Published : 14 Sep 2013, 12:26 PM
ভারত থেকে বাবার সঙ্গে দেশে ফেরার পথে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে ফেলানী মারা পড়ে। সীমান্তের কাঁটাতারে এ কিশোরীর লাশ ঝুলে থাকে বেশ কয়েক ঘণ্টা। এ সংবাদ পত্রিকায় বেরুলে প্রশ্ন ওঠে– এই হত্যা কেন?
বিএসএফ বাহিনীর আদালতে মামলাও হয়। অভিযুক্ত জওয়ানকে মামলার প্রাথমিক রায়ে নির্দোষ দেখানো হয়েছে। এ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মণি বলেছেন, সঠিক বিচার না পেলে আপিল করবেন। হত্যাকাণ্ডটি ভারতীয় আইনে কেমনতর অপরাধ আর বিচারে বাংলাদেশেরই-বা কী করার আছে দেখা দরকার।
বিএসএফ-এর আইনের ২ ধারার (j) উপধারায় 'শত্রু'-র সংজ্ঞায় বলা আছে- "enemy" includes all armed mutineers, armed rebels, armed rioters, pirates and any person in arms against whom it is the duty of any person subject to this Act to take action."
মানে দেশি হোক আর বিদেশি হোক, কোনো নিরস্ত্র ব্যক্তি বিএসএফ-এর শত্রু তালিকাভুক্ত নয়। শুধু ফেলানী নয়, এ পর্যন্ত সীমান্তে যত বাংলাদেশি হত্যা হয়েছে তারা কি সশস্ত্র ছিল? সম্প্রতি ঢাকার এক পত্রিকায় তথ্য এসেছে যে, গত দশ বছরে হাজারের বেশি বাংলাদেশি বিএসএফ-এর হাতে নিহত বা আহত হয়েছে।
বিএসএফ-এর একই আইনে তাদের সদস্যদের কাজের যে রূপরেখা বর্ণিত হয়েছে তা হচ্ছে–
(a) "active duty", in relation to a person subject to this Act, means any duty as a member of the Force during the period in which such person is attached to, or forms part of, a unit of the Force –
(i) which is engaged in operations against an enemy, or
(ii) which is operating at a picket or engaged on patrol or other guard duty along the borders of India, and includes duty by such person during any period declared by the Central Government …
আইনের চোখে শত্রু বলতে ভারত সশস্ত্র কাউকে বোঝে। তাই তাদের আইনসিদ্ধ কাজটির ধরনও অনুধাবন করতে অসুবিধা হয় না। হতভাগা ফেলানী বাংলাদেশের মেয়ে। তাই অভিযুক্ত খালাস পাওয়ায় ব্যাপারটি আইনি বিচারের চেয়ে কাজীর বিচারের মতো ঠেকছে। যেন বড় দেশ ছোট দেশের বিরুদ্ধে অবিচার করেছে। একই সঙ্গে এও সত্য যে, বাংলাদেশি কিশোরী হত্যার রায়ের মাধ্যমে বিএসএফ ভারতের আইনই অমান্য করেছে।
ফেলানী হত্যার সচিত্র খবর প্রথম ভারতের 'আনন্দবাজার' পত্রিকা প্রকাশ করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে এক গরুক্রেতাকে উলঙ্গ করে বিএসএফ-এর চালানো নির্যাতনের ভিডিও প্রকাশ করে সেদেশের 'এনডিটিভি'। ফলে সীমান্তে অহরহ অন্যসব হত্যা-নির্যাতনের ঘটনার মতো এ ঘটনা দুটো ভাবলেশহীন সংখ্যা বনে যেতে পারেনি। ফেলানী হত্যা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয়।
দুদেশের গণমাধ্যম বরাবরই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বরাত দিয়ে খবর ছাপে। তাদের বিবরণগুলোর সঠিকতা সাংবাদিকরা খুব একটা যাচাই করেন কি? ব্যাপারটা যেন ভারত বনাম বাংলাদেশ। বিএসএফ বা বিজিবির চোখই যেন দুদেশের চোখ! গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের স্তম্ভ হিসেবে দেখেও এ মানসিকতা পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
ফেলানীর ঘটনায় প্রথমদিকে ভারতীয় গণমাধ্যমে যে সংবেদনশীলতা প্রকাশ পায় তাকে এগিয়ে নেওয়ার দরকার আছে। জিজ্ঞাসাটি শুরু হতে পারে, সীমান্ত-পারাপার কারা করে? প্রশ্ন জাগে– নিরস্ত্র মানুষের উপর বিএসএফ গুলি কেন চালায়? আর তা শুধুই বাংলাদেশির উপরই বা কেন!
