Published : 05 Jul 2025, 05:52 PM
“ক্ষমতায় গেলে প্রথম ১৮ মাসে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করবে বিএনপি। বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। ন্যূনতম এসএসসি পাস তরুণদের আইটি খাতে প্রশিক্ষণ দিয়ে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে।”
গত ২৮ জুন, সিলেটের জালালাবাদ গ্যাস অডিটোরিয়ামে আয়োজিত ‘সিলেট বিজনেস ডায়ালগ’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী দলের পক্ষে এই সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যে অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিল সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি।
সেখানে জাতীয় অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ, সম্ভাবনা ও অগ্রগতির রূপরেখা নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, “ব্যবসাকে রাজনীতির বাইরে রাখতে হবে, ফ্যাসিস্টমুক্ত করতে হবে। আমরা সরকারে গেলে প্রথম দিন থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নে কাজ শুরু করব। যারা কৃষিতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী, তাদের সেই সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হবে।”
এতে আরও বলা হয়, কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে রপ্তানির নতুন দিগন্ত খুলে দিতে চায় বিএনপি। অর্থনীতি নিয়ে যে সৃজনশীলতা একসময় বাংলাদেশে ছিল, তা গত ১৭ বছরে ধ্বংস হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। বলেন, আগের মতো রাজনীতি আর চলবে না—মানুষের মনমানসিকতা বদলে গেছে।
এর আগে, ১০ এপ্রিল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজের ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে দেওয়া একটি পোস্টে ‘এক ট্রিলিয়ন ডলার ইকোনমি’ শিরোনামে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন। তিনি জানান, ২০৩৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে এক ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত করার লক্ষ্যে বিএনপি কাজ করছে। সেখানে তিনি আরও বলেন, “জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করতে পারলে প্রথম ১৮ মাসে এক কোটি কর্মসংস্থান বা চাকরির ব্যবস্থা করবে। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই)/মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) লক্ষ্যমাত্রার শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ থেকে জিডিপির দুই দশমিক পাঁচ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।” কর ব্যবস্থা সংস্কার ও জনগণের ওপর করভীতির চাপ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, কর আদায়ে জনগণের আস্থা অর্জনের কৌশল নিয়েও দলটি কাজ করছে।
এসব বক্তব্য নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। কিন্তু প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবতা—এই দুইয়ের ফারাক এখন দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছে। অতীত বলছে, ক্ষমতায় যাওয়ার আগে যারা যতই ভালো কথা বলুক, ক্ষমতায় যাওয়ার পর তারা অনেক কিছুই ভুলে যায়। বিএনপির ক্ষেত্রেও এমন ঘটনার তালিকা অল্প নয়।
১৯৯১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় যায়, তখন তারা তিন জোটের রূপরেখাকে গুরুত্ব দিয়ে মান্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু পরে ওই রূপরেখা কার্যত অগ্রাহ্য করা হয়। মাগুরা-১ আসনের উপনির্বাচন ছিল আরেকটি টার্নিং পয়েন্ট। ওই উপনির্বাচনে যে প্রভাব, হস্তক্ষেপ এবং প্রশাসনিক অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে, তা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর এক গভীর অনাস্থা তৈরি করে। পরে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকার সময়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কয়েকজন নিহত হয়েছেন এবং ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলার বিচার নিয়ে বিএনপির অনীহাও দেশবাসীর মনে তাদের প্রতি সন্দেহের জন্ম দেয়। বিএনপি যদি আওয়ামী লীগকে শত্রু না ভেবে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করত, তাহলে হয়তো পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ এতটা প্রতিশোধপরায়ণ হতো না। রাজনীতির জায়গা থেকে প্রতিশোধের রাজনীতিতে পরিণত হওয়ার দায় দুই দলেরই আছে।তবে বিগত দেড় দশক ধরে ওই ধারা রোধ করতে না পারার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের দায় অনেক।
একটি রাজনৈতিক দলের বিশ্বাসযোগ্যতা তখনই তৈরি হয়, যখন সে নিজের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেয় এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি পরিশোধিত ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা নিয়ে আসে। বিএনপি এখনো সময়ের খুব বাইরে চলে যায়নি। তাদের সামনে সুযোগ আছে নিজেদের এমনভাবে উপস্থাপন করার, যেন জনগণ তাদেরকে কেবল আওয়ামী লীগের ব্যর্থ বিকল্প হিসেবে না দেখে, বরং এক নতুন ও বিশ্বাসযোগ্য সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করতে পারে।
