Published : 13 Nov 2010, 03:27 PM
সামন্তযুগে রাজারা অমাত্যবর্গ পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতেন। এই অমাত্যবর্গের একটি প্রধান কাজ ছিল রাজার তোষামোদ করা। বস্তুত তোষামোদের মাধ্যমেই তারা তাদের পদ বা অবস্থান ধরে রাখতেন। সামন্তযুগে জমিদারদের ভিতরেও একই সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। তারা প্রশংসা শুনতে ভালবাসতেন, চারপাশের কর্মচারীদের একটি প্রধান কাজ ছিল জমিদারের গুণকীর্তন করা, তিনি যে মহান, তা বারংবার বলা। রাজা বা জমিদারদের বেশীরভাগেরই তেমন কোন কাজ ছিল না, অলসভাবে, আঙ্গুরফল মুখে পুরে, বিলাসী জীবন কাটিয়ে গেছেন তারা।
চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে তারা ভালবাসতেন। রাজা বা জমিদার আঙ্গুরফলকে মিষ্টি বললে মিষ্টি, টক বললে তারাও টকই বলতেন। জমিদার বা রাজাদের খামখেয়ালীপনার জন্যও কেবল প্রজাসাধারণের নয়, ঐ চাটুকারদেরও অনেক বিড়ম্বনা সইতে হয়েছে। তবে তোষামোদকারীদের প্রাপ্তির দিকটি অনেক বেশী বলেই তারা ঐসব বিড়ম্বনা, গঞ্জনা সয়ে গেছেন। সামন্তযুগে অমাত্যবর্গের মাঝে মোসাহেবের স্বীকৃত পদ ছিল, যদিও বাস্তবতা হল উজির থেকে শুরু করে সকল পারিষদকেই রাজার তোষামোদি করতে হত। না করে উপায় কী? পদ হারানো ও সুবিধাবঞ্চিত হওয়া ছাড়াও তখন গর্দান হারানোর ভয় ছিল।
রাজাদের শাসনামল বহু আগেই আমরা পার হয়ে এসেছি। সামন্তযুগও অবসিত। কিন্তু রয়ে গেছে তোষামোদের সংস্কৃতি। এখন রাজনীতির মাঠে, অফিসে-আদালতে, রাজা বা জমিদারদের ভূতেরা আজো ভিন্ন নামাবলী গায়ে চাপিয়ে একইভাবে সিংহাসনে আসীন। তারা প্রশংসা চান, তোষামোদ চান, খাঁটি প্রশংসা আর ভেজাল তোষামোদের মাঝে যে দূরত্ব রয়েছে তা উপলব্ধি করেও চান। অতীতের তুলনায় ক্ষমতার রূপ পাল্টে গেলেও সম্পর্কের রসায়ন বর্তমানেও একই রয়ে গেছে। তোষামোদকারীরও অভাব নেই, কেননা তারা সকলেই জানে চাকুরীতে টিকে থাকতে হলে বা সুবিধা পেতে হলে এর কোন বিকল্প নেই। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই প্রশংসা চান, মানুষতো অতিসামান্য জীব। অতিসামান্য হলেও সে নিজেকে অতিমানব ভাবতে ভালবাসে, তার লোভও সীমাহীন। চাটুকার ও স্তাবকবৃন্দের প্রশংসা তার মাঝে এই প্রতীতি জন্মায় যে, সে একজন অতিমানব, ক্ষমতা অধিক হলে তো কথাই নেই, নিজেকে ভাবে উপদেবতা (demi-god) । প্রশংসা আর স্তুতির জোয়ারে ভেসে সে তখন বাস্তবতা ভুলে যায়। তোষামোদ এমন একটি কুহক বলয় তৈরী করে যা বাস্তবতা থেকে দূরে; তৈরী করে একটি ঘোর, যে ঘোর তৈরী হয়েছিল রামায়নের যুগে রাবনের মনে।
আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি কর্মস্থলে টিকে থাকার প্রধান গুণ হল তোষামোদ করতে পারার দক্ষতা ও স্তাবকের ভূমিকায় নিপুন অভিনয়। এ ছাড়া ভিতরতার রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা তো আছেই। ম্যানেজাররা এক একজন যেন মিনি জমিদার। তারা ব্রিটিশদের মত divide and rule–এ বিশ্বাস করেন, কানকথা শোনেন আর ভীষণ পছন্দ করেন স্তাবকদের। ফলে যারা স্তাবকের ভূমিকা নিতে পারে না, অথচ কাজে দক্ষ, তারা নীরবে দূরে সরে যায়, ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয় এবং চাকুরী হারায়। ম্যানেজারেরা প্রকারান্তরে মিথ্যাচার ও পেছনে-সমালোচনাকে উৎসাহিত করেন, দলাদলিকে প্রশ্রয় দেন। আধুনিক ব্যবস্থাপনার জগতে দলগত সিদ্ধান্তগ্রহণ ও সংগঠনের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চ্চাকে যতই প্রচারিত করা হোক না কেন, ব্যবস্থাপকেরা কিন্তু নিজেদের সিদ্ধান্তকেই অকাট্য মনে করেন, যৌথ সিদ্ধান্তগ্রহণের আঁড়ালে মূলত কাজ করে তাদের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করানোর মানসিকতা। তারা চায় অন্যান্যরা তাদের প্রস্তাবকে স্বাগত জানাবে এবং একবাক্যে মেনে নেবে। স্তাবকের দল এক ধাঁপ এগিয়ে এসে বলবে, এর চেয়ে উত্তম প্রস্তাব আর হয় না।
মানুষের মৌল স্বভাবের ভিতর আছে আধিপত্য বিস্তারের, অন্যকে দাস বানাবার মানসিকতা; 'আমি সঠিক' এই dogmatism, 'আমি সকলের চেয়ে উৎকৃষ্ট' -এই কূপমণ্ডুকতা। চাটুকার প্রভূর এই প্রয়োজনটি (esteem need) মেটায়। সকল প্রাণীর মাঝে কুকুর যে মানুষের গৃহাভ্যন্তরে এতখানি ঠাঁই পেয়েছে, তার বড় কারণ কুকুরের অতুলনীয় প্রভূভক্তি। ভারতে দীর্ঘ দু'শ বছরের ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনা করতে গিয়ে কার্ল মার্কস লিখেছিলেন, ভারতীয়দের মাঝে দাস মনোবৃত্তি সৃষ্টি করাই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বড় কুকীর্তি।
আমি লেখালেখির জগতেও দেখেছি তরুণতম কবিটিও নিজেকে সকলের চেয়ে উৎকৃষ্ট ভাবে, এমনকি বড় কবিদের চেয়েও নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এই হাস্যকর কুয়োর ব্যাঙসুলভ মানসিকতা প্রতিটি স্তরেই দেখি আর ব্যথিত হই। মানুষ মূলত আত্মপ্রেমী (narcissist); সেটা অস্বাভাবিক নয়, অস্বাভাবিক হল 'আমিই একমাত্র জ্ঞানী, বাকী সকলেই বোকা', 'আমিই একমাত্র লেখি, আর সকলেই লেখে যা-তা', এই হীনমন্যতাসম্ভূত কূপমণ্ডুকতা। স্তাবকেরা প্রভূদের এই মনোকাঠামো জানে, আর জানে বলেই তোষামোদির মাধ্যমে প্রথমে প্রভূর মন জয় করে, পরে সুবিধা আদায় করে নেয়।
আমি একটি বহুজাতিক সার কারখানায় কাজ করতে গিয়ে দেখেছি দুজন শীর্ষ কর্মকর্তার মাঝে ক্ষমতার দ্বন্ধ কী করে পুরো কারখানাটিকে দুটি ভাগে ভাগ করে ফেলেছিল, প্রকৌশলী-ম্যানেজারেরা দু-শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। অনেকেরই অবস্থা ছিল 'রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়' গোছের। চালাক যারা, তারা দু-দিকেই (double agent) ছিল। একটি পাঁচতারা হোটেলে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি একদিকে বিদেশী জেনারেল ম্যানেজার (hiring-firing boss), অন্যদিকে শক্তিশালী শ্রমিক ইউনিয়ন আর তৃতীয়দিকে মালিক (সরকার) পক্ষের প্রতিনিধি – এই ত্রিমুখী চাপে কর্মকর্তাদের 'ত্রাহি