Published : 16 Jan 2024, 01:43 PM
কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ (১৯৪৮-২০১২) তার ‘নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’ বইয়ে ‘কচ্ছপকাহিনি’ নামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এর বিষয়বস্তু হলো কীভাবে তিনি ‘কচ্ছপের মতো কামড় দিয়ে’ একটা ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরি করতে চান। উদাহরণ হিসেবে কীভাবে তিনি ২০০০ সালে নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলায় বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন সেই গল্পও বলেছেন বিস্তারিত।
হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ বাড়ি থেকে ৭০ মাইল দূরে জায়গির থেকে পড়াশোনা করতেন। তিনিই ছিলেন দুর্গম ওই গ্রামের প্রথম ম্যাট্রিকুলেশন পাশ। তাই হুমায়ূনের মা আয়েশা ফয়েজ ছেলের কাছে সেই গ্রামে একটা স্কুল করে দেবার আবদার করেন।
বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বলে স্কুলের নাম ঠিক করা হয় ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’। হুমায়ূন তার প্রবন্ধে লিখেছেন, “কী যে ভয়াবহ এক ঝামেলা সেদিন মাথায় নিলাম, তা আমি জানি আর জানেন বেলাল বেগ।” বেলাল বেগ তাকে কিছু শর্ত দিলেন:
১. এই স্কুল আর দশটা স্কুলের মতো হলে চলবে না। এটি হতে হবে এমন এক স্কুল, যা উন্নত দেশের স্কুলের পাশে দাঁড়াবে।
২. স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনার পাশাপাশি শিখবে নৈতিকতা।
৩. প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর মাথায় স্বপ্ন ঢুকিয়ে দিতে হবে।
তার আগে গ্রামের মানুষদের স্কুলের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে হবে। জায়গা কিনতে হবে। রাস্তাঘাট করতে হবে। ইলেকট্রিসিটি আনতে হবে। এর মধ্যে স্কুলটির নকশা করে দিয়েছিলেন স্থাপত্যবিদ্যা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মেহের আফরোজ শাওন। স্কুল দাঁড়িয়ে গেলে কীভাবে চালানো হবে সেটা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ ভাবনায় পড়ে গেলেন। নিজের সঞ্চিত অর্থের সবটাই খরচ করে ফেললেন। কিন্তু তখনও আসবাবপত্র কেনার টাকা নেই। বেড়া দেওয়ার টাকা নেই। স্কুলটিকে নির্মাণের মাঝপথে রেখে বেলাল বেগ যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান।
হুমায়ূন চেষ্টা করলেন স্কুলটি সরকারের হাতে তুলে দিতে, কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। নানা জায়গায় কথা বলেও কেউ স্কুলের দায়িত্ব নিলো না। তারপর স্কুল বাদ দিয়ে হাসপাতাল বানানোর পরিকল্পনা করে সেখানেও ধাক্কা খেলেন হুমায়ূন। ইতোমধ্যে স্কুলের ২৬০টি কাচের জানালা ভেঙে পড়ে। লাইব্রেরি ঘর হিসেবে যেটা বানানো হয়েছিল সেখানে বহিরাগতরা আড্ডা বসাল। স্কুলের মাঠে সরিষা বুনে দেওয়া হল। স্কুলের চারপাশের লোহার খুঁটিগুলো তুলে গ্রামের মানুষেরাই সের দরে বাজারে বেচে দিল। স্কুলভবন গরু-ছাগল রাখার স্থায়ী নিবাসে পরিণত হলো।
কিন্তু হুমায়ূন দমে না গিয়ে লেগে ছিলেন, যেটাকে উনি বলেছেন ‘কচ্ছপের কামড়’। তারপর থেকে স্কুলটি চলছে। হুমায়ুন লিখেছেন, “স্কুলে এখন পাশের হার ১০০ ভাগ। সে বছর বৃত্তি পেয়েছিল পাঁচটি ছেলেমেয়ে।”
স্কুলটির এ ইতিহাস পড়ার পর থেকেই এটাকে দেখার জন্য আগ্রহবোধ করছিলাম। অবশেষে সুযোগটাও এসে গেলো গত ডিসেম্বরে দেশে যাওয়ার পর। দাদাশ্বশুরের বাড়ি নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া থানার পাইকুড়া ইউনিয়নের চিট্টুয়া গ্রামে। চিট্টুয়ার সামনের বিশাল বিলের অপর পাড়েই কুতুবপুর গ্রাম। কিন্তু যেতে হবে রোয়াইলবাড়ি বাজার হয়ে।
ঢাকা থেকে আপনি যেকোনো বাসে নান্দাইল চৌরাস্তা পর্যন্ত গিয়ে তারপর টেম্পু বা অটোরিকশাতে করে আঠারো বাড়ি যেতে পারেন। সেখান থেকে আবার অটোরিকশাতে যেতে পারেন কুতুবপুর। কুতুবপুরের রাস্তা বেশিরভাগই পাকা। এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া-আসার সময় পাখি ডাকা ছায়া ঢাকা গ্রাম বাংলার দেখা পাবেন।
