Published : 09 Jul 2013, 06:16 PM
সব মানুষই সমান মূল্যবান আর সকলের রয়েছে সমান অধিকার– মূলত এ আদর্শের ভিত্তিতে গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সবকিছু হয় নিয়মতান্ত্রিকভাবে, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের মাধ্যমে। এখানে একক সিদ্ধান্ত বা জোর-জবরদস্তির কোনো সুযোগ নেই। অন্তত তত্ত্বগতভাবে। তাই গণতন্ত্রের জন্য, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য আধুনিক মানুষের মধ্যে আকুতির শেষ নেই।
রাষ্ট্রযন্ত্র ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে যারা মাথা ঘামায় তারা সবাই চায় দেশে গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক শাসন বজায় থাকুক। আমরাও তাই চাই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের দেশে এক ধরনের বিকৃত গণতন্ত্র জগদ্দল পাথরের মতো চেপে আছে। যখন যে দল বা জোট দেশপরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা গণতন্ত্রচর্চায় শোচনীয় রকম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এর ফলে সংকটে পড়েছে দেশ।
আপাত গণতান্ত্রিক বাতাবরণে বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলগুলো সারাক্ষণ গণতন্ত্রের জন্য প্রাণপাত করলেও দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা বড় বেশি দেখা যায় না। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, কিন্তু সব ব্যাপারে স্বচ্ছতা, নিয়মতান্ত্রিকতা ও সততার চর্চা ছিল, একথা কেউ দাবি করবে বলে মনে হয় না। সব রাজনৈতিক দলেরই গঠনতন্ত্র আছে এবং গঠনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক উপায়ে দল পরিচালনার কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু কার্যত এসব বিধান কাগজেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোতে জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠনের জন্য নিয়মিত নির্বাচন হয় না, কার্যক্রম নির্ধারণ ও মূল্যায়নের জন্য নিয়মিত বার্ষিক অধিবেশনও অনুষ্ঠিত হয় না। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল, শীর্ষ পদে একই ব্যক্তির অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা এবং তার ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দল পরিচালনা। গণতন্ত্র নয়, একনায়কতন্ত্রের স্বৈরাচারই দেখা যায় অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের ভেতর।
কোনো কোনো দলে শীর্ষনেতা পরিবারের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যদের দ্বারাই প্রভাবান্বিত হয়েছেন অথবা তাদের স্বার্থকে দলের ওপর স্থান দিয়েছেন এমন দেখা গেছে। ক্ষমতায় গিয়ে সরকার পরিচালনায় পরিবারের সদস্য এবং মুষ্টিমেয় প্রিয়পাত্রদের সুপারিশ, পরামর্শ ও ইচ্ছা রক্ষা করা হয়েছে। এর ফলে দলের ভেতর অসন্তোষ দেখা দিয়েছে এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা এসেছে।
প্রবল প্রভাব ও ক্ষমতার অধিকারী ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বা কোটারির প্রাধান্যের জন্য আর্থিক লেনদেনসংক্রান্ত অনেক কার্যকলাপই শুধু সাধারণ মানুষ নয়, দলের নেতাকর্মীদেরও চোখের আড়ালে থেকেছে। প্রকাশ্যে দৃশ্যমান সরকারের পাশাপাশি সক্রিয় থেকেছে অদৃশ্য বা 'ছায়া সরকার', যার ক্ষমতা ও পরাক্রম বেশি অনুভূত হয়েছে। ফলে সুশাসন নির্বাসনে গেছে এবং অনিয়ম-দুর্নীতি শিকড় গেড়ে একসময় অনেক গভীরে চলে গেছে।
সব প্রধান দল ক্ষমতায় থেকে দেশ পরিচালনায় কম-বেশি এ প্রবণতা দেখিয়েছে। প্রত্যাশা পূরণে চরম ব্যর্থতার কারণে দলগুলো ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছে সাধারণ মানুষের ঘৃণা ও ক্ষোভের শিকার হয়ে। ক্ষমতার মেয়াদ শেষে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সাধারণ ভোটারদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে নিজেদের 'ব্যর্থতার পুরষ্কার' পেয়েছে। যদিও এ ধরনের ঘটনা থেকে কোনো দলকেই কখনও শিক্ষা নিতে দেখা যায়নি।
গত প্রায় দুই যুগ ধরে এই একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। জাতি হিসেবে এটা আমাদের দুর্ভাগ্য বৈ কী!
