Published : 22 May 2025, 01:58 PM
মানুষ জন্ম থেকেই ভালোবাসা চায়, আর ভালোবাসার একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ হল শারীরিক স্পর্শ। শিশুর জন্মের পরপরই যখন তাকে মায়ের বুকে তুলে দেওয়া হয়, তখন সেই আদরের ছোঁয়া শিশুর মধ্যে নিরাপত্তাবোধ তৈরি করে।
এটাই হচ্ছে ‘স্কিন-টু-স্কিন কন্টাক্ট’ বা চামড়ার সংস্পর্শে আসা, যা শুধু শিশুর জন্যই নয়, বড়দের মানসিক সুস্থতার জন্যও জরুরি।
তবে বর্তমান সময়ে অনেকেই স্পর্শের এই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। একে বলা হয় ‘টাচ স্টার্ভেইশন’ বা ‘স্পর্শ-ক্ষুধা’।
কী এই ‘টাচ স্টার্ভেশন’ বা স্পর্শ ক্ষুধা?
যুক্তরাষ্ট্রের মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ‘পিয়ার্স ফাউন্ডেশন’-এর থেরাপিস্ট ও সুস্থতা-বিষয়ক পরিচালক র্যাচেল মার্মর ওয়েলঅ্যান্ডগুড ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা করেছেন, “টাচ স্টার্ভেইশন’ এমন একটি অবস্থা, যেখানে মানুষ শারীরিক স্পর্শের অভাবে এক ধরনের খালি ও একাকিত্ববোধ করে। এটি এমনই এক অভাব যা ক্ষুধা বা তৃষ্ণার মতো করে অনুভূত হতে পারে।”
কী কারণে টাচ স্টার্ভেশন হয়?
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন কারণে মানুষ শারীরিক আদর-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হতে পারে।
সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: একা থাকা বা বাসা থেকে কাজ করা এই সমস্যার একটি বড় কারণ।
সম্পর্কের টানাপোড়েন: পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও ‘টাচ স্টার্ভেশন’ হতে পারে।
বিচ্ছেদ বা দূরত্ব: ‘ব্রেইকআপ’ বা সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি হলে মানুষের মধ্যে স্পর্শের চাহিদা অপূর্ণ থেকে যায়।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা: কোনো শারীরিক সীমাবদ্ধতা থাকলে অন্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি কঠিন হয়ে পড়ে।
সাংস্কৃতিক বাধা: যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘অপ্টিমাম জয় ক্লিনিক্যাল কাউন্সেলিং’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও থেরাপিস্ট আলেক্সান্ড্রা হোয়েরর বলেন, “বিশেষ করে পুরুষদের ক্ষেত্রে সমাজ অনেক সময় শারীরিক ভালোবাসা প্রকাশে সীমাবদ্ধতা তৈরি করে দেয়।”
করোনা মহামারি ও ‘টাচ স্টার্ভেইশন’
ওকলাহামা ভিত্তিক ‘লিনিয়ার হেল্থ’-এর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. চার্লস সুইট বলেন, “কোভিড-১৯ মহামারির সময় ‘টাচ স্টার্ভেইশন’ ব্যাপকভাবে দেখা দেয়। মানুষ দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে আর হাত মেলায় না, আলিঙ্গন করে না—এই ছোট ছোট আচরণগুলো হারিয়ে গিয়ে স্পর্শের ক্ষুধা তৈরি করেছে।”
কীভাবে বুঝবেন আপনি ‘টাচ স্টার্ভড’?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিচের লক্ষণগুলো দেখা গেলে ধরে নেওয়া যায় আপনি টাচ স্টার্ভেইশন ভোগ করছেন।
শারীরিক স্পর্শের উপকারিতা
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফুল ভিডা থেরাপি’-এর প্রধান ও থেরাপিস্ট ভিভিয়ানা ম্যাকগভার্ন বলেন, “শারীরিক স্পর্শই সবচেয়ে প্রাথমিক উপায়ে নিরাপত্তা, ঘনিষ্ঠতা ও স্থিতিশীলতা বোধ করায়।”
কেউ কেউ শৈশবে যতটা বেশি আদর-স্নেহ পেয়েছে, বড় হয়ে তাদের স্পর্শের চাহিদাও তত বেশি হতে পারে।
একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অন্তরঙ্গতা-বিষয়ক প্রশিক্ষক আয়নে রক বলেন, “স্পর্শ মস্তিষ্কে অক্সিটোসিন ও ডোপামিন নামক হরমোন নিঃসরণ করে, যা সুখের অনুভূতি বাড়ায় ও আমাদের অন্যদের সঙ্গে মানসিকভাবে যুক্ত করে।”
২০২৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শারীরিক স্পর্শ কর্টিসল (মানসিক চাপের হরমোন) নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে
বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তা ও ক্লান্তি কমায়, ব্যথা উপশম করে, ঘুমের মান উন্নত করে, ইতিবাচক অনুভূতি। যেমন- আনন্দ, কৃতজ্ঞতা, আশাবাদ বাড়ায়।
‘টাচ স্টার্ভেইশন’ কমানোর উপায় কী?
র্যাচেল মার্মর ও ডা চার্লস সুইট পরামর্শ দেন, “নিজেকে প্রিয়জনের কাছে প্রকাশ করা উচিত। সরলভাবে বলুন, ‘আমি একটু আলিঙ্গন চাই।’ অনেক সময় কাছের মানুষ বুঝতেই পারে না যে আপনি স্পর্শের অভাবে ভুগছেন।”
ভিভিয়ানা ম্যাকগভার্ন বলেন, “কোনো পোষা প্রাণীকে জড়িয়ে ধরা বা নিয়মিত ম্যাসাজ থেরাপি নেওয়া উপকারী হতে পারে।”
আলেক্সান্দ্রা হোয়ের পরামর্শ দেন, “যেসব কাজের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে স্পর্শ জড়িয়ে আছে, সেগুলোর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করা ভালো। যেমন— নৃত্য ক্লাসে অংশ নেওয়া, খেলাধুলায় অংশগ্রহণ, পশুপাখির যত্নে স্বেচ্ছাসেবা ইত্যাদি।”
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি?
আলেক্সান্দ্রা হোয়ের বলেন, “যখন স্পর্শের অভাবের কারণে দৈনন্দিন কাজ, সম্পর্ক বা মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তখন মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারের সহায়তা নেওয়া উচিত।”
র্যাচেল মার্মর যোগ করেন, “দীর্ঘদিনের একাকিত্ব, দুশ্চিন্তা বা বিষণ্ণতা যদি কাটিয়ে উঠতে না পারেন, তাহলে একজন থেরাপিস্ট বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য স্পর্শের চাহিদা বোঝাতে ও সেটা পূরণে নিরাপদ পথ খুঁজে দিতে পারে।”
ভিভিয়ানা ম্যাকগভার্ন বলেন, “অনেকে স্পর্শের চাহিদা নিয়ে লজ্জা পায়। তবে মানুষ তৈরি করা হয়েছে সম্পর্কের জন্য। থেরাপি সাহায্য করতে পারে নিজের প্রয়োজন বুঝতে, তা পূরণ করতে ও প্রিয়জনদের সঙ্গে সেগুলো ভাগ করে নিতে।”
শারীরিক স্পর্শ কেবল আবেগ প্রকাশের মাধ্যম নয়, এটি মানুষকে বেঁচে থাকার শক্তিও দেয়।
তাই নিজের এই প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে এবং প্রয়োজনে সাহস করে বলতে হবে— ‘একটা আলিঙ্গন দরকার।’
আরও পড়ুন