Published : 11 Apr 2023, 10:35 PM
‘আবারও’। নিদারুণ প্রশ্নহীন এবং অনেক প্রশ্ন জাগানিয়া একটি শব্দ দিয়ে শুরু করতে হচ্ছে এ লেখার। বোরো মৌসুমে বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের পানি না পেয়ে বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন আরও এক সাঁওতাল কৃষক। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের বর্ষাপাড়া গ্রামের কৃষক মুকুল সরেন এক সপ্তাহ ঘুরেও জমিতে সেচের পানি না পাওয়ায় গত ৯ এপ্রিল বিষপানে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন আছেন।
বর্ষাপাড়ার নাম হয়তো অনেকেই শুনেছেন, এই গ্রামেই বাংলাদেশে প্রথম সাঁওতাল ভাষার একটি বিদ্যালয় শুরু হয়েছিল, ‘পরী টুডুর স্কুল’। ওই স্কুলটি এখন বন্ধ আছে। চারধারে খরায় পীড়িত বিরান প্রান্তর আর এক সরু রাস্তার দুই ধারে বর্ষাপাড়া গ্রাম। বর্ষাপাড়া থেকে সামনে এগুলেই ঈশ্বরীপুর গ্রামে দেওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়। আর এর সামনেই বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ। এখানেই ডিপ মেশিনের অপারেটরের ঘর। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আরেকটু এগুলেই নিমঘটু গ্রাম। আপনাদের হয়তো মনে আছে এই নিমঘটু গ্রামের অভিনাথ মার্ডি ও রবি মার্ডি সেচের পানি না পেয়ে অভিমানে আত্মহত্যা করেছিলেন।
২০২২ সালের মার্চে ডিপ মেশিনের অপারেটর ছিলেন মো. সাখাওয়াত হোসেন। অভিনাথ ও রবির পরিবার তার বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা করেছিল। কিছুদিন কারাগারে থেকে এখন জামিনে আছেন ওই সাখাওয়াত। সেই ঘটনার পর বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ সাখাওয়াতকে বাদ দিয়ে হাসেম আলী বাবুকে নতুন অপারেটর হিসেবে নিয়োগ করে। মুকুল সরেনের ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাখাওয়াত আর হাসেমের মধ্যে পার্থক্যটা লাউ আর কদুর মতো। হাশেম আলী বাবুও আগের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনের মতোই সাঁওতাল কৃষকদের জমিতে পানি দেওয়া নিয়ে বৈষম্য করছেন। অভিনাথকেও পানি না দিয়ে আগের অপারেটর বিষ খেয়ে মরতে বলেছিলেন। আর এবার ঘটনার দিন মুকুল সরেন যখন নতুন অপারেটর বাবুর কাছে যান পানি চাইতে তখন বাবু একটি বিষের বোতল মুকুলের হাতে দিয়ে সেই বিষ তার নিজের জমিতে ছিটিয়ে দিতে বলেন। বাবু বিনেপয়সায় একটু কাজ করিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। মুকুল বিষের বোতলটি নিলেন। কিন্তু তা বাবুর জমিনে না ছিটিয়ে বলেছিলেন, পানি না দিলে এই বিষ খেয়েই মরবেন।
মুকুল অবশ্য বিষপানের কয়েকদিন আগে থেকেই তার জমিতে পানি দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন বলে দেওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেলাল উদ্দীন সোহেলে গণমাধ্যমের কাছে জানিয়েছেন। মুকুল তার কাছেও পানি না পাওয়ার ব্যাপারে দুদিন অভিযোগ জানিয়েছিলেন। চেয়ারম্যান একজন ইউপি সদস্যকে মুকুলের জমি দেখতে পাঠিয়েছিলেন এবং তিনি এসে জানিয়েছিলেন ওই জমিতে আরও কয়েকদিন পর পানি দিলে