Published : 08 Apr 2025, 06:43 PM
বাংলাদেশে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলোর একটা রাজনৈতিক উত্থান ঘটছে— সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই ঘটনা বিশ্বমঞ্চে ফাঁস করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। অত দূর থেকে এই ছোট্ট দেশের মৌলবাদী হিমশৈলের চূড়া দেখতে পারাটা চাট্টিখানি কথা নয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের, নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর তরুণ প্রজন্মের এবং রাষ্ট্রের নতুন কর্তাদেরকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে রাষ্ট্রের কর্তাদের দায়দায়িত্ব অনেক বেশি। ওই প্রতিবেদনটিতে সমালোচকের দোহাই দিয়ে বলা হয়েছে যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ গোষ্ঠীটিকে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কঠোর অবস্থান নিচ্ছেন না। সন্দেহ নেই যে, খুবই ভালো ও দরকারি নিউ ইয়র্ক টাইমসের এ প্রতিবেদনটি।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব প্রেক্ষাপটে আরও জরুরি প্রতিবেদন কে লিখবে? আর লিখলেও তাদের সংবাদমাধ্যম ও রাজনীতিবিদরা কি তা গ্রাহ্য করবে? সারা বিশ্বের রাজনৈতিক বয়ান তো তারাই তৈরি করে, অন্যরা তা অনুসরণ করে মাত্র। অন্য বয়ান যে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই নেই তা নয়, কিন্তু তার কণ্ঠ বেশিদূর পৌঁছায় না। আর অন্য দেশের মানুষ তাদের নিয়ে কী বলল না বলল তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কী আসে যায়! তাদের যে কোনো কথাতেই আমাদের আসে যায় অনেক কিছু। বাংলাদেশে যখন মৌলবাদের ডুবন্ত হিমশৈলের চূড়া দৃশ্যমান হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র তখন খ্রিস্টান মৌলবাদের আগ্নেয়গিরির চূড়ায় বসে হাওয়া খাচ্ছে।
তুলসী গ্যাবার্ড যখন ভারতে এসে বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান নিয়ে তার গভীর উদ্বেগ ও মাথাব্যথার কথা জানালেন, তখন তার চমৎকার বাচনভঙ্গি ও সাহসী কথায় বাংলাদেশে কারও মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। ভারতীয়রা তো রীতিমত পুলকিত হয়েছে এই ভেবে যে, যে রাষ্ট্রে বসে তিনি তার এই মেধার চাকচিক্য দেখালেন তার ক্ষমতায় একটি চরম হিন্দু মৌলবাদী দল। আর তাদের হাতে লেগে আছে গুজরাটে মুসলিম হত্যার রক্ত। বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থানে তুলসী গ্যাবার্ডের উদ্বেগ দেখে আমরাও উদ্বিগ্ন। প্রথম কারণ, তিনি যে কারণে উদ্বিগ্ন সেটি, আর দ্বিতীয় হচ্ছে তার উদ্বেগই আমাদের উদ্বেগের কারণ। হাজার হলেও বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার তিনি এক চৌকষ নেতা।
তবে এ কথাও ঠিক যে, যে বাড়িতে তিনি মেহমান ওই বাড়িতে বসে তাদের দুর্নাম করা যায় না, কেননা তা মোটেও ভালো দেখায় না। তুলসীকে বাংলাদেশে দাওয়াত দিয়ে তার বসের জন্য কিছু ব্যবসাপাতি গুছিয়ে দেন, তারপর তাকে বাংলাদেশ নিয়ে প্রশ্ন করলে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া কিছুই শুনবেন না। তবু তাকে ও তার দেশের নিউ ইয়র্ক টাইমসকে, যাকে তুলসীর বস প্রতিদিন ভুয়া সংবাদমাধ্যম বা ফেক নিউজ বলে গালি দেন, ধন্যবাদ দিতেই হচ্ছে আমাদের চোখ খুলে দেয়ার জন্য।
কিন্তু যারা অন্যের চোখ খুলে দেয়ার কারিশমা দেখায়, তারা কি নিজের দেশে কিছুই দেখে না? মৌলবাদের আগ্নেয়গিরির হৃদপিণ্ডের মধ্যে বসে তারা এ দেশে হিমশৈলের চূড়া দেখে হাপিত্যেশ করছেন। ভালো হোক মন্দ হোক— একটা দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য আছে বৈকি! কিন্তু আমরা যখন তাদের আগ্নেয়গিরির কথাটা ফাঁস করছি তখন কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে তা করছি না। একটাই শুধু চাওয়া— আগে আপনাদের দৈত্যটাকে বোতলে ভরুন, আমাদেরটা পালায়ে সারতে পারবে না। নদীভাঙনের, চঞ্চল ষড়ঋতুর, নকশী কাঁথার, শাহজালাল-শাহপরানের ও বাউলের এই বাংলাদেশে শিকড়বাদের জায়গা কই?