প্রশ্ন হল, যে ব্যক্তি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, তাকে কি গণতন্ত্রচর্চার ভার দেওয়া যায়? যে দলে গণতন্ত্র চর্চা হয় না, সে দল কি পারে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমুন্নত রাখতে? ভুল মানুষকে ভুল দলকে দায়িত্ব দেওয়া কি ঠিক? সবার আগে তাই আমাদের খতিয়ে দেখা দরকার আমাদের দেশের প্রধান দলগুলোর ভেতর গণতন্ত্র চর্চা আদৌ হয় কিনা।
আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গ
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের নয়, গোটা উপমহাদেশের প্রাচীন একটি দল। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন দলটির জন্ম হয়েছিল একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। গণতান্ত্রিকভাবে সবার সঙ্গে আলোচনা করে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্রের মধ্যে সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা উল্লেখ ছিল। আওয়ামী লীগের বয়স এখন ৬৩ পেরিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে দলের অভ্যন্তরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দলটিতে প্রতিষ্ঠা পায়নি এখনও।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের কাঠামো ও দিকনির্দেশনা সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক। গঠনতন্ত্রের কোথাও একক ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ দেওয়া নেই। কিন্তু দেখা গেছে, গঠনতন্ত্র পাশ কাটিয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ, আর্থিক আয়-ব্যয়ে অস্বচ্ছতা এবং সদস্য হিসেবে অবাঞ্ছিত লোকদের অন্তর্ভুক্তিসহ নানাভাবে গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করা হয়েছে এবং এখনও যা অব্যাহত রয়েছে।
বিশেষ বা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি ছাড়া স্বাভাবিক অবস্থায়ও যথাসময়ে কাউন্সিল অনুষ্ঠান, সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠক, কার্যনির্বাহী সংসদ বা পার্লামেন্টারি বোর্ড প্রভৃতির কার্যক্রম কোনোটাই ঠিকমতো হয়নি। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত আর্থিক আয়-ব্যয়ের কোনো অডিট হয়নি। সদস্য অনুমোদনের জন্য গঠনতন্ত্রে যে নিয়ম আছে, তা মানা হয় না। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কোথাও সদস্য তালিকার সঠিক হিসাব নেই।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে গণতন্ত্রচর্চার যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও তা উপেক্ষা করে দলের নেতা-কর্মী এবং জনগণের প্রতি সুবিচার করা হয়নি। সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে দলীয় প্রধানের ভূমিকা 'একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রতিমূর্তি'তে পরিণত করেছে।
আওয়ামী লীগের প্রধান সাংগঠনিক স্তর বা কমিটি হল কাউন্সিল, জাতীয় কমিটি, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি ও সভাপতিমণ্ডলী। গঠনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ-৬-এ বলা হয়েছে, '(ক) প্রতি তিন বৎসর অন্তর জেলা আওয়ামী লীগসমূহ ও বিভিন্ন মহানগর আওয়ামী লীগ দ্বারা নির্বাচিত নির্দিষ্ট সংখ্যক কাউন্সিলার সমবায়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল গঠিত হইবে।'
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত একবারও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিল হয়নি। প্রতিবারই সময়ের তুলনায় ২-৩ বছর পিছিয়ে কাউন্সিল করা হয়েছে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির তুলনায় আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের দিক থেকে অনেক এগিয়ে। কিন্তু তারপরও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিল বা অন্য যে কোনো বৈঠক না করাই অগণতান্ত্রিক চর্চা করা। যে বৃত্ত থেকে আওয়ামী লীগ বের হতে পারেনি, বের হওয়ার কোনো উদ্যোগ আছে বলেও মনে হয় না!