চলবে। ধরে নিলাম চেয়ারম্যান খোঁজ নিয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনার দিন কী করলেন? চেয়ারম্যানের নিজের ভাষ্য অনুযায়ী ওই দিনও তিনি শুনেছেন মুকুল পানি না পেয়ে বিষের বোতল নিয়ে আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কী নিদারুণ পরিহাস! একজন জনপ্রতিনিধি, যিনি মুকুল-অভিনাথ-রবিদের ভোটে নির্বাচিত হন; আর এমন বিষয় জানার পরেও তার নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে নিরুদ্বিগ্ন থাকেন। অভিনাথ ও রবির আত্মহত্যার পর মুকুলের বিষপানের ঘটনা প্রমাণ করে বরেন্দ্র অঞ্চলের সেচব্যবস্থাপনা কেবল পানির প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে না, বরং সমাজে বিদ্যমান বহু কাঠামোগত বৈষম্যও এর সঙ্গে জড়িত। প্রতি বছর অন্ততপক্ষে বোরো মৌসুমে বরেন্দ্র অঞ্চলের পানিসেচব্যবস্থাপনাকে অনেক বেশি সতর্ক ও সংবেদনশীল হওয়া জরুরি। আর এ বিষয়ে লাগাতার অবহেলা ও বঞ্চনা যদি চলতেই থাকে, ভবিষ্যতে বোরো মৌসুমে পানিবঞ্চিত সাঁওতাল কৃষকের আত্মহত্যা একটা ‘নিয়মিত ঘটনায়’ পরিণত হতে পারে। কাঠামোগত বৈষম্য এবং বিদ্যমান অধিক সেচনির্ভর কৃষিপ্রকল্পের যন্ত্রণাকে আড়াল করে, জলবায়ু পরিবর্তনের ঘাড়ে পানিহীনতার সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে আমরা কী সেই নির্দয় পরিস্থিতির অপেক্ষা করছি?
কী ঘটেছিল ২০২২ সালে?
মুকুল সরেনের আগে পাশের নিমঘটু গ্রামে দুই সাঁওতাল কৃষকের বিষপানে আত্মহত্যার ঘটনাটি ঘটেছিল ২০২২ সালের ২৩ মার্চ। অভিনাথ মার্ডি বরেন্দ্র এলাকার অন্যসব সাঁওতাল পরিবারের মতোই কার্যত এক ভূমিহীন পরিবারের সদস্য। অভিনাথের মৃত্যুর পর তার স্ত্রীর করা মামলার এজাহার বিবরণ থেকে জানা যায়, অভিনাথের পরিবার ৭নং দেওপাড়া ইউনিয়নের ঈশ্বরীপুর মৌজার ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন ঈশ্বরীপুর ২নং বরেন্দ্র ডিপকলের আওতাধীন ২৫ কাঠা জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করতেন। জমিতে পানিসেচের প্রয়োজন হওয়ায় অভিনাথ অভিযুক্ত আসামি ডিপমেশিন অপারেটরকে জানান। ১০/১২ দিনেও পানি না পাওয়ায় জমির চারা নষ্ট হতে থাকে। ঘটনার দিন বিকেল চারটায় অভিনাথ ডিপকলের কাছে এসে অভিযুক্ত আসামির কাছে জানতে চান কেন তাকে পানি দেয়া হচ্ছে না। অভিযুক্ত আসামি অভিনাথকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং বলেন, ‘আমি তোর জমিতে পানি দেব না, তুই বিষ খা গা’। বিষপানের পর বাড়িতে আনার পর রাতে অভিনাথ মারা যান। রবি মার্ডিকে ঘটনাস্থল থেকে ধরাধরি করে রাজশাহী মেডিকেলে আনা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবি মার্ডি মারা যান ২০২২ সালের ২৬ মার্চ রাতে।
কর্তৃপক্ষের দায় ও দরদ
