Published : 30 Sep 2013, 12:06 AM
ছোট একটি মেয়ে। মাত্র এগার বছর বয়স। বাবা-মা আদর করে নাম রেখেছিলেন আদুরী। বাবা মারা যাওয়ার পর গরীব মায়ের সংসারে দুবেলা খাবার জুটত না বলে একটু ভালো থাকার আশায় এসেছিল শহরে।
এখন সে শুয়ে আছে হাসপাতালের বেডে। সারা গায়ে তার ব্লেডের আঘাত, গরম খুন্তি দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়ার পোড়া দাগ, নির্যাতনের চিহ্ন। এই ধরনের নির্মম নির্যাতনের শিকার সে হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কোনো জার্মান কনসেনট্রেশন ক্যাম্প কিংবা গুয়ানতানামো বে কারাগারের মতো বন্দি শিবিরে নয়। আশ্চর্যের বিষয়, ঢাকা শহরের পল্লবীর একটি ফ্ল্যাটবাড়িতে।
তাকে নির্যাতনকারীও কোনো গ্যাংস্টার, ডাকাত সর্দার বা কুখ্যাত সাইকো কিলার নয়। তাকে এমন বর্বরভাবে নির্যাতন করেছে মধ্যবিত্ত এক বাঙালি গৃহবধূ। শিশু গৃহকর্মীর ওপর এ ধরনের নির্যাতনও ঢাকায় বা বাংলাদেশে এই প্রথম নয়। এ রকম বা এর চেয়ে বর্বরোচিতভাবে নির্যাতনের খবরও এর আগে প্রকাশিত হয়েছে। কয়েক ক্ষেত্রে মৃত্যুও ঘটেছে ভিকটিমের।
কথাটি বিশেষভাবে উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, এই ধরনের বর্বরোচিত অপরাধের হোতারা লুকিয়ে আছে আমাদেরই চারপাশে। হয়তো আমাদেরই পাশের বাড়িতে বা কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়িতে ঘটছে এ ধরনের বর্বর অপরাধ। নির্যাতনের শিকার হচ্ছে কোনো অসহায় শিশু।
বিষয়টি অ্যালার্মিং এই কারণে যে এই প্রবণতা সমাজের অনেক মানুষের মধ্যেই রয়ে গেছে। মানুষরূপী জানোয়ার এই নির্যাতনকারীরা এই সমাজেরই বাসিন্দা। শিশু নির্যাতন দূর করতে হলে তাই এর সামাজিক কারণগুলোরও মূলোচ্ছেদ করা প্রয়োজন।
একটি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে গৃহকর্মী হিসেবে বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করছে তিন লাখের বেশি শিশু। সংখ্যাটি এর চেয়ে বেশিও হতে পারে। এরা মূলত গ্রামের অত্যন্ত প্রান্তিক পরিবার থেকে আসা শিশু। এদের চেয়ে অসহায় সম্ভবত এই শহরে আর কেউ নেই।
এরা পরিবারের বাবা মা বা আপনজনদের ছেড়ে সামান্য ভাতের আশায় শহরে আসে। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে বাসাবাড়িতে পরিশ্রম করে আর বিনিময়ে পায় শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, নিগ্রহ, লাঞ্ছনা। পরিবার ছেড়ে আসার কারণে প্রথমত সে থাকে অত্যন্ত অসহায় ও ভীতচকিত অবস্থায়।
সেই অবস্থায় তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় ভারি গৃহশ্রম। পান থেকে চুন খসলেই চলে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। গৃহকর্তা, গৃহকর্ত্রী থেকে শুরু করে বাড়ির যে অন্য সদস্যরা রয়েছে তারাও নির্যাতনে পিছিয়ে থাকে না। তবে সাধারণত দেখা গেছে যে, গৃহবধূরা সার্বক্ষণিকভাবে বাসায় থাকে বলে তারাই মূলত এই সব নির্যাতনের মূল হোতা।
কিন্তু কোন মানসিকতা থেকে ঘটছে গৃহকর্মীদের ওপর, বিশেষ করে শিশু গৃহকর্মীদের ওপর এই ধরনের নির্যাতন যা তাকে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে আর ভুলুণ্ঠিত করছে মানবতা!
গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন মূলত দাসপ্রথার অবশেষ রূপে টিকে রয়েছে আমাদের সমাজে। পৃথিবীর সব সমাজেই প্রাচীন ও মধ্যযুগে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। সুমেরীয়, আসিরীয়, মিশরীয়, গ্রিক ও রোমান সভ্যতার অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল মূলত দাসশ্রম। দাসমালিকরা দাসদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালাত, এমনকি তাদের মেরে ফেলেতে বা গুরুতর অঙ্গহানিও ঘটাতে পারত।
দাসদের শিশুরাও দাস বলে মালিকের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হত। শিশুদের ওপর নির্যাতন চলত পুরো মাত্রায়। প্রাচীন রোমে স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে দাসবিদ্রোহ সংঘটিত হয়। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে আফ্রিকা থেকে অসংখ্য মানুষকে আমেরিকায় ধরে নিয়ে গিয়ে দাসে পরিণত করা হয়। আঙ্কেল টমস ক্যাবিন, দ্য রুটস ইত্যাদি উপন্যাসে দাসদের ওপর নির্মম নির্যাতনের চিত্র পাওয়া যায়।
ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র একসময় দাসপ্রথা ছিল। সব রকম শ্রমেই দাস ব্যবহৃত হত। দাসবাজারে শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষ কেনাবেচা চলত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে চা বাগানে শিশু থেকে শুরু করে সক্ষম নরনারীকে দাস বা বাধ্যতামূলক শ্রমিক হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হত।
উনবিংশ ও বিংশ শতকের সূচনালগ্ন্ওে এদেশে দাসী-বাঁদী রূপে মানুষের শ্রম শোষণের রীতি ছিল। তাদের ওপর যথেচ্ছা নির্যাতনও চালান হত। দাসপ্রথা আইনত নিষিদ্ধ হয়েছে বহু আগেই। কিন্তু অনেক মানুষের মনের কোঠায় এখনও লালিত হচ্ছে মানুষকে দাসরূপে ব্যবহারের অশুভ প্রবণতা।
গ্রামের দরিদ্র ও অসহায় পরিবার থেকে শিশুদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে শহরে নিয়ে এসে গৃহকর্মীরূপে কাজ দেওয়ার নাম করে তাদের ওপর যে নির্মম নির্যাতন চালানো হচ্ছে তা দাসযুগের মতোই। ভাবতে অবাক লাগে, যে গৃহকর্ত্রীরা অসহায় শিশুটির ওপর নির্যাতন চালান তাদের নিজেদেরও হয়তো ওই বয়সের বা তার চেয়ে ছোট বা বড় বয়সের সন্তান রয়েছে। একবারও কি অসহায় শিশুটির ওপর নির্যাতন চালানোর সময় তাদের নিজের সন্তানের মুখ মনে পড়ে না? না কি দরিদ্র বলে সে শুধুই নির্যাতনের সামগ্রী, কোনো মানুষ নয়?
সবাই যে নির্যাতন করে তা বলছি না। যারা করে আমার প্রশ্নটি তাদের উদ্দেশেই। 'খারিজ' নামে পশ্চিমবঙ্গের একটি চলচ্চিত্রের কথা মনে পড়ছে। সেখানেও এমনি এক শিশু গৃহকর্মীর কাহিনি ছিল। শিশুটির মৃত্যু হয়েছিল নির্যাতন ও অবহেলায়। তার মৃত্যুর কেসটি খারিজ হয়ে যায় প্রমাণের অভাবে।
আমাদের দেশেও অসংখ্য শিশু এমনিভাবে নির্যাতিত হয়েছে। মৃত্যুবরণ করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিচারের বাণী নিরবে-নিভৃতে কেঁদেছে। হয়তো ভিকটিমের পরিবারকে সামান্য কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে শিশুটি ভিকটিম হয় তার পরিবার থাকে হতদরিদ্র। নির্যাতনকারী বা তার পরিবার থাকে প্রভাবশালী ও তুলনামূলকভাবে ধনী। তাই নির্যাতন করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে পার পাওয়া যায় খুব সহজেই। আইনি লড়াই চালাবার মতো আর্থিক সংস্থান থাকে না ভিকটিম ও তার পরিবারের।
শিশুশ্রম তুলনামূলকভাবে সস্তা বলে গৃহকর্মী হিসেবে শিশুদের রাখা হয়। আরেকটি কারণ হল শিশু দুর্বল ও অসহায় বলে তার ওপর নির্যাতন চালানো খুব সহজ। ইচ্ছা হলেই শিশুটিকে মারধর করা তো কোনো বিষয়ই নয়। গুরুতর জখম না হলে এটা যে কোনো নির্যাতন তা-ই মনে করা হয় না। শিশুটি কোনো রকম প্রতিবাদ করলে আরও বেশি নির্যাতনের শিকার হয়।
আমাদের দেশে বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু যে শিশুরা গ্রাম থেকে শহরে চলে আসছে গৃহশ্রমিক হিসেবে তারা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমি নিজে অনেক গৃহকর্মী শিশুর সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের অনেকের গৃহকর্ত্রীই তাকে বাড়ি থেকে বের হতেই দেয় না, স্কুলে যাওয়া তো দূরের কথা। আবার অনেকের গৃহকর্ত্রী বলেছে, ওকে কাজ করার জন্য আনা হয়েছে, লেখাপড়া শেখানোর জন্য তো আনা হয়নি!
