী নির্মাতার সঙ্গে থেকেছেন ছায়ার মত, তিনি সহধর্মিনী বিজয়া রায়। তিনি সত্যজিতের প্রতিটি কাজে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন এই দম্পতির ছেলে পরিচালক সন্দীপ রায়।
সত্যজিতের বহু সিনেমার পাত্র-পাত্রীকে খুঁজে বের করা, নায়িকাকে সাজানো, তাদের তাদের জুতসই পোশাক ও অলংকার জোগাড় করা সব দায়িত্ব সামলাতেন বিজয়া।‘পথের পাঁচালী’ করার সময় সত্যজিত টাকার অভাবে পড়লে নিজের সব গহনা বন্ধক রেখে স্বামীকে অর্থের যোগান দেন তিনি।
এমনকি শুটিংয়ে কোথায় কী প্রয়োজন সবকিছুর দেখভাল করতেন তিনি। কেবল তাই নয় সত্যজিৎ রায়ের কোনো সিনেমার চিত্রনাট্য লেখার পড়ে প্রথম পাঠক ছিলেন বিজয়া। নিজের পছন্দ–অপছন্দ নিয়ে সত্যজিৎতের কাছে মতামতও তুলে ধরতেন বলে জানিয়েছেন সন্দীপ।
বাবার নির্মাতা জীবনে মায়ের অবদান নিয়ে আনন্দবাজারের সঙ্গে কিছু স্মৃতি ভাগ করে নিয়েছেন সন্দীপ।
এই পরিচালকের কথায় জানা গেল, সত্যজিতের শেষ সিনেমা ‘আগুন্তকের’ একটি দৃশ্যে অনিলা বোস চরিত্রে অভিনয় করা মমতা শঙ্করের হাতে কি বই থাকবে সেটিও ঠিক করে দিয়েছিলেন বিজয়া।
সন্দীপ বলেন, “দৃশ্যটা এমন ছিল যে অনিলা উইল নিয়ে তার স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করার সময়ে একটি বই পড়বে। কোন বই পড়বে সেটা বাবা ভেবে পাচ্ছেন না। আমাদের খাবার টেবিলে এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। খেতে খেতে বাবা সেই প্রসঙ্গ তুলতেই মা সেকেন্ডে সমাধান করে দিলেন। আমার এখনও মনে আছে, মা আগাথা ক্রিস্টির ‘পেরিল অ্যাট এন্ড হাউস’ বইটা মমতা শঙ্করকে দিয়ে পড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। এমনকি বইয়ের ভেতরে পাতা খুলে দেখিয়েও দিয়েছিলেন, কোথায়, কোন জায়গায় সেটা পড়বে অনিলা। বাবা সিনেমায় ওই বইটাই দেখিয়েছিলেন।“
একইভাবে ওই সিনেমায় আনিলার বিস্কুট বানানোর দৃশ্য ছিল। সেটিও বিজয়া রায় বানিয়ে দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন সন্দীপ।
“মা তো বাড়িতে বিস্কুট বানাতেন। সেই সরঞ্জাম নিয়ে সেটে এলেন। সেখানে তৈরি হল বিস্কুট। তার পরে এমন কাণ্ড হল, সবাই বিস্কুট খেয়ে নিল।“
ছেলেবেলা থেকে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া বিজয়া সত্যজিতের সিনেমায় গান নির্বাচনে বড় ভূমিকা রেখেছেন।
সন্দীপ বলেন, “'চারুলতা’ সিনেমায় ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটি কিশোর কুমারকে তোলানোর দায়িত্বে পড়েছিল মায়ের উপরেই। মা স্বরলিপি মেনে নিখুঁত গাইতেন। তাই গানের ক্ষেত্রে মায়ের উপর বাবার ছিল অগাধ ভরসা।
“মা প্রথমে নিজে এই গানটি গেয়েছিলেন। মায়ের রেকর্ড করা গান মুম্বাইয়ে কিশোর কুমারের কাছে যায়। শুনে শুনে সেই গান তুলেছিলেন কিশোর কুমার। এছাড়া ‘আগন্তুক’ সিনেমায় শ্রমণা চক্রবর্তীকে মা গান শিখিয়েছিলেন।“
সত্যজিতের কালজয়ী গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদা সিরিজের প্রথম সিনেমা ‘সোনার কেল্লার’ ‘মুকুল’ চরিত্রে অভিনয় করা কুশল চক্রবর্তী যে লাল সোয়েটার পরেছিলেন সেটাও বিজরা রায়ের হাতে বোনা বলে জানিয়েছেন সন্দীপ।
“‘চারুলতা’ সিনেমায় মাধবী মুখোপাধ্যায় যে রুমালটা তৈরি করছিলেন সেটাও আমার মায়ের হাতের কাজ। মা যেন বাবার প্রতিটি কাজে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিল। পোশাক পরিকল্পনার পাশাপাশি আউটডোর শুটিংয়ে সকলে যাতে আরাম করে কাজ করতে পারেন, খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে কোথাও কোনও অসুবিধা না হয় সেই দিকটা দেখার দায়িত্বও মায়ের কাঁধে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতেন আমার বাবা।
“হাসিমুখে সব দায়িত্ব সামলেছেন মা। আজ আরও বেশি করে অনুভব করতে পারি, বিজয়া রায়-সত্যজিৎ রায় একে অন্যের পরিপূরক। সত্যজিতের যে কোনও নির্মাণের অন্তরালে ছায়া হয়ে থেকেছিলেন বিজয়া রায়। আমার মা।“
১৯১৭ সালে জন্ম নেওয়া বিজয়া ১৯৪৮ সালে সত্যজিত রায়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী বিজয়া কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন। স্বামীর সঙ্গে কাটানো দিনগুলো নিয়ে ‘আমাদের কথা’ নামে একটি আত্মজীবনী লিখেছেন তিনি।
১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল সত্যজিত রায়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা স্বামীকে অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন বিজয়া।