Published : 27 Jun 2025, 04:32 PM
সত্তরের দশক থেকে শুরু করে পরের কয়েক যুগ এবং এখনও হিন্দি সিনেমার দর্শক এবং অভিনয় শিল্পীদের কাছে জনপ্রিয় একটি সিনেমা ‘শোলে’। যে সিনেমার গান-সংলাপ আজও ‘মূর্ত’ অনেকের কাছে।
ঠাকুরের ডাকে জয় আর বীরু নামের দুই তরুণের ডাকাত ধরার সেই গল্প হয়ে ওঠে বলিউডের ইতিহাস।
সেই সিনেমা ‘শোলে’ মুক্তির ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে চলতি বছরে।
সে উপলক্ষ্যে শুক্রবার ইতালির বোলোনিয়া শহরে ‘ইল সিনেমা রিট্রোভাতায়’ উৎসবে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হচ্ছে রমেশ সিপ্পি পরিচালিত ১৯৭৫ সালের জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা ‘শোলের’। সেখানে আসছে সিনেমার ‘আনকাট সংস্করণ’।
বিবিসি লিখেছে, কালজয়ী এই সিনেমাটি সম্পূর্ণ পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। এই নতুন সংস্করণে দর্শকেরা দেখতে পাবেন সিনেমার আসল সমাপ্তি। এতে রয়েছে সিনেমার শেষাংশের বাদ পড়া কিছু দৃশ্য। যা আগে সেন্সরের আপত্তির কারণে পরিবর্তন করা হয়েছিল।
সিনেমার নতুন সংস্করণটি বড় এক খোলা জায়গায় স্ক্রিনে দেখানো হবে, যা হতে যাচ্ছে দর্শকদের এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
পঁচাত্তরে মুক্তির পর ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি টিকেট বিক্রি করা সিনেমা ‘শোলে’। যে সিনেমায় ধর্মেন্দ্র ও অমিতাভ বচ্চন জুটি কাঁপিয়ে দিয়েছিল বলিউডের বক্স অফিস।
১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রটির বাজেট ছিল ৩ কোটি টাকা, যা তখনকার সময়ের অন্যতম ব্যয়বহুল ভারতীয় প্রযোজনাগুলোর মধ্যে একটি।
২০৪ মিনিট দৈর্ঘের ‘শোলে’ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন একঝাঁক বলিউড তারকা। সঞ্জীব কুমার, অমিতাভ বচ্চন, ধর্মেন্দ্র, হেমা মালিনি, জয়া ভাদুরি (পরে অমিতাভকে বিয়ে করে হন জয়া বচ্চন), আমজাদ খানের মত অভিনেতারা ছিলেন।
বক্স অফিস ভরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ভারতের একটি ধ্রুপদি চলচ্চিত্রের মর্যাদাও পায় ‘শোলে’। বিশ্লেষকরা বলেছেন ‘শোলে’ যেন কেবল একটি সিনেমা নয়, বরং হয়ে ওঠে সংস্কৃতির প্রতীক। এ সিনেমার সংলাপ বিয়েতে বলা হয়, রাজনীতিতে ব্যবহার করা হয়, এমনকি বিজ্ঞাপনচিত্রেও দেখা গেছে।
সিনেমাটির চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন কিৎবদন্তি চিত্রনাট্যকার জুটি সেলিম খান ও জাভেদ আখতার। এর কাহিনী পশ্চিমা ও জাপানি সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত। তবে ‘শোলে’ পুরোপুরি ভারতীয় আবহে তৈরি।
সিনেমায় দেখানো হয়েছে রামগড় নামে এক কাল্পনিক গ্রামে জয় ও বীরু নামের দুই মাস্তানকে ডাকাত গব্বর সিংয়ের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য নিয়োগ দেন এক সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, ঠাকুর বলদেব সিং। গব্বর সিং ভারতীয় সিনেমার অন্যতম আইকনিক খলনায়ক।