কাউন্সিল সভার ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্রের ১১ ধারায় বলা হয়েছে, 'ত্রি-বার্ষিক নির্বাচনী অধিবেশন ব্যতীত বৎসরে অন্তত একবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল সভা আহ্বান করিতে হইবে।'
কিন্তু সর্বশেষ আওয়ামী লীগের কয়েকটি কাউন্সিল পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এসব নিয়ম মোটেও পালন করা হয়নি। দলের ১৭তম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর। এর প্রায় ৭ বছর পর ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের ১৮তম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর সাড়ে তিন বছরের মাথায় ২৯ ডিসেম্বর ২০১২ সর্বশেষ ১৯তম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। আর বেশিরভাগ বিভাগ, জেলা, উপজেলা ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়মিত সম্মেলন/কাউন্সিল হয় না।
গঠনতন্ত্রের ২১ ধারায় কার্যনির্বাহী সংসদ সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'সভাপতি, সভাপতিমণ্ডীর সদস্যবৃন্দ, সাধারণ সম্পাদক, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও কোষাধ্যক্ষ নিজ নিজ পদে ত্রি-বার্ষিক কাউন্সিল কর্তৃক কাউন্সিলারদের মধ্য হইতে নির্বাচিত হইবেন। উপরিউক্ত কর্মকর্তা ও কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যগণের কার্যকাল হইবে তিন বৎসর। তবে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত তাঁহারা স্বপদে বহাল থাকিবেন।'
এসব ঘোষণা শুধু কাগজেই বলবৎ আছে; বাস্তবে নেই।
গঠনতন্ত্র পাশ কাটিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগ করে চলেছেন। ১৯৮১ সাল থেকেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি (সভানেত্রী) নির্বাচিত হয়ে আসছেন তিনি। এই ৩২ বছরে এ পদে কেউই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি বা করার ইচ্ছাও দেখাননি। প্রতিবারই শেখ হাসিনা 'সবার সম্মতিতে নির্বাচিত' হয়েছেন।
এ সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাতটি কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। নিম্নতর সাংগঠনিক স্তরগুলোর কাউন্সিলে কমিটি নির্বাচিত হওয়ার বিধান থাকলেও বাস্তবে সেসব কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কারা হবেন তা আগে থেকেই ঠিক করে কার্যকর করার জন্য কেন্দ্র থেকে সভানেত্রী প্রতিনিধি পাঠিয়ে আসছেন। ওই কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি জানিয়ে দেন, নেত্রী চান অমুক সভাপতি ও অমুক সাধারণ সম্পাদক হবেন। সেই অনুযায়ী সংশ্লিষ্টরা 'নির্বাচিত'ও হন!
গঠনতন্ত্রের ২৬ ধারা অনুসারে দলে ৪১ সদস্যবিশিষ্ট একটি কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদ আছে, যার সদস্যদের মনোনীত করেন সভাপতি এবং 'তিনি উপদেষ্টা পরিষদের সহিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে পরামর্শ করিবেন।' কিন্তু বিগত সময়ে দলীয় সভানেত্রী এমন বহুজনকে দলের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন, যাদের সঙ্গে রাজনীতির তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।
দেখা গেছে, দলীয় প্রধানকে পরামর্শদানকারী সংস্থাগুলো কার্যকর না করেই তিনি অবাধে সিদ্ধান্ত নিয়ে আসছেন। প্রতি ছয় মাসে একবার জাতীয় কমিটির সভা আহ্বান আবশ্যিক হলেও গত আড়াই দশকে জাতীয় কমিটির কোনো সভা হয়েছে বলে জানা যায় না। উপদেষ্টা পরিষদটিও আওয়ামী লীগে প্রায় নামমাত্র। দলের 'চিন্তাকোষ' বা 'থিংক ট্যাংক' হিসেবে উপদেষ্টা পরিষদের কাজ করার বিধান আছে গঠনতন্ত্রে। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হওয়ার খবরও কেউ কখনও জানতে পারেনি।
সভাপতি গঠনতন্ত্রের বাইরের লোকদের নিয়ে একটি বেষ্টনী তৈরি করে তাদের পরামর্শে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের পক্ষে কি সম্ভব, দেশে গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠিত করা? গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করা? সম্ভব কি দলের ভেতর গণতন্ত্রচর্চার একটি অবাধ ধারা প্রতিষ্ঠা করা? এ জন্য আমাদের আর কতকাল অপক্ষো করতে হবে?