আমরা রোয়াইলবাড়ি বাজার থেকে পায়ে হেঁটেই রওনা দিলাম। কাঁচা রাস্তায় জুতো-মোজা খুলে হাতে নিয়ে নিলাম। সোঁদা মাটির স্পর্শে শরীরে একটা শিহরন বয়ে গেলো। আমাদের পাশ দিয়েই দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েরা পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে করে ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠে’ যাচ্ছিল।
আমার শ্যালক মারুফ জানালো, এই স্কুলটা নেত্রকোণা জেলার সবচেয়ে ভালো স্কুল। এ বক্তব্যের সত্যতা নিশ্চিত হয়েছিলাম স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক শরিফ আনিস আহমেদের সঙ্গে কথা বলে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমরা পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। মূল রাস্তায় প্রথমেই চোখে পড়লো একটা নামফলক ‘শহীদ ফয়জুর রহমান সড়ক’। তারপরই আছে স্কুলটির ভিত্তিপ্রস্তর, যেটা স্থাপন করেছিলেন অভিনেতা ও রাজনীতিবিদ আসাদুজ্জামান নূর।
তারপর অনেকখানি খোলা জায়গা। সেখানে স্থানীয় শিশু-কিশোররা খেলাধুলা করছিল। এখানটায় হুমায়ূন আহমেদ স্কুলের শিক্ষার্থীদের খেলার জন্য একটা পার্ক তৈরি করেছিলেন, যার কিছুই আর এখন অবশিষ্ট নেই। তারপর একটা পুকুর। পুকুরের পাড় ধরে এগোলেই স্কুলের মাঠ। এই পথের শেষে মাঠের কোণায় রয়েছে সাদা রঙের শহীদ স্মৃতিফলক যেটি উদ্বোধন করেন কবি শামসুর রাহমান।
মাঠের শেষ প্রান্তে মূল ভবন। আসলে একটা ভবন নয়, অনেকগুলো ভবনের গুচ্ছ। শক্ত ভিত্তির ওপর ইটের দেয়ালের আয়তাকার একেকটা ভবন। দৈর্ঘ্যের একদিকের দেয়াল উঁচু আর অন্যদিকের দেয়াল নিচু। তার উপর টিনের একচালা ছাউনি। ছাত্রছাত্রীরা যাতে বৃষ্টির শব্দ শুনতে পারে তাই এই ব্যবস্থা। কেন্দ্রের গ্রন্থাগার ভবনটি শুধু দোচালা। ভবনগুলোর বেশিরভাগই শ্রেণিকক্ষ। বাকিগুলোর মধ্যে একটা গ্রন্থাগার যাতে অনেক মূল্যবান বই রয়েছে, আর আছে একটা কম্পিউটার ল্যাবরেটরি।
আমরা গিয়েছিলাম এবছর পহেলা জানুয়ারি। সেদিন ছিল বই দিবস। স্কুলের সামনের চলছিল ছাত্রছাত্রীদের জমায়েত। প্রতি শ্রেণির প্রথম তিনজনের নাম ডেকে তাদের হাতে বই তুলে দেওয়া হচ্ছিল। তারপর শ্রেণিকক্ষে এসে বাকিদের মধ্যে বই বিতরণ করা হচ্ছিল। আমরা উঁকি দিয়ে দেখলাম। চমৎকার সাজানো গোছানো।
স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে কথা হয় সহকারী প্রধান শিক্ষক শরিফ আনিস আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, “প্রতি শ্রেণিতে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর বেশি ভর্তি নেওয়া হয় না। এতে করে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ঠিক থাকে এবং শিক্ষকেরা ছাত্রদের কাছ থেকে নিয়মিত পড়া আদায় করতে পারেন। ছাত্রছাত্রীদের আর আলাদা প্রাইভেট পড়তে হয় না। এগুলো সবই হুমায়ূন আহমেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী করা হয়। তাই প্রায় প্রতি বছরই এই স্কুলটা ভালো ফলাফল করে।”
শরিফ আনিস আহমেদ আক্ষেপ নিয়ে জানান, এতো ভালো ফলাফল করার পরও স্কুলটি অবহেলিত। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকতে অনেকেই এখানে আসতেন। এখন আর তেমন কেউ আসে না। আর সরকারি লোকজনও কেন জানি স্কুলটাকে এড়িয়ে চলেন। এখন পাঞ্জেরি হয়ে শক্ত হাতে স্কুলটির হাল ধরে আছেন হুমায়ূনের স্ত্রী অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন।
স্কুলের বাইরে সাইকেলের সংখ্যা প্রমাণ করে দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্রছাত্রীরা এই স্কুলে পড়তে আসে। মাঠের উত্তর পাশে সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে চারতলা আরেকটি ভবন। শীঘ্রই ছাত্রছাত্রীরা এই নতুন ভবনে ক্লাস করতে পারবে। বাংলাদেশের বুকে এমন একটা স্কুল আছে যেটা নিয়ে আমরা অবশ্যই গর্ব করতে পারি।