এক মাস্তান বীরুর ভূমিকায় অভিনয় করা ধর্মেন্দ্র বলেন, “শোলে বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য।”
আরেক মাস্তানের চরিত্র করা অমিতাভ বচ্চন বলেন, “আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা শোলের শুটিং। তখন অবশ্য বুঝিনি সিনেমাটির আইকনিক মাত্রায় পৌঁছাবে।”
ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের শিল্পী শিবেন্দ্র সিং দুংগারপুর জানিয়েছেন, ‘শোলের’ পুনরুদ্ধার করা সংস্করণই সবচেয়ে ‘আসল ও সম্পূর্ণ’।
“এখানে মূল শেষাংশ ও বাদ দেওয়া দৃশ্যগুলো রয়েছে।”
সেন্সরের আপত্তি ছিল কোথায়
মূল সংস্করণে ডাকাত গব্বর সিংয়ের মৃত্যু হয়। ঠাকুর তার কাঁটা লাগানো জুতার নিচে পিষে মেরে ফেলে গব্বর সিংয়কে। কিন্তু সেন্সরে ওই দৃশ্য নিয়ে ওঠে আপত্তি। সেন্সর বোর্ডের যুক্তি ছিল গব্বরের মৃত্যুর দৃশ্যে ‘ক্রুরতা দেখানো হচ্ছে’।
এছাড়া সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার আইন নিজের হাতে নেওয়ার বিষয়টি মানতে নারাজ ছিল সেন্সর বোর্ড। ওই সময়ে ভারতে চলমান জরুরি অবস্থার সেন্সর বোর্ড ছিল কঠোর অবস্থানে।
বোর্ডের আপত্তিতে পরিচালক সিপ্পিকে বাধ্য হয়ে সিনেমার সমাপ্তি দৃশ্য বদলাতে হয়। ফের শুট করতে হয়। সবাইকে দ্রুত রামনাগরামের পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়, যেটি পরিণত হয়েছিল রামগড় গ্রামে। নতুন করে ধারণ করা শেষ দৃশ্যে গব্বরের মৃত্যুর বদলে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে সিনেমাটি সেন্সর ছাড় পায়।
যেভাবে উদ্ধার হয় মূল সমাপ্তি দৃশ্য
এই মহাকাব্যিক সিনেমাটির মূল সংস্করণ ফিরিয়ে আনতে তিন বছর সময় লেগেছে। কাজটি চ্যালেঞ্জের ছিল বলে জানিয়েছেন ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের শিল্পী শিবেন্দ্র সিং দুংগারপুর।
তিনি বলেন, “সিনেমার মূল ৭০ মিলিমিটারের প্রিন্টগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, আর নেগেটিভ যা ছিল সেগুলো অনেকটাই নষ্ট ছিল।”
২০২২ সালে রমেশ সিপ্পির ছেলে শেহজাদ সিপ্পি ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
শেহজাদ ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশনকে তখন জানান যে, মুম্বাইয়ের এক গুদামে কিছু কৌটা আছে বলে জেনেছেন। ওই কৌটার ভেতরে পাওয়া যায় আসল ৩৫ মিলিমিটারের ক্যামেরা ও সাউন্ড নেগেটিভ।
এরপর যুক্তরাজ্য থেকেও কিছু অতিরিক্ত রিল উদ্ধার করা হয়। ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও ইতালির লা ইমাজিনে রিট্রোভাতার সহযোগিতায় সিনেমার সব অংশ জোড়া লাগানো হয়। লা ইমাজিনে রিট্রোভাতা বিশ্বের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র পুনরুদ্ধার কেন্দ্র।