লক্ষণীয়, আজকের দুনিয়ায় জায়নবাদের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্র। তাদের সঙ্গে দেড় বছর ধরে ফিলিস্তিনে চালানো ইসরায়েলি গণহত্যায় যুক্তরাজ্যও পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে। কিন্তু ওই ইহুদি মৌলবাদ নিয়ে ট্রাম্প, ইলন মাস্ক ও তুলসী গ্যাবার্ডের টু শব্দটিও নেই, শুধু তাই নয়, নেতানিয়াহু ডান হাত হিসেবে পেয়েছেন ডনাল্ড ট্রাম্পকে। আর তার বাম হাত হচ্ছে বিখ্যাত নিউ ইয়র্ক টাইমসহ মূলধারার পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এখন কাদের দেশ? অভিবাসীদের রক্তে ও ঘামে নির্মিত যুক্তরাষ্ট্র থেকে এখন তাদেরকে তাড়ানোর অভিযান শুরু হয়েছে। দেশটির শাসনক্ষমতা এক শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর দখলে। ‘টাইম’ সাময়িকীতে গত বছর ১০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক লেখায় (ট্রাম্প’স ক্রিশ্চিয়ান ন্যাশনালিস্ট ভিশন ফর আমেরিকা) রবার্ট পি. জোনস লিখেছেন, “সমর্থকদের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক ভিন্ন উপাদানে তৈরি: তা হলো, শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান আমেরিকার কাছে শাসনক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য তার সহিংস অভিযান। ... হারিয়ে যাওয়া খ্রিস্টান অতীতকে পুনরুদ্ধারের ইচ্ছেই তার ক্ষমতারোহণের জ্বালানি শক্তি যা ২০২৪-এও অব্যাহত থেকেছে।”
‘দ্য হিডেন রুটস অব হোয়াইট সুপ্রিমেসি’ বইয়ের লেখক জোনস আরও লিখেছেন, পিআরআরআই কর্তৃক পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায় শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান গোষ্ঠীতন্ত্রের সঙ্গে ট্রাম্পের উত্থানের সংযোগ গভীর। ওই গোষ্ঠীর দাবির মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা প্রদান আর দেশটির সব আইন খ্রিস্টান ধর্মের ভিত্তিতে করা। এর সঙ্গে তাদের অন্যান্য গণতন্ত্রধ্বংসকামী মনোভাবের মধ্যে আছে: শ্বেতাঙ্গ গোষ্ঠীতান্ত্রিক অসহিষ্ণুতা, জাতিবিদ্বেষের উপস্থিতি অস্বীকার করার চেষ্টা, সেমিটিজম বিদ্বেষ, ইসলামবিদ্বেষ, অভিবাসীবিরোধী মনোভাব, স্বাজাত্যবোধ, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমর্থন ইত্যাদি।
তো, তাতে বাংলাদেশে বসে আপনি-আমি কী করব, যুক্তরাষ্ট্র বলে কথা! মার্কিন সমর্থিত ইসরায়েলি গণহত্যা কি আমরা কেউ বন্ধ করতে পারছি? হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, ইসলামী সব মৌলবাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রব্যবসায়ীদের আত্মার সম্পর্ক। সেজন্য তুলসী গ্যাবার্ডের কথা শুনে আর নিউ ইয়র্ক টাইমস পড়ে মনে হয়— নাটক কম করো পিও!
বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থানে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন, হওয়ারই কথা। তা একটি ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির উত্থানে ট্রাম্প-মাস্ক-তুলসী কতখানি খুশিতে নাচবেন? নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদন লিখে কি অভিনন্দন জানাবে? বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকার তো ধর্মনিরপেক্ষই ছিল— তখন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ-প্রীতি এখনকার চেয়ে বেশি না কম ছিল? বাংলাদেশ নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের আগ্রহ সম্প্রতি অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। আমরা তাতে বেশ খুশি। তবে তাদের এত কৌতূহল আমাদের আগ্রহও বাড়িয়ে দেয়।
তুলসী গ্যাবার্ড আর এসব পত্রিকা কখনো মিথ্যা বলে না। সব তথ্য যাচাই করে সত্য সম্পর্কে পুরো নিশ্চিত না হয়ে তারা কিছু ছাপে না। বটে! সত্য বৈ তারা কিছু বলে না— তবে সত্য বাছাই করে এবং শিল্পীর নিপুণ মেধায় সত্যের গায়ে রং মেখে তাকে চকচকে কিংবা রং তুলে ফেলে তাকে বিবর্ণ করে দেয়। তারা মিথ্যা বলে না, তবে সত্য গোপন করে। হরহামেশা মিথ্যা বলে কাজ হাসিল করা যায় না, সত্যের দশমিক অংশটা প্রকাশ আর পূর্ণ অংশটা গোপন করে মিথ্যার চেয়েও বেশি কাজ হাসিল করা যায়। ট্রাম্প রাউন্ড দ্য ক্লক মিথ্যা বলেন, তাই তার ‘ফেক নিউজ’ কথাটাও মিথ্যা। নিউ ইয়র্ক টাইমস একশ ভাগ সঠিক।
পৃথিবীর সব দেশে ও জাতিতেই ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয় কেবল অন্যের স্বাধীনতা হরণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প-মাস্ক প্রশাসন যতখানি তা চায় না বলছে, আমরা তারচেয়ে বেশি তা চাই না। কিন্তু সাধারণ বিশ্ববাসী তার আগে যুক্তরাষ্ট্রের মদদে ইসরায়েলের ইহুদি মৌলবাদী ও ট্রাম্প-মাস্কের নেতৃত্বে বর্তমান শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান মৌলবাদী গোষ্ঠীর আধিপত্যের হাত থেকেও বাঁচতে চায়।