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের দুপারেই স্বজনের বাস এমন অসংখ্য পরিবার রয়েছে। তারা সবসময় পাসপোর্ট নিয়ে এপার-ওপার করে তা নয়। আবার তারা শুধুই বাংলাদেশি নয়, ভারতীয়ও। এমনকি সীমান্তে যে পণ্য পাচার হয়, তাতেও শুধুই কোনো বাংলাদেশির স্বার্থ নয়, কোনো না কোনো ভারতীয়র স্বার্থও জড়িত।
ওরা গরু বেচে, এরা কেনে। ওরা ফেনসিডিল বেচে, এরা কেনে। ওরা শাড়ি বেচে, এরা কেনে। ফেলানীর বাবার মতো অনেকে ওপারে শ্রম বেচতে যায়। ওপার থেকেও আসে অনেকেই। পেঁয়াজ, রসুন, মাছ, অস্ত্র– কোনটি নেই এ তালিকায়? যৌনকর্মী হিসেবে নারীও পাচার হয়।
মনে করবার কোনো কারণ নেই যে, ভারতরক্ষার বা অবৈধ কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের মহান ব্রত নিয়ে বিএসএফ হত্যা-নির্যাতন চালায়! খোঁজ নিলেই মিলবে, এসব অবৈধ গমনাগমনে তারাও সহযোগী। অভিযোগ আছে, গরু প্রতি হাজার টাকা গুনলেই কেল্লা-ফতে। টাকা বাঁচাতে পাচারকারীরা গরুর সংখ্যা নিয়ে জওয়ানদের সঙ্গে ইঁদুর-বেড়াল খেলে। এতেই বাঁধে গোল। এসব দুদেশেই বেআইনি কাজ।
তবে সবচেয়ে অবাক হতে হয়, হতাহতদের পরিচয় দেখে। সংবাদে এসব মানুষ প্রধানত ওপারে 'গরুচোর', আর এপারে 'গরু-ক্রেতা'! এমন কী বিএসএফ-এর ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের নাগরিক ধরার দু-একটি যে ঘটনার উল্লেখ রয়েছে, তাতে তারা সবাই নিরস্ত্র-নিরীহ; নানা কাজে ওপারে গিয়েছিল বলেই উল্লিখিত। কেন ফেনসিডিল বা অস্ত্র-পাচারকারীরা এমন ঘটনার শিকার হয় না?
যে ফেলানীকে নিয়ে এত কথা, কাঁটাতারে ঝুলন্ত তার লাশের পাশের মইটিই বা কার? ফেলানীর বাবা ঘাড়ে করে দিল্লি থেকে ওটি নিশ্চয় আনেননি। কারাই বা মইয়ে উঠিয়ে মই সরিয়ে নেয়? ওপারে কারা গরু বেচে? কারাই বা ফেনসিডিল বেচে? তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই কেন! নিরস্ত্র লোকেরা যখন বেআইনিভাবে সীমান্ত-পারাপার বা বিকিকিনিতে জড়িত হয় তখন তাদের আটক না করে গুলি চালানো কতটা সুবিচার?
আর এটি গুরুতর অপরাধ হলে এতে জড়িত ভারতীয়দের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে না পারাটা ভারতেরই ব্যর্থতা। এমন হত্যার মধ্যেই বিএসএফ-এর কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ থাকায়, সীমান্ত পাচারে তাদের ঘুষ খাওয়ার অভিযোগটি শক্তিশালী হয়। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ফেলানী হত্যার বিচার প্রক্রিয়াটি।
পৃথিবীর এমন কোনো দেশ কি আছে যেদেশে বিনা পাসপোর্টে লোক ঢোকে না? তাদের কি আটক করে জেলে দেওয়া হয়, নাকি দেখামাত্র গুলি করে হত্যা করা হয়? এতে ভারতের আইনি কাঠামোকে থোড়াই কেয়ার করতে বিধিবদ্ধ বাহিনীকে উৎসাহিত করা হচ্ছে না কী? দুদেশের সীমান্তে কি এমন কোনো জরুরি অবস্থা রয়েছে যে গুলি চালানো ছাড়া উপায় নেই?