বরেন্দ্র অঞ্চলে পানিবঞ্চিত কৃষক বারবার আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে, অথচ আমাদের নীতিপ্রক্রিয়া কিংবা নাগরিক প্রতিক্রিয়া এসব ঘটনায় নিদারুণভাবে নিশ্চুপ। এমনকি এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভাষ্য গণমাধ্যমে যতটুকু এসেছে সেসব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কৃষকের এই নিদারুণ মৃত্যুযন্ত্রণায় তাদের কোনো দায় বা দরদ নেই। মুকুল সরেনের ঘটনায় গণমাধ্যমের কাছে বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক জানান, ‘...বিষ এত সস্তা নাকি? আবার বিষ খেয়েছে কেন? গত বছরের পর তো ডিপের অপারেটর বাদ দিলাম, আবার কেন এই ধরনের ঘটনা ঘটল?’ এর আগে অভিনাথ মার্ডি ও রবি মার্ডির আত্মহত্যার ঘটনায় বিএমডিএ-এর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তখন গণমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘...পানির অভাবে তাদের জমির ধান মারা যায়নি, সেই শোকে তারা বিষপান করেছেন এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়, পানি দেয়ার ক্ষেত্রে অপারেটরের কোনো অনিয়ম থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ দেরিতে হলেও অভিনাথ ও রবি মার্ডির আত্মহত্যার ঘটনাকে কৃষি মন্ত্রণালয় বেশ গুরুত্ব সহকারে নিয়েছিল এবং তদন্তের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় চার সদস্যের একটি কদন্ত কমিটি গঠন করে কাজ করেছিল। আশা করি মুকুল সরেনের ঘটনাতেও কর্তৃপক্ষ তৎপর হবেন এবং এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি কর্মসূচিকে সংবেদনশীল চিন্তা ও কাঠামোতে বিন্যস্ত করবেন।
অপারেটর বদলাচ্ছে, জাত্যাভিমান নয়
তথাকথিত সবুজবিপ্লবের পর যখন যন্ত্রনির্ভর পাতালপানির সেচ চালু হলো তখন এই নয়া সেচব্যবস্থা স্থানীয় ক্ষমতা কাঠামোকে একরতফাভাবে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করল। সমাজে বিদ্যমান শ্রেণিসম্পর্ক ও বিরাজিত কাঠামোগত বৈষম্য পাতালপানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আরও পোক্ত হলো এবং কোথাও কোথাও এটি দ্বন্দ্ব সংঘাতের নয়া মেরুকরণ উসকে দিল। কারণ বিএমডিএ-এর মেশিনঘরগুলো থেকে সবসময় পানি দেয়া হয় না। প্রয়োজন ও চাহিদা মোতাবেক একটি রুটিন ও সিরিয়াল থাকে। কিন্তু দেখা যায় এলাকা, শ্রেণি ও বর্গভেদে হরহামেশা এর ব্যত্যয় ঘটে। চাহিদা ও নিয়ম মোতাবেক সবকিছু হাজির করার পরও কিছু মানুষ দিনের পর দিন পানির জন্য অপেক্ষা করেন। পানিশূন্যতায় জমিন চৌচির হয়ে যায়। চোখের সামনে রক্তজল করা ফসল মরে যায়। বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামগুলোতে ঘুরলে এমন অভিযোগ হরহামেশাই পাওয়া যায়। বিশেষত গরিব, নারী, আদিবাসী, ভূমিহীন ও প্রান্তজনের সঙ্গে পানি সরবরাহ নিয়ে এমন বৈষম্য করা হয়।
২০২৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নিমঘটু ও বর্ষাপাড়া গ্রামে সরেজমিনে দেখতে পাই বাঙালি কৃষকদের তুলনায় আদিবাসী জমিগুলো সেচের পানি কম পাচ্ছে। অভিনাথ মার্ডির বাড়িতে তার ছোট ভাই হরেন ও মাইকেল মার্ডি পানির অভাবে ধানের চারা বাড়িতে বাঁশঝাড়ের ছায়ায় স্তূপ করে রেখেছিলেন। বর্ষাপাড়ার সুধীর মার্ডিকে তার খরখরে জমিনে কোদাল হাতে বিমর্ষ বসে থাকতে দেখি। ২ বিঘা জমিনে পানির জন্য কয়েকদিন অপারেটরের কাছে ঘুরেও তখন পানি পাননি। অথচ এই পানি বিনামূল্যে কাউকে দেয়া হয় না, সদস্যদের নামে যে পানির কার্ড আছে সেখানে টাকা