বিএনপিতে গণতন্ত্রচর্চা
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টায় রমনা রেস্তোরাঁয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যাত্রা শুরু করে। ক্ষমতায় থাকার সুযোগ-সুবিধা-শক্তি-প্রলোভন ব্যবহার করে বিভিন্ন দলছুট ও সুবিধাবাদীদের নিয়ে গঠিত দল বিএনপির মধ্যে গণতন্ত্রচর্চার অভাব গোড়া থেকেই প্রকট।
নিয়মিত কাউন্সিল বা সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের ধারা থেকে দলটি বরাবরই দূরে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে। দল প্রতিষ্ঠার ৩৫ বছরে মাত্র পাঁচবার দলটির কাউন্সিল বা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিএনপির সর্বশেষ ৫ম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ১৬ বছর পর। তাও বিশেষ পরিস্থিতিতে, সেনাসমর্থিত অন্তবর্তী সরকারের চাপ বা সম্মেলন করার বাধ্যবাধকতার মুখে।
এর আগে বিএনপির কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। চলতি বছর পরপর দুই দফা দলের ষষ্ঠ কাউন্সিলের তারিখ ঘোষণা করা হলেও পরে তা বাতিল করা হয়। প্রথমে ৯ মার্চ কাউন্সিলের তারিখ ঘোষণা করা হয়; কিন্তু ভেন্যুসংক্রান্ত জটিলতার কারণে এ তারিখ পরিবর্তন করে ১৯ মার্চ করা হয়। এরপর সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই তা অনির্দিষ্টকালের জন্য তা স্থগিত হয়ে যায়।
অথচ দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পর পর বিএনপির কাউন্সিল হওয়ার কথা। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ (আরপিও) অনুসারে দলের গঠনতন্ত্রে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে কাউন্সিল করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের একটি কথা খুব প্রচার করা হত- ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে রাষ্ট্র বড়'। জীবিতাবস্থায় তারই দ্বারা প্রণীত তার দলের গঠনতন্ত্রে তিনি এক ব্যক্তি তথা চেয়ারপারসনকে দলের চেয়ে অনেক বড় করেই প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন এবং আজ পর্যন্ত এর আর কোনো সংস্কার হয়নি।
অন্য কোনো ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্র অনুসরণ করা না হলেও গঠনতন্ত্রে দেওয়া ক্ষমতা অবাধে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে এ যাবৎকালে বিএনপির চেয়ারপারসনের কোনো রকম ভুল হয়নি। একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগ করে বর্তমান দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়া স্থায়ী কমিটি, উপদেষ্টা কমিটি, নির্বাহী কমিটি ও পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্যদের মনোনীত করেছেন। জাতীয় মহিলা দলে নিজের বোন, যুবদলে নিজের ভাই এবং ছাত্রদলে বোনের ছেলেসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজের পরিবারের ও পছন্দের লোকদের মনোনীত করেছেন।
গঠনতন্ত্রে পদ না থাকা সত্ত্বেও নিজের ছেলে তারেক রহমানকে 'সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব' পদে নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়া গঠনতন্ত্রে বিভিন্ন পদের জন্য নির্ধারিত সংখ্যাকে পাশ কাটিয়ে তিনি তার নিজের লোকজনকে নিয়োগ দিয়েছেন। দলের সহ-সভাপতির পদ ১৫টি থাকার বিধান থাকলেও ২০০৭ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ২৭ জন। গঠনতন্ত্রে ৭ জন সহ-সভাপতির পদ থাকার কথা থাকলেও সে নিয়ম মানা হয়নি। এর আগে গঠনতন্ত্রের সীমা ভেঙ্গে খালেদা জিয়া নিজের ভাই সাঈদ এস্কান্দারকে দলের ভাইস চেয়ারপারসন মনোনীত করেছিলেন।