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে গত বছরের শুরুতে বাংলাদেশের ছেলে হাবিবুরকে যেভাবে উলঙ্গ করে বিএসএফ জওয়ানরা নির্যাতন চালিয়েছিল তা আমরা 'এনডিটিভি' মারফত প্রচারিত ভিডিও-তে দেখেছি। এতে নির্যাতন করে বিকৃত সুখভোগ করার মানসিকতাই প্রকাশ পেযেছে। সমগ্র বিএসএফ বাহিনী, ভারত রাষ্ট্র ও ভারতের আপামর জনগণ এই বিকৃত মানসিকতা ধারণ করে কী করে না তা প্রমাণের দায় তাদেরই।
বাংলাদেশের সীমান্তে হত্যার ঘটনায় ফেলানী মামলাটি বোধহয় প্রথম মামলা। দুটি প্রতিবেশি দেশের সম্পর্কের খাতিরেই শুধু নয়, ভারতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এটি একটি অগ্রগতি হিসেবে দেখা যেত। কারণ ভারতের আইন লঙ্ঘন হওয়ায় মামলাটি হয়েছে। ফেলানীর পরিবার বা বাংলাদেশ এ মামলায় বাদী নয়। এ মামলায় অমিয় ঘোষ নামের কোথাকার কোন হরিদাস পাল অপরাধী কিনা তা আমরা জানি না।
কিন্তু এসব ঘটনা ভারত যে সুশৃঙ্খল সীমান্ত বাহিনী গড়ে তুলতে অসমর্থ তা জানান দেয়। বিএসএফ-এর মতো বাহিনীর কে অপরাধী তা তদন্ত করে শনাক্ত করতে না পারার ব্যর্থতা স্পষ্টতই ভারতের উপর বর্তায়।
আরও বিস্ময়কর হল, অতি মামুলী এক জওয়ানের কাছে হেরেছে কিন্তু আদতে ভারত রাষ্ট্র! গলদটা কোথায়? তদন্ত কর্মকর্তা বা দণ্ডমুণ্ডের কর্তা– সমস্যা যারই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের চাকুরেদের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে ভারত আজ জিম্মি। এ গ্লানি ভারতের, এ পরাজয় ভারতবাসীরও।
তাই ওদেশের জনগণকে ভেবে দেখতে হবে, তাদের দেশটিকে মগের মুল্লুক বানাবে নাকি আইনের শাসন কায়েম করবে? দুদেশের গণমাধ্যমকেই এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ গণমাধ্যম আইনি রাষ্ট্রের স্তম্ভ হতে পারে, কিন্তু সরকারি চাকুরেদের স্বেচ্ছাচারিতার স্তম্ভ নয়। নয়তো ওই চাকুরেদের সব অবৈধ কাজই সমর্থন করতে হয় বা তাদের পক্ষ নিতে হয়।
এ মামলায় বাংলাদেশের আপিল করার সুযোগ কই? বরং কূটনৈতিক উদ্যোগ ও দেশে-বিদেশে মতামত গঠনই মূল কাজ হওয়া দরকার। এরই মধ্যে ফেলানী মামলার রায় পুনর্মূল্যায়নের ঘোষণা দিয়েছে ভারত। তবে ভারতকে ভাবতে হবে, 'জোর যার মুল্লুক তার' এ নীতি নাকি আইনের শাসন– কোন পথে হাঁটবে তারা।
জোরই যদি খাটায়, তবে আর বিশ্বের বড় গণতান্ত্রিক দেশের দাবি করেই-বা কেন? অথবা সভ্যতা-অসভ্যতা নিয়ে এত মাপামাপি কেন?
মুজতবা হাকিম প্লেটো : সাংবাদিক।