রিচার্জ করে পানি কিনতে হয়। কিন্তু দেখা গেছে, কেবল নিমঘটু বা বর্ষাপাড়া নয়; বরেন্দ্রজুড়ে আদিবাসী ও প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে পানি দেয়াতে বৈষম্য করা হয় বেশি। মুকুল সরেনের বিষপানের ঘটনায় অভিযুক্ত নতুন অপারেটর বাবু মুকুলের জমিতে পানি না দেয়ার কথা স্বীকার করেছেন গণমাধ্যমের কাছে। তবে এখানেও তিনি সেই আগের অপারেটরে মতোই আবারও ঔপনিবেশিক কায়দায় ‘দেশী মদের’ গল্প ফেঁদেছেন।
বিশ্বজুড়ে কৃষক আত্মহত্যা
আত্মহত্যা বিষয়ক বহু গবেষণা জানাচ্ছে, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াতেও অন্যান্য পেশার চেয়ে কৃষকরাই আত্মহত্যার ঝুঁকিতে বেশি থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)’ ২০২০ সালে প্রকাশিত গবেষণাতে জানাচ্ছে, অন্যান্য পেশাজীবীর চেয়ে কৃষিপেশায় আত্মহত্যা বেশি। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, ১৯৮০ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৫০০ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। অস্ট্রেলিয়াতে চার দিনে একজন, যুক্তরাজ্যে সপ্তাহে একজন এবং ফ্রান্সে দুই দিনে একজন কৃষক আত্মহত্যা করে।
ভারতের ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’র হিসেবে ১৯৯৫ থেকে প্রায় তিন লাখ (২,৯৬,৪৩৮ ) কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। দেখা গেছে মহারাষ্ট্র, উড়িষ্যা, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট এবং ছত্রিশগড়ে কৃষকের আত্মহত্যার পরিস্থিতি ও প্রবণতা বেশি। এমনকি বাংলাদেশেও আত্মহত্যার খতিয়ানে কৃষকদের সংখ্যাই বেশি। ‘সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশান অ্যান্ড রিসার্চ’ ২০১৬ সালের এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে সংগঠিত আত্মহত্যার ঘটনায় প্রায় ৫৫ ভাগই কৃষক বা কৃষিশ্রমিক। কিন্তু বিশ্বজুড়ে এত কৃষক আত্মহত্যা কেন?
ভারতে কৃষক আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান বিষয়ে বহু গবেষণায় দেখা গেছে ফসলহানি, ঋণের বোঝা, বিটিতুলার মতো জেনেটিক ফসল চাষ, খরা, দুরারোগ্য ব্যাধি, কন্যাদায়গ্রস্থতা, পারিবারিক কলহ ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে আত্মহত্যা হয়ে থাকে। ডংগ্রি ও দেশমুখ মহারাষ্ট্রের বিদর্ভে কৃষক আত্মহত্যার কারণ হিসেবে দুর্বল সেচব্যবস্থাকেও দায়ী করেছেন (দেখুন: জার্নাল অব ইনজুরি অ্যান্ড ভায়োলেন্স রিসার্চ, জানুয়ারি ২০১২, ৪/১, পৃ.২-৫)। অনাবৃষ্টি , খরা ও দুর্বল সেচব্যবস্থার কারণে ফসলহানি হয়, ঋণের চাপ সহ্য করতে না পেরে কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। পি ঘোষ (২০১৩), আর গাগদেকার (২০১৩), এস সোয়াইন ও অন্যান্যরা (২০১৭) কৃষক আত্মহত্যার পেছনে থাকা এমন কারণগুলো খুঁজে বের করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও খরার কারণে ১৯৮৩ এবং ১৯৮৮ সালে কৃষকের আত্মহত্যা বেড়েছিল।