এর জন্য প্রথমেই দরকার আত্মসমালোচনার স্পষ্ট অবস্থান। বিএনপির উচিত একটি আনুষ্ঠানিক দলীয় বিবৃতির মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বলা—কোন ভুলগুলো তারা করেছে, কেন করেছে এবং ওই ভুল থেকে বেরিয়ে আসতে তারা ভবিষ্যতে কী কী পদক্ষেপ নেবে। কথায় কথায় ‘আমরা ভালো, ওরা খারাপ’ এই রাজনীতি দিয়ে এখন জনগণকে বেশি দূর নিয়ে যাওয়া যাবে না। রাজনৈতিক শুদ্ধতার জন্য স্বীকারোক্তি যেমন জরুরি, তেমনি তা বিশ্বাস অর্জনের ভিত্তি নির্মাণেও সহায়ক।
এরপর বিএনপিকে নিজেদের দলে কাঠামোগত সংস্কার আনতে হবে। এখনো দলটির নেতৃত্ব তারেক রহমানকেন্দ্রিক, যিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। এ অবস্থায় দলটি মাঠপর্যায়ে নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে। তরুণ, মেধাবী, জনসম্পৃক্ত এবং রাজনৈতিকভাবে দায়বদ্ধ নেতাদের সামনে আনা ছাড়া আগামী দিনের জন্য দলটি প্রস্তুত হতে পারবে না। দলের নীতিনির্ধারণী পর্ষদে গণতান্ত্রিক চর্চা ও বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। ক্ষমতায় গেলে কীভাবে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা হবে, সংসদে কীভাবে বিরোধী দলের ভূমিকা নিশ্চিত করা হবে—এসব নিয়ে দলীয় কৌশলপত্র জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে হবে।
এক কোটি কর্মসংস্থানের ঘোষণা নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়। কিন্তু বাস্তবায়নযোগ্য না হলে তা ‘গালি দিলে লোক হাসে, প্রশংসা করলেও লোক হাসে’ গোত্রের কথায় পরিণত হয়। তাই বিএনপিকে খোলাসা করতে হবে, এই এক কোটি চাকরি কোন খাতে হবে? প্রযুক্তি খাতে কী ধরনের স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া হবে? এসএসসি পাস একজন তরুণকে কয় মাস প্রশিক্ষণ দিয়ে কীভাবে আইটি খাতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে? বিদেশি সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোকে কীভাবে বাংলাদেশে এনে কর্মসংস্থান বাড়ানো হবে? কতজন লোক কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতে কাজ পাবে? কাঁচামাল রপ্তানির পরিবর্তে ভ্যালু অ্যাডেড পণ্যে রপ্তানি বাড়ানোর পরিকল্পনা কোথায়?
অন্যদিকে, ‘এক ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতি’ গঠনের স্বপ্নও বাস্তবিকভাবে অনেক বড় প্রতিশ্রুতি। এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের ওপরে রাখতে হবে এবং প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আয়বণ্টনের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। দেশের বেকার তরুণদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত না করে, কর ব্যবস্থার সংস্কার না করে, শিক্ষা খাতে দক্ষতা না বাড়িয়ে শুধু ব্যবসাবান্ধব কথা বললে জনগণের আস্থা অর্জন সম্ভব নয়।
এক্ষেত্রে বিএনপির উচিত হবে অর্থনীতিবিদ, উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক রোডম্যাপ তৈরি করা। ওই রোডম্যাপে স্পষ্ট করে দেখাতে হবে—প্রথম ৬ মাসে কী করবে, পরের ১২ মাসে কী করবে; বাজেট কোথা থেকে আসবে, বেসরকারি বিনিয়োগ কীভাবে বাড়ানো হবে, ব্যাংক খাতের সংস্কার কীভাবে হবে।
নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে বিএনপির আন্দোলন দীর্ঘদিনের। কিন্তু দাবি যতই যৌক্তিক হোক না কেন, জনগণ এখন চাইছে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা। তাই বিএনপির উচিত হবে একটি ‘ইলেক্টোরাল রিফর্ম প্রস্তাবনা’ তৈরি করে জনসমক্ষে উপস্থাপন করা। ওই প্রস্তাবে থাকতে পারে নির্বাচন কমিশনের গঠনপ্রক্রিয়ার পরিবর্তন, সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিধান, প্রবাসী ভোটারদের অন্তর্ভুক্তি, ইভিএম বা ব্যালট সংক্রান্ত নিরপেক্ষ নীতিমালা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিএনপিকে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা করতে হবে। ক্ষমতায় গেলে প্রতিশোধ নয়, পরিবর্তনের বার্তা দিতে হবে। প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার হুমকি নয়, বরং গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার আহ্বান জানাতে হবে। দলের অভ্যন্তরেও এমন পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির মানুষ প্রতিনিধি হতে পারবে।
সব মিলিয়ে বিএনপি যদি আগামী দিনের জন্য বাস্তবিক কোনো ভূমিকা রাখতে চায়, তাহলে শুধু ভালো ভালো কথা বললে হবে না। জনগণ এখন দল চায় না, দিক চায়। ওই দিকনির্দেশনার রূপরেখা বিএনপির কাছ থেকে পাওয়ার সময় এখন। তা না হলে এক কোটি চাকরি, এক ট্রিলিয়ন অর্থনীতি কিংবা ফ্যাসিবাদমুক্ত বাজার ব্যবস্থার মতো বড় বড় প্রতিশ্রুতিও কেবল শব্দ হয়েই থাকবে, বাস্তবতার মুখ দেখবে না। অতীতের শিক্ষা যদি ভুলে গিয়ে বিএনপি আবার ওই একই পথে হাঁটে—বক্তব্যে ফুলঝুরি আর বাস্তবে বিভ্রান্তি, তবে অন্য সব সক্রিয় রাজনৈতিক দল এবং জনগণও আর তাদের বিকল্প মনে করবে না। বরং সবাই বলবে: ‘একই কথা, নতুন মুখ।’ বাস্তবায়নের সদিচ্ছা ও রূপরেখা দেখিয়ে বিএনপিকে এই ভাবমূর্তির বদল ঘটাতে হবে। এখনই।