Published : 25 Jun 2025, 12:57 PM
ইমিগ্রেইশন’য়ের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি ছয়জনের পেছনে। বাম দিকের কোনায় বেশ কজনের জটলা। সেখানে দুজন ইমিগ্রেইশন পুলিশ তাদের সামলাতে ব্যস্ত। সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে, নিজের সব কাগজ আছে কিনা আরেকবার পরখ করে নিলাম।
সঙ্গের দুজন ভ্রমণ সঙ্গী ইতোমধ্যেই ইমিগ্রেইশন পার হয়ে ওদিকে চলে গেছে। তাদের এটা দ্বিতীয়বার নেপাল যাত্রা।
আমার পালা আসতে বুথের সামনে দাঁড়িয়ে পাসপোর্ট আর বিমানের টিকিট দিয়ে দিলাম সামনে বসা দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে। আর এখান থেকেই শুরু হল বিপত্তি।
তিনি আমার সব কিছু পরখ করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নেপাল কি প্রথমবার?’ আমার সহজ সরল জবাব ‘হ্যাঁ’।
তখন তিনি পাসপোর্ট ও টিকিট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে যেদিকে বেশ কয়েকজন জটলা করে ছিল সেদিকটা দেখিয়ে বললেন, “ওদিকে চলে যান।”
যেয়ে বুঝলাম কাহিনিটা কী!
বিষয় হচ্ছে যারা প্রথম নেপাল যাচ্ছে, তাদের সবাইকে আলাদা করে জিজ্ঞেসাবাদ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পাশের ইমিগ্রেইশন অফিসে। যেকজন একসঙ্গে জমা দিচ্ছে পাসপোর্ট সে কজনের দল বানানো হচ্ছে।
মন্দের ভালো হল, আমি পড়লাম পাঁচজনের দলে। আমাদের নিয়ে যাওয়া হল পাশের রুমে। সেখান থেকে শুরু হল অপেক্ষার পালা।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা এসে সবাইকে আলাদা আলাদা করে প্রশ্ন করছেন। কই যাচ্ছেন? কবে আসবেন? হোটেল বুকিং আছে কিনা, নানান কিছু। যার যেটা নাই, তাকে সেটা জোগাড় করে আনতে বলছেন।
এই করতে করতে চলে গেল দেড় ঘণ্টা।
এরপর আমাদের পাঁচজনের দলকে প্রধান ইমিগ্রেইশন পুলিশ কর্মকর্তা কক্ষে প্রবেশ করিয়ে নানান প্রশ্ন করে উত্তর জেনে, যাবতীয় কাগজপত্র পরখ করে সন্তুষ্ট হয়ে যেতে দিলেন।
এবার ইমিগ্রেইশন সেরে বিমানে ওঠার পালা শুরু হল। কারণ এসব জটিলতায় পড়ে ততক্ষণে বিমানে ওঠার সময় হয়ে গিয়েছিল।
পেছনের কথা
নেপাল। হিমালয় কন্যা। এই কন্যার দেখা পেতে বাংলাদেশিদের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা হল পোর্ট এন্ট্রি ভিসা। তাই এই সময়ের ভ্রমণ গন্তব্যের মধ্যে জনপ্রিয় একটি দেশ হয়ে উঠেছে।
আর এজন্য বিমানের টিকিট যত আগে কাটা যাবে, ততই কম খরচ পড়বে- তথ্যটি জানালেন ‘প্যান প্যাসেফিক টুরস’য়ের ‘ভিসা ও প্যাকেজেস’ বিষয়ক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা অদিতি নিওগি।
পোর্ট এন্ট্রি ভিসা হলেও, বিমানের টিকিট (রিটার্ন-সহ) কাটার পর প্রথম কাজ শুরু হল হোটেল খোঁজা।
আমরা যেহেতু কাঠমান্ডু নেমেই পোখারা চলে যাব, সে কারণে পোখারার ওপরে মানে পাহাড়ের ওপর, কাসকিকট নামের একটা জায়গায় ‘ইএস দেওরালি রিসোর্ট’ বুকিং ডটকম’য়ের মাধ্যমে বুকিং করে নিলাম। এরপর দিলাম যেদিন কাঠমান্ডু আসবো সেদিন থেকে ঢাকায় ফেরার দিন পর্যন্ত হোটেল বুকিং।