বাংলাদেশে কৃষক আত্মহত্যার যে খবরগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সেসব খবর বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় কৃষিকাজের মাধ্যমে পরিবারের চাহিদা মেটানো সম্ভব না হওয়া, কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, নানামুখী সামাজিক বঞ্চনা, জলবায়ুজনিত সংকট, ঋণের চাপ এরকম জটিল কারণ গুলোই কৃষককে আত্মহত্যার মতো বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। অভিনাথ মার্ডি ও রবি মার্ডির আত্মহত্যা এবং মুকুল সরেনের আত্মহত্যার চেষ্টা খরাপীড়িত বরেন্দ্র অঞ্চলের পানিহীনতা ও পানিবঞ্চনাই কারণ হিসেবে বিবৃত করেছেন তাদের পরিবার ও সমাজ।
গণি মিয়া, অভিনাথ, রবি, নাথা দাস কিংবা মুকুল সরেন
গণি মিয়ার কথা মনে আছে? সেই যে আমাদের শৈশবের পাঠ, গণি মিয়া একজন গরিব কৃষক, তাহার নিজের জমি ছিল না বলিয়া অন্যের জমি চাষ করিত। শৈশবের সেইসব পাঠ্য এখন নেই। কিন্তু গণি মিয়ারা আছেন। এখনও তাদের জমি নেই, অন্যের জমিতে চাষ করেন। বীজ, বিষ, সেচের পানি কিনতে ঋণ করেন। ফসলহানি হলে কেউ তার পাশে দাঁড়ায় না। সারের জন্য জীবন দিতে হয়। পানির জন্য বিষপান করতে হয়।
কৃষকের আত্মহত্যা এবং গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে ২০১০ সালে ‘পীপলী লাইভ’ নামে অনুষা রিজভির একটি ছবি মুক্তি পায়। আমির খান প্রোডাকশনস ছবিটি প্রযোজনা করেছিল। ৮৮তম একাডেমি পুরস্কার অনুষ্ঠানে সেরা বিদেশী চলচিত্র বিভাগেও প্রদর্শিত হয় ছবিটি। ভারতের খরাপীড়িত পীপলী গ্রামের এক গরিব কৃষক নাথা দাস মানিকপুরীর পরিবারের নিদারুণ ঘটনার ভেতর দিয়ে ছবিটি এগিয়ে যায়। খরা, অনাবৃষ্টির কারণে পীপলী গ্রামের কৃষি এক জটিল অবস্থা পাড়ি দিচ্ছিল। ফসলহানি বাড়িয়েছিল দারিদ্র্য। কৃষকদের ওপর বাড়ছিল ঋণের চাপ। পানিহীনতা, ঋণের বোঝা ও কৃষিকাজ না করতে পেরে নাথা দাস আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ঘটনাটি গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, ঘটনাটি নিয়ে রাজনৈতিক সংগঠনের দ্বন্দ্ব উসকে ওঠে, নাগরিক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু কেউ পীপলী গ্রামের পানিহীনতার মতো মূল সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসে না। ছবির শেষে দেখা যায় নাথা দাস গ্রামে টিকতে না পেরে একজন দিনমজুর নির্মাণশ্রমিক হিসেবে শহরের ভিড়ে হারিয়ে যায়।
অভিনাথ মার্ডি, রবি মার্ডি বা মুকুল সরেন কেউ বিষপান করে ঠিক করেননি। বঞ্চনা, দুঃখ, ক্ষোভ, দুর্যোগ সব নিয়েই জীবনসংগ্রাম। হয়তো খরাপীড়িত বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে পানিবঞ্চনার কারণে টিকতে না পেরে শহরে এসে নাথা দাসের মতো তারাও হারিয়ে যেতেন কোনো কোনো বস্তিতে। বরেন্দ্র অঞ্চলে পাতালপানির আধার অনবরত শূন্য হচ্ছে। মেশিন দিয়ে টেনে তুলে ব্যবহার হচ্ছে পাতালপানি। ভূউপরিস্থ পানির আধারগুলো অনেক আগেই বিলীন হয়েছে। প্রবল পানিসংকটের ভেতর কাঠামোগত বৈষম্যের কারণে বিষের বোতল হাতে পানিবঞ্চিত প্রান্তিক মানুষের সারি যদি ক্রমশ দীর্ঘ হতে থাকে, দায় কে নেবে? অভিনাথ, রবি বা মুকুল সরেনের মৃত্যুযন্ত্রণা বরেন্দ্রভূমির পানিহীনতার অশনি সংকেত দিচ্ছে বারবার। কবে আমরা শুনতে পাবো?