মোট কথা, এই শিশুরা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত। এই ধরনের অধিকাংশ শিশুর থাকা ও শোয়ার জন্য কোনো আলাদা ঘর নেই। এরা সাধারণত রান্নাঘর বা বারান্দার মেঝেতে শোয়। অথবা গৃহকর্ত্রীও পরিবারের কোনো সদস্যের ঘরের মেঝেতে শোয়। এরা অনেক ক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনেরও শিকার হয়।
অনেক পরিবারে এদের পিচ্চি বা এ ধরনের অবজ্ঞাসূচক নামে ডাকা হয় এবং নানা রকম ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা হয়। চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি, গরম খুন্তি দিয়ে ছ্যাঁকা, রুটির বেলুন দিয়ে আঘাত– এগুলো অনেক বাড়িতে এদের নিত্য পাওনা। অনেক সময় পরিবারের শিশু সদস্যরাও এদের ওপর যথেচ্ছ নির্যাতন চালায় এবং একজন নির্যাতনকারী হিসেবে বেড়ে ওঠে।
সাধারণত দেখা যায় যে নারীরা এই ধরনের নির্যাতন চালায় সমাজে তার কোনো নিজস্ব কর্মক্ষেত্র বা বলয় নেই। একটি অসহায় শিশুর ওপর নির্যাতন চালিয়ে তারা ক্ষমতার স্বাদ উপভোগ করে।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই শিশুদের সব রকম অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে।
গৃহকর্মী হিসেবে কর্মরত এই শিশুদের রক্ষার জন্য শিশুশ্রম সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত। গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি তাদের কোনো আয়মূলক কর্মপ্রকল্পে বা হস্তশিল্প শিক্ষা প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট করতে পারলে দুমুঠো ভাতের আশায় তাদের গৃহকর্মী হতে হয় না।
আরেকটি কথা গৃহশ্রম কি নিজে করা যায় না? পরিশ্রম খুব বেশি বোধ হলে খণ্ডকালীন গৃহকর্মী বা সাহায্যকারী থাকতে পারে। কিন্তু একটি শিশুর ওপর কাজ চাপিয়ে দিয়ে নিজে পায়ের ওপর পা তুলে আয়েশ করার এই দাসমালিকসুলভ মনোবৃত্তি অত্যন্ত ঘৃণ্য ও পরিত্যাজ্য। একটি ব্যক্তিগত উদাহরণ দিই। আমার বাড়িতে কোনো গৃহশ্রমিক নেই। তাতে কিন্তু পরিশ্রম করে আমি মরে যাইনি।
আর শিশুশ্রম ও শিশুর ওপর নির্যাতন নির্মূলের দায়দায়িত্ব সরকারসহ সমাজের সকলের। শিশুনির্যাতনকারীর জন্য চাই দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি। যেন পরবর্তীতে একটি শিশুকে নির্যাতন করার আগে ওই শাস্তির কথা স্মরণ করে নির্যাতনকারী নিজেকে সংযত করতে বাধ্য হয়। শিশুর গায়ে আঘাত করার আগে তার হাত কেঁপে ওঠে। আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে এরা যেন রেহাই না পায় বা দরিদ্র বলে ভিকটিমের পারিবারকে ভয়ভীতি দেখিয়ে চুপ করিয়ে দিতে না পারে।
দ্বিতীয়ত, নিজের বাড়িতে, আশেপাশের বাড়িতে, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে কোনো শিশু নির্যাতিত হচ্ছে কি না তা দেখার এবং সে বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানানোর দায়িত্ব আমাদের সকলের। আর নিজের গৃহশ্রম নিজে সম্পাদনের মানসিকতা গড়ে ওঠা খুব বেশি প্রয়োজন। প্রত্যেকের কাজ প্রত্যেকে করে ফেললে গৃহকর্মী রাখার বিশেষ করে শিশু গৃহকর্মী রাখার অমানবিক প্রথার উচ্ছেদ হতে দেরি হবে না।
আদুরীর মতো শিশুরা আদর, স্নেহ, মমতালাভের অধিকারী। শিশুদের ওপর আর কতদিন এই র্ববর নির্যাতন চলবে প্রশ্নটি না হয় রইল সকলের বিবেকের কাছেই।
শান্তা মারিয়া : কবি, সাংবাদিক।