মধুসূদন' অবস্থা। তারা প্রতিমুহূর্তে চাকুরী হারাবার ভয়ে কাঁপে, আর চাকুরিটি বাংলাদেশের মানদণ্ডে অত্যন্ত লোভনীয় বিধায় তা হারানোও সম্ভব নয়। ফলে তোষামোদি আর চাটুকারিতা হয়ে দাঁড়ায় নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মত দৈনন্দিন বেঁচে থাকার উপায়। কেবল দেশী-বিদেশী উপরিস্থদের নয়, তাদের তোষামোদি করতে হয় অধীনস্থ ইউনিয়ন নেতাদেরও। ঐ ত্রিশূলের উপর ত্রিশঙ্কু হয়ে দাঁড়িয়ে যারা বৎসর বৎসর চাকুরী করে গেছেন, তাদের কী বিপুল মানসিক চাপ সইতে হয়েছে তা অনুমান করা যায়।
একসময়ে কর্পোরেট জগতের এই নোংরা রাজনীতি আর তোষামোদের সংস্কৃতিতে বিরক্ত হয়ে আমি শিক্ষকতার জগতে চলে এসেছিলাম। বুকভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ভেবেছিলাম, যাক, আমাকে ঐ নোংরামীর ভেতর আর থাকতে হবে না। আমি ভুল ভেবেছিলাম। আমি বেশ ক'বছর আগে একটি বেশ নামী-দামী প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম। সেখানে যিনি ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি পিয়নদের সাথে তুই-তোকারী করে কথা বলতেন। কোন কোন শিক্ষককে অনুমতি না নিয়েই এবং পর্যাপ্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলা ছাড়াই 'তুমি' বলে সম্বোধন করতেন। তার ব্যক্তিগত সহকারীটি ছিল একজন টিকটিকি অর্থাৎ গোয়েন্দা। দীর্ঘকাল উদার দেশ আমেরিকায় বসবাস করেও তার ভিতর থেকে জমিদারসুলভ মানসিকতাটি লুপ্ত হয়নি। মজার ব্যাপার, ভদ্রলোক নিজে অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে কেবল মেধার জোরে উপরে উঠে এসেছিলেন, অথচ দরিদ্র কর্মচারীদের তিনি রীতিমত অবজ্ঞা করতেন। শিক্ষকদের মাঝেও তিনি কিছু গোয়েন্দা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, যারা তার হয়ে বিভিন্ন তথ্য জোগাড় করবে। আর যিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য, তিনি পরম সৌভাগ্যে ঐ দুর্দ্দান্ত বেতন-কাঠামোর চাকুরীটি পেয়েছিলেন অবসর জীবনে এসে, যে জীবনে পেনশনের টাকাই একমাত্র আয়ের উৎস। ফলতঃ বিশ্ববিদ্যালয়টির সুষ্ঠু পরিচালনা বা এর উন্নয়ন নয়, উপাচার্য মহাশয় ব্যস্ত থাকতেন তার পদ ধরে রাখার রাজনীতিতে।
এর প্রধান উপায় ছিল পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের (মালিকপক্ষ) মন যুগিয়ে চলা অর্থাৎ তোষামোদ ও লবিং করা। তিনিও পছন্দ করতেন চাটুকারদের তোষামোদ আর নির্ভর করতেন তার নিজস্ব গোয়েন্দাবাহিনীর যোগান দেয়া সত্য-মিথ্যা তথ্যের উপর। ধারণা করি, বিশ্ববিদ্যালয়টি একসময়কার সুদৃঢ় অবস্থান থেকে নেমে বর্তমানের নড়বড়ে অবস্থানে এসে পৌছেছে, ঐসব দলাদলি, স্তাবকতা আর নোংরা রাজনীতির জন্য। কেননা যোগ্য শিক্ষকেরা কোনঠাঁসা হয়ে চলে গিয়েছিল আর টিকে ছিল চাটুকার অযোগ্য শিক্ষকেরা। যে কোন সংগঠনের ভিতর, হোক সেটা সরকারী প্রতিষ্ঠান বা বেসরকারী, অযোগ্য লোকেরা, যারা মামা-চাচা ধরে চাকুরীটি পেয়েছে, তারাই বেশী চাটুকারিতা করে, কেননা নিজেদের দুর্বলতা তারা জানে, জানে যে কর্মদক্ষতা দিয়ে টিকে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তখন তোষামোদ আর দলাদলি করা হয়ে দাঁড়ায় টিকে থাকার মোক্ষ অস্ত্র। প্রভূ চান স্তুতি, ভক্তও নৈবেদ্য নিয়ে তৈরী, ব্যাপারটাকে সোনায় সোহাগাই বলতে হবে।