সুবিধা হল, এই ধরনের অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বুকিং দিতে কোনো অগ্রিম টাকা প্রদান করতে হয় না। এমনকি কয়েকদিন আগ পর্যন্ত বিনা খরচে বুকিং বাতিলও করা যায়।
তবে ২৪ ঘণ্টা আগে বাতিল করতে গেলে, যে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বুকিং করা হয়েছে, সেটা থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা কেটে রাখবে।
যেসব প্রয়োজনীয় কাগজ লাগবে
নেপালের ইমিগ্রেইশন পার হতে যত না সোজা, তারচেয়ে বেশি সময় ব্যয় হবে বাংলাদেশের বিমান বন্দরের ইমিগ্রেইশনে। এজন্য অবশ্যই যাত্রার দিন বিমানে ওঠার নির্দিষ্ট সময়ের অন্তত চার ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে পৌঁছাতে হবে।
আর প্রয়োজনীয় সব কাগজ না থাকলে পড়তে হবে ঝামেলায়। যেসব কাগজ লাগবে সেগুলো হল-
এই সবগুলো কাগজের অবশ্যই প্রিন্ট কপি সঙ্গে রাখতে হবে। আর কবে ফেরা, কোন দিন কবে থেকে হোটেলে থাকা এসব বিষয় প্রশ্ন করলে সুন্দর মতো উত্তর দিতে হবে। না হলেই পড়ে যেতে হতে পারেন সন্দেহের তালিকায়।
নেপালের ভিসা আবেদন এবং ফি
পোর্ট এন্ট্রি ভিসা হলেও একটা ফর্ম পূরণ করতে হবে। সেটা নেপালের ত্রিভূবন বিমানবন্দরে গিয়েও করা যায়।
তবে দেশ থেকেই সেটা করে নিয়ে যাওয়া ভালো। কারণ বাংলাদেশের ইমিগ্রেইশনেও দেখতে চাইবে। আবার নেপালে গিয়েও ফর্ম পূরণের ঝামেলা এড়ানো যাবে।
https://nepaliport.immigration.gov.np/ এই লিংকে গিয়ে ‘ভিসা অন-অ্যারাইভাল’ বিভাগে ঢুকে যাবতীয় তথ্য পূরণ করলেই পাওয়া যাবে ভিসা অ্যাপ্লিকেইশন’য়ের পিডিএফ। এটাও প্রিন্ট করে নিতে হবে।
এই আবেদনপত্র ভ্রমণের তিন-চারদিন আগে করা ভালো। আর পূরণের সময় আসবে ভিসা ফি’য়ের ঘরটি।
এখানে মনে রাখতে হবে, যে বছর নেপাল যাওয়া হবে সেই বছর সার্ক দেশগুলোর মানুষদের জন্য প্রথমবার ভিসা ফি সম্পূর্ণ ‘ফ্রি’। একই বছর দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার গেলে দিতে হবে আলাদা আলাদা মূল্য।
পরের বছর আবার গেলে তখন আবার প্রথমবার ভিসা ফি দিতে হবে না। মানে যে বছর প্রথম যাওয়া সেই বছরেই পরেরবার গেলে ফি প্রযোজ্য।
ভ্রমণ পরিকল্পনা
যদি নেপালের কাঠমান্ডু নেমে সেখানেই থেকে যেতে চান কয়েকদিন তবে নির্ধারিত বুকিং দেওয়া হোটেলে চলে যেতে পারেন।
আর কাঠমান্ডু থেকে সরাসরি পোখারা যেতে চাইলে দুটি উপায় আছে। একটি হল বাস, আরেকটি তাদের অভ্যন্তরীণ বিমান সেবা।
নেপালে দুপুরে নামলে, বিকালের প্লেনে করেই পোখারা চলে যাওয়া যায়। সময় লাগে মাত্র ২০ মিনিট। তবে এই টিকিট অবশ্যই ঢাকা থেকে কেটে যেতে হবে। রিটার্ন-সহ নিতে পারলে বেশ কম পড়বে।
নেপালের ‘বুদ্ধা এয়ার’ এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো। কারণ এরা ২০ কেজি লাগেজ নিতে দেবে। অন্যান্যগুলোতে মাত্র পাঁচ কেজি। তাছাড়া যাত্রী কম হলে যখন তখন ‘ফ্লাইট’ বাতিলও হয়ে যায়।
তবে ফেরার সময় পোখারা থেকে বাসে ফিরেছিলাম কাঠমান্ডু। যদিও এসি বাস ছিল। তারপরও রাস্তা খারাপ সেজন্য প্রায় সাত আট ঘণ্টা সময় লাগে, আর সোফা সিট হলেও মোটেই আরামদায়ক ছিল না বসাটা।