দলীয় প্রধানের এ 'অলআউট পাওয়ারই' হচ্ছে বিএনপির গঠনতন্ত্রের প্রধান ও ভয়াবহ দুর্বল দিক। একজন ব্যক্তির ক্ষমতা ঘিরে যে দলের গঠনতন্ত্র, সে দল সরকারে গেলে কখনও-ই গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির চর্চা করতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক।
বিএনপির ক্ষেত্রে ঘটেছেও তাই। স্থায়ী কমিটির ১৫ জন সদস্য দলের প্রাণ। তারা যদি একজন ব্যক্তির (চেয়ারপারসন) দ্বারা নির্বাচিত হন, তাহলে দলের ভেতরের গণতান্ত্রিক ধারা বজায় থাকে কী করে?
দলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত গত ২৯ বছরে ৩ বার মাত্র ৩ জন চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছেন। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন জিয়াউর রহমান এবং তার মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার দু'জনেই অনির্বাচিত। এরপর বর্তমান চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া প্রথমে ভারপ্রাপ্ত এবং পরে কাউন্সিলের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। খালেদা জিয়া গত ২৯ বছর ধরে চেয়ারপারসন।
চেয়ারপারসন নির্বাচনের বিষয়ে গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে, জাতীয় কাউন্সিলের সদস্যদের সরাসরি ভোটে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে ২ বছরের জন্য দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হবেন এবং মেয়াদ শেষে একই ব্যক্তি আবারও চেয়ারপারসন নির্বাচিত হতে পারবেন।
কিন্তু এ নিয়ম কখনও-ই মানা হয়নি। বিএনপির প্রতিষ্ঠা থেকে এ পর্যন্ত একবারও চেয়ারপারসন নির্বাচনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। কতদিন পর্যন্ত কাউন্সিল ছাড়া দলের চেয়ারপারসন থাকতে পারবেন, সে সম্পর্কেও কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
১৯৮৪ সালের ১০ মে থেকে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করে আসছেন, যদিও ১৯৮৪ সালে তৎকালীন চেয়ারপাসন বিচারপতি আবদুস সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে দলে নেতৃত্বের সংকট দেখা দেয়। এ অবস্থায় দলের শীর্ষনেতারা ভাইস চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকেই চেয়ারপারসন নির্বাচিত করেন। এর পর দীর্ঘ ২৯ বছর নেতৃত্বে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
গঠনতন্ত্রে বিধান থাকলেও সংগঠনের থানা কার্যালয়গুলোতে প্রাথমিক সদস্য তালিকা এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের সর্বমোট সদস্য সংখ্যা, সদস্যের নাম ও ঠিকানা সংরক্ষণ করা হয় না। নেতারাই জানেন না কে বা কারা তাদের সদস্য। জেলা, থানা, মহানগর, ইউনিয়ন ও গ্রাম কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সরাসরি নির্বাচনের কথা গঠনতন্ত্রে উল্লেখ থাকলেও নির্বাচন তো দূরে থাক, সময়মতো কমিটিগুলো হয় না।
যেসব দলে গণতন্ত্রচর্চা নেই, গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা মানা হয় না, দল চলে অদৃশ্য শক্তির ইশারায় অথবা একক ব্যক্তির ইচ্ছায়– তেমন দলের কাছে আমরা কীভাবে গণতান্ত্রিক শাসন ও গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি আশা করতে পারি?
চিররঞ্জন সরকার: সাংবাদিক, উন্নয়নকর্মী।