এমনকি এই সিনেমাতে ব্যবহৃত আসল ক্যামেরাটিও উদ্ধার করা হয়।
শুরুতে শোলে ব্যর্থ হয়
শুরুতে শোলের চলার পথ অতটা মসৃণ ছিল না। মুক্তির প্রথম সপ্তাহে তেমন প্রংশসাও জোটেনি সিনেমাটির ভাগ্যে। বরং অনেক সামলোচক বলেছিলেন শোলে ‘ব্যর্থ’।
ইন্ডিয়া টুডে ম্যাগাজিন ‘শোলে’ নিয়ে তখন বলেছিল ‘নিভে যাওয়া কয়লা।’
ফিল্মফেয়ারের বিক্রম সিং লিখেছিলেন, “সিনেমার মূল সমস্যা ছিল ‘ব্যর্থ প্রচেষ্টা, ভারতীয় প্রেক্ষাপটে একটি ওয়েস্টার্ন সিনেমা জুড়ে দেওয়া চেষ্টা করা হয়েছে শোলেতে। বলা ভালো সিনেমাটি না না ঠিক ভারতীয়, না ঠিক পশ্চিমা।”
প্রথম সপ্তাহে প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের পাওয়া গিয়েছিল নীরব ভূমিকায়।
চলচ্চিত্র লেখক অনুপমা চোপড়া তার বইয়ে লিখেছেন, “প্রেক্ষাগৃহে দর্শকেরা চুপচাপ বসে থাকতেন। হাসি-কান্না-করতালির আওয়াজ কিছুই শোনা যায়নি।”
তৃতীয় সপ্তাহে এসে দর্শক সিনেমাটি গ্রহণ করেছেন জানিয়েছে অনুপম চোপড়া লিখেছেন, “তারা (দর্শক) সংলাপ বলতে শুরু করে, অনেকে আবার দ্বিতীয়বার ‘শোলে’ দেখতে আসে।”
‘শোলে’ মুক্তির এক মাস পর, পলিডর একটি ৪৮ মিনিটের সংলাপ রেকর্ড প্রকাশ করে। তাতে পরিস্থিতি ঘুরে যায়। সিনেমাগুলোর চরিত্রগুলো আইকনিক হয়ে ওঠে।
এক মাস পর একটি সংলাপ রেকর্ড বের হয়, যেটা খুব জনপ্রিয় হয়। এরপরই সিনেমাটি ঘুরে দাঁড়ায়। গব্বর সিং চরিত্র ভয়ংকর হলেও রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বিদেশি সমালোচকেরা বলতে শুরু করেন রমেশ সিপ্পির ওয়েস্টার্ন ঘরানার অ্যাকশনধর্মী সিনেমা বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
চলচ্চিত্র ও বক্স অফিস বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মুম্বাইয়ের মিনার্ভা হলে চলেছে টানা পাঁচ বছর। তিন বছর নিয়মিত শো, দুই বছর ম্যাটিনি শো। ওই সময়ের ১৮ কোটি টিকেট বিক্রি হয়েছে ‘শোলে’ সিনেমার। এমনকি ২৪০ তম সপ্তাহেও এই সিনেমার শো ছিল হাউসফুল।
২০১৫ সালের এপ্রিলে ৪০ বছর পর ‘শোলে’ পাকিস্তানের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়।
সিনেমা পরিবেশক শ্যাম শ্রফ বলেন, “যেমন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নিয়ে বলা হয়, ‘শোলে’ নিয়েও বলা যায় ‘সূর্য কখনো অস্ত যায় না’।”
পরে বিবিসি ইন্ডিয়ার পোলে 'ফিল্ম অব দ্য মিলেনিয়াম' এবং ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের পোলে সর্বকালের সেরা ভারতীয় সিনেমা হিসেবে ঘোষণা করা হয় ‘শোলে;কে। এছাড়া সিনেমাটির গানের রেকর্ড ক্যাসেট বিক্রি হয়েছিল প্রায় পাঁচ লাখ কপি।
পঞ্চাশ বছরে ‘শোলে’ কেন অম্লান? এই প্রশ্নের উত্তরে অমিতাভ এক সাক্ষাৎকারে বচ্চন বলেন “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল অন্যায়ের ওপর ন্যায়ের বিজয়। গুরুত্বপূর্ণ হল তিন ঘণ্টায় ন্যায়বিচার দেখেছে দর্শকরা। যা আপনি আর আমি আজীবনেও হয়ত পাবো না।”