এজন্য বাড়তি টাকা জমিয়ে বিমানেই যাতায়াত সুবিধাজনক। তাছাড়া সময়ও বাঁচবে।
পোখারাতে পাহাড়ের ওপর রিসোর্টগুলোতে থাকলে খরচ একটু বেশি পড়ে যাবে যাতায়াতে। যদিও পোখারায় একদিন ঘুরলেই শেষ। বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দেওয়া যাবে পাহাড়ে মেঘের লুকোচুরি দেখতে দেখতে।
এছাড়া পোখারার ফেওয়া হ্রদের আশপাশের রাস্তায় বহু হোটেল মিলবে। গুগল ম্যাপ থেকে বাজেট অনুযায়ী হোটেল বাছাই করে নেওয়া যাবে সহজেই।
আর ‘বুকিং ডটকম’য়ের মতো অনলাইন বুকিং সেবা থেকেও মিলবে নানান হোটেলের খোঁজ।
যাতায়াত ও অন্যান্য বিষয়
নেপালে আমাদের দেশীয় অ্যাপ ‘পাঠাও’ আছে। সেটা ব্যবহার করেই চলাচল করা সাশ্রয়ী। না হলে ট্যাক্সি ভাড়া করতে গেলে ওরা গলাকাটা দাম নেবে।
যেমন- নেপালের ত্রিভূবন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে ওদের অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের দূরত্ব হাঁটা পথে মাত্র ১০ মিনিট। তবে হাতে ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে অসুবিধা হবে বলে ভাবলেন ট্যাক্সিতে চলে যাবেন। কিন্তু তারা ভাড়া চেয়ে বসবে ৫শ’ রুপি।
এরচেয়ে সেখানে কিছুক্ষণ পরপর শাটল বাস রয়েছে। যেটাতে চড়ে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পৌঁছে যাওয়া যাবে আভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের একদম দরজা পর্যন্ত।
কাঠমান্ডুতে নেমে ইমিগ্রেইশন এলাকা পার হয়েই পেয়ে যাবেন ডলার ভাঙানো আর মোবাইল ফোনের সিমের দোকান। ‘এনসেল’য়ের সিম নেপালে জনপ্রিয় আর তাদের নেটওয়ার্কও ভালো।
ডলার সবগুলো একসাথে ভাঙানোর দরকার নেই। কারণ পোখারা বা কাঠমান্ডুর থামেলের গলিতে গলিতে ‘মানি এক্সচেঞ্জ’ রয়েছে। বরং বিমানবন্দরের ‘মানি এক্সচেঞ্জগুলো’তে বিনিময় মূল্য কম মিলবে। তাই যতটুকু আপাতত প্রয়োজন ততটুকু ডলার ভাঙিয়ে নেওয়াই ভালো হবে।
প্যারাগ্লাইডিং, বাঞ্জিজাম্প বা এই ধরনের কার্যক্রমে অংশ নিতে চাইলে হোটেল কর্তৃপক্ষদের বললে তারাই ব্যবস্থা করে দেবে।
যেখানেই কেনাকাটা করুন না কেনো, প্রচুর দামাদামি করতে হবে।
খাওয়া দাওয়া ও অন্যান্য
খাবারের দাম মোটামুটি বাংলাদেশের মতোই। যারা ‘হালাল হারাম’ মেনে চলেন তাদের একটু দেখে বুঝে নিয়ে রেস্তোরাঁ বাছাই করা ভালো হবে। কিছু কিছু রেস্তোরাঁয় আলাদা করে ‘হালাল’ বুথ করা আছে।
বিভিন্ন ‘মিউজিক্যাল বার’ ও ‘ড্যান্স বার’ রয়েছে কাঠমান্ডুর থামেলে। এসবে বুঝেশুনে ঢোকাই ভালো হবে। তবে যাদের ‘রক’ সংগীত পছন্দ তারা ‘পার্পল হেইজ’য়ে একবার ঢুঁ দিতে পারেন। গানের সাথে খাওয়া দাওয়া মন্দ লাগবে না।
ভিন্ন স্বাদের মোমো আর নেপালি খাবার খেতে চাইলে চলে যেতে পারেন, কাঠমান্ডুর দরবার স্কয়ারের কাছে মোমো কিং রেস্তোরাঁতে। এর কর্ণধাণ মাহিন্দ্রা সাকিয়া, বহুদিন ধরে হোটেল ও রেস্তোরাঁর ব্যবসায় জড়িত।
ভিন্ন রকমের মোমো’র স্বাদ নিতে চাইলে এই রেস্তোরাঁ ঢুঁ দিতে ভোলা যাবে না। আর ‘রুফটপ’ বলে নেপালের স্থানীয় খাবার ‘রাইস চাতামারি’ খেতে খেতে দরবার স্কয়ারের দৃশ্যও উপভোগ করা যাবে ওপর থেকে।