বস্তুতঃ কর্মদক্ষতা নয়, উপরঅলার সুনজরে থাকাই হল চাকুরীতে টিকে থাকা, পদোন্নতি আর সুযোগ-সুবিধা লাভের বড় উপায়। ফলে আমাদের জনশক্তির একটি বিপুল সময়, মনোযোগ আর মেধা অপচয় হয় তোষামোদের মত একটি অপ্রয়োজনীয়, অনুৎপাদনশীল কাজে। কাজ না করে ঘন্টা ঘন্টা 'বস'-এর কক্ষে বসে থাকা, তাকে নিরন্তর প্রশংসার বৃষ্টিতে ভিজানো ও মাথা-নাড়ার সংস্কৃতি আমাদের পিছিয়ে পড়া অর্থনীতিকে আরো পিছিয়ে দিচ্ছে। আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি কিছু শিক্ষক ঘন্টা ঘন্টা ধরে রেজিস্ট্রারের ঘরে বসে থাকতেন। রেজিস্ট্রার ভদ্রলোক ছিলেন বিশ্ববিদ্যালটির প্রতিষ্ঠাতার নিজের লোক এবং ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। ঐ শিক্ষকরা তা জানতেন এবং জানতেন বলেই ওভাবে উৎসবের লুচি-সন্দেশের জন্য তীর্থের কাকের মত বসে থাকতেন। এতে যে কেবল কর্মউৎকর্ষতা ও উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হয় তা নয়, উৎকর্ষতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা না করে কর্মজীবিরা জো-হুজুরের (Yes-men) ভূমিকায় নেমে যান, বিপুল সময় ব্যয় করেন কোন্দল আর নোংরা রাজনীতিতে।
আমাদের প্রশাসন, আমাদের রাজনীতির অঙ্গন ভরে আছে এইসব দুধের মাছিতে। একটি দল ক্ষমতাসীন হলেই মৌসুমী সমর্থকদের রীতিমত ঢল নামে, চাটুকারীতার জোয়ার বয়ে যায়। কে কত বড় সমর্থক, তার নির্লজ্জ মহড়া, বেহায়া প্রতিযোগিতা চলে। এরা জানে ক্ষমতাবানদের ভিতরকার সেই চিরন্তন দুর্বলতা – তারা তোষামোদে গলে যান। সম্প্রতি বিডিনিউজ ডট কমে এক লেখায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা এ সকল সুসময়ের বন্ধুদের অনুরোধ করেছেন জাতির পিতা বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ার হিড়িক থেকে নিবৃত্ত থাকতে। কেননা তিনি ঠিকই উপলব্ধি করেছেন ঐ ভণ্ড পীরদের আসল মতলব, তারা আদিখ্যেতা দেখিয়ে সরকারী বা নিরীহ মানুষদের সম্পদ হাতিয়ে নেবে। এই মৌসুমী পাখিদের হারিয়ে যেতে বা পাখার রঙ বদলাতেও বেশী সময় লাগে না।
রাজনীতির ময়দানতো তোষামোদের স্বর্গ। বক্তৃতায় মূল বক্তব্য থাকে সিকি ভাগ, বাকী তিন-চতুর্থাংশ জুড়ে মঞ্চে উপবিষ্ট নেতা-নেত্রীদের গুণকীর্তন, মাহাত্ম্যবর্ণন। সভাস্থলে বিশেষনের একটি ঢল বয়ে যায়, শ্রোতারা বারংবার কেবল অতিবিশেষায়িত পরিচিতি শোনে। সরকার বদল হলেই দল বদল করেন এমন একজন সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদের গল্প তো আমরা সবাই জানি। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হল সে কেন এত দলবদল করে, তার নির্লিপ্ত উত্তর, আমি তো একটাই দল করি, সরকারী দল; এখন সরকার বদল হলে আমি কী করব? সুতরাং রাজনীতির ময়দানের চাটুকারদের কোন দল বা আদর্শ নেই, তারা ক্ষমতার ও সুবিধার পিঠেভাগ চায়। আমাদের রাজনীতিতে অনেক পালের গোদা আছেন যারা এ দল ও দল করে বর্তমান অবস্থানে এসেছেন, তাদের অনেকের মুখেই 'ভাজা মাছটি উল্টে খেতে পারিনা' জাতীয় একটি মুচকি মুচকি হাসি দেখা যায়; ভিজে বেড়ালের এক একটি আদর্শ চেহারা। এসকল বক ধার্মিক আসলে জ্ঞানপাপী। তারা এদেশের মানুষদের ভাবেন গোল্ডফিশ, যার মেমোরী অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী, এ্যাকুরিয়ামের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে গেলে যে গোল্ডফিশ ভুলে যায় সে খাবার খেয়েছিল কিনা। না আমাদের জনগন গোল্ডফিশ নন, তারা সরলবিশ্বাসী, বারংবার বিশ্বাস করে তারা ঠকেছেন, কিন্তু এখন সজাগ হয়েছেন। বিভিন্ন 'জুজুড়' ভয় দেখিয়ে বা সস্তা সেন্টিমেন্ট জাগিয়ে তাদের আর বিভ্রান্ত করা যাবে না।
এ লেখা শুরু হয়েছিল রাজাদের আমল দিয়ে। সে আমলের মোসাহেবীর একটি গল্প বলি। গল্পটি বলেছিলেন আমার চাচা যিনি অত্যন্ত সুরসিক, তাঁর অফুরন্ত গল্পের ভাণ্ডার দিয়ে সর্বদাই চারপাশের মানুষদের আমোদিত রেখেছেন। রাজার মোসাহেব মারা গেছে; রাজা নতুন মোসাহেব নিয়োগ দিবেন। রাজ্যময় ঢোল পিটিয়ে তা জানিয়ে দেয়া হল। ইন্টারভ্যূ নিবেন রাজা নিজেই। প্রচুর লোক আবেদন করল, কেননা চাকুরীটি লোভনীয়। রাজা প্রত্যেককে একটিই প্রশ্ন করেন; প্রশ্নটি হল, 'কী মিয়া, কাজটি কি তুমি পারবে?' কেউ বলে, 'অবশ্যই পারব, মহারাজ', কেউ বলে, 'জীবনবাজী রেখে তা পারব', ইত্যাদি। রাজা তাদের বেরুবার দরোজাটি দেখিয়ে দেন, অর্থাৎ অমনোনীত। যাকে শেষাবধি নেয়া হল তাকেও ঐ একই প্রশ্ন করা হলে সে সরাসরি কোন উত্তর না দিয়ে রাজাকেই সবিনয়ে (হাত কচলাতে কচলাতে) জিজ্ঞেস করল, 'মহারাজের কী মনে হয়'? রাজা বল্লেন, 'আমার মনে হয় তুমি পারবে না।' তখন সে বলে, 'তাহলে হুজুর, আমি পারবোনা'। পরক্ষণেই রাজা বল্লেন, 'না, এখন মনে হচ্ছে পারবে'। তখন লোকটি বলে, 'তাহলে মহারাজ, আমি পারবো'। রাজা তার উজিরকে ডেকে বল্লেন, 'একে নিয়ে নাও, কেননা এর নিজস্ব কোন মতামত নেই।' আমাদের হাল আমলের তোষামোদকারীদেরও নিজস্ব কোন মতামত নেই। থাকলেও তারা তা প্রকাশ করবেনা, কেননা তাদের লক্ষ্য তর্কে জেতা বা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছানো নয়, বরং কর্তার মনোভঞ্জন। সে কাজ তারা নিষ্ঠার সাথেই করে যাচ্ছে, করবে ততদিন যতদিন এর সুফল থাকে। তাহলে এই দুষ্টচক্রটি ভাঙ্গতে পারে একমাত্র তারাই যারা তোষামোদকে এতকাল প্রশ্রয় দিয়েছেন। কেননা লক্ষ লক্ষ মানুষকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে কিছু সুবিধাভোগীকে আরাম-আয়েসের আকাশে তুেল দিতে এ দেশ স্বাধীন হয়নি। এইসব ভিজে বেড়ালদের চিনতে না পারলে হাঁড়ির একটা মাছও থাকবেনা। নেতাদের বুঝতে হবে দুধের মাছিরা সুসময়েই পাতে এসে পড়ে, দিনবদল হলে এদের আর দেখা পাওয়া যায়না।