Published : 10 Aug 2023, 07:14 PM
বাংলাদেশে ডেঙ্গু নিয়ে যত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে খারাপ হতে পারে বলে এক সেমিনারে হুঁশিয়ার করেছেন তারা।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর নিপসম মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ও নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জ: করণীয়’ শীর্ষক এই সেমিনার হয়।
এইডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু যে শুধু স্বাস্থ্য বিভাগের একার সমস্যা নয়, সবার সমস্যা ধরে নিয়ে যে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে, সে কথা উঠে আসে এক কর্মকর্তার কথায়।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা।
তিনি বলেন, ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপের সময় তিনি রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সিডিসির লাইন ডাইরেক্টর ছিলেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সে সময় তাদের ‘ঘুম হারাম’ হয়েছিল। এবার পরিস্থিতি সে সময়ের চেয়ে খারাপ হচ্ছে।
“২০১৯ সালে সারা বছরে মারা গিয়েছিল ১৭৯ জন। এবার অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি। সুতরাং বাকি দিনগুলোয় আমরা মৃত্যু ঠেকিয়ে রাখতে পারব– এমন হবে না। মৃতের এই সংখ্যা দ্বিগুণও হয়ে যেতে পারে।”
ডা. তহমিনা বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে জরিপ, তথ্য সংগ্রহ, নজরদারিতে ঘাটতি রয়েছে। ঢাকাসহ সারাদেশে হাজার হাজার হাসপাতালের মধ্যে ৬৩টি হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গুর তথ্য নেওয়া হয়।
“সুতরাং আমরা বুঝতে পারছি, ডেঙ্গু আক্রান্ত এবং মৃত্যু দুটোই অনেক অনেক (প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে) কম। এটা মিডল ইনকাম কান্ট্রির জন্য স্বাভাবিক, আমাদের পাশের দেশেও হচ্ছে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু এককভাবে স্বাস্থ্য বিভাগের সমস্যা নয়, এটি এখন জনস্বাস্থ্য সমস্যা।
তিনি বলেন, তারা বহু মানুষকে পরামর্শ দিচ্ছেন বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা নিতে। কিন্তু বহু মানুষ কখনো হাসপাতালেই যায় না।
“যে ৭০ হাজার রোগীকে আমরা (এ বছর) শনাক্ত করেছি সরকারি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। এটা হচ্ছে কমিউনিটিতে ‘টিপ অব দি আইসবার্গ’। বাকি অন্তত পাঁচ গুণ বেশি রোগী কমিউনিটিতে আছে, যারা কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত হয়েছেন বা সাসপেক্টেড।
“তারা কোনোভাবেই পরীক্ষা করছে না বা পরীক্ষা করার জন্য আসছে না। এই ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে যদি সম্পৃক্ত করা না যায়, এই রোগটা যে প্রাণঘাতী এই বিষয়ে যদি তাদের আমরা সম্যক ধারণা দিতে না পারি, তাহলে কিন্তু ফ্যাটালিটি কমার সম্ভাবনা নেই।”
এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৭৮ হাজারের বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৩৬৪ জনের, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।
যারা আক্রান্ত হয়ে পরীক্ষা করান না, বা পরীক্ষা করালেও হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না, তাদের সংখ্যা এই হিসাবে আসেনি।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন সেমিনারে বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে সময় লাগলেও সেটা ‘অসম্ভব নয়’। মশা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এখন আক্রান্ত রোগীকে যেন মশা না কামড়ায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
“এখন প্রতিটি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে মশারির ভেতর রাখা নিশ্চিত করা দরকার। যেমন কোভিডের সময় প্রতিটি আক্রান্ত মানুষকে মাস্ক পরতে বলা হয়েছিল। মশারির ভেতরে থাকলে এইডিস মশা কামড়ানোর মত লোক পাবে না। রোগীকে কামড়াতে না পারলে সে ডেঙ্গুও ছড়াতে পারবে না।
“প্রতিটি আক্রান্ত রোগীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। আক্রান্তদের বেডরেস্ট এবং চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে।”
সেমিনারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে জনগণকে সম্পৃক্ত করা, ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসা কৌশল ঠিক করা, মশা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকারের সঙ্গে একটি শক্তিশালী সমন্বয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা, বিভিন্ন এলাকায় মানুষের মধ্যে বিনামূল্যে মশারি বিতরণের উদ্যোগ নেওয়াসহ দশটি সুপারিশ করে পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ।
সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেন, “আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করব, যেন এনজিও, প্রাইভেট সেক্টরকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কাজে যুক্ত করা হয়। হাসপাতালের ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্বল্প মেয়াদী জরুরি ব্যবস্থা এবং দীর্ঘ মেয়াদী ৫ বছর ১০ দশ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়ার জন্য আমরা সরকারকে অনুরোধ করব।”
পাবলিক হেলথ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর মহাসচিব ডা. এস এম শহীদুল্লাহ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল, ডিএনসিসির সাবেক প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জোবায়দুর রহমানসহ চিকিৎসক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন।