Published : 02 Jul 2025, 11:37 PM
“তৈল যে কী পদার্থ, তাহা সংস্কৃত কবিরা কতক বুঝিয়াছিলেন, তাঁহাদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ—বাস্তবিকও স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ কর অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি। স্নেহ কি? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠান্ডা করে, তাহার নাম স্নেহ। তৈলের ন্যায় ঠান্ডা করিতে আর-কিসে পারে! সংস্কৃত কবিরা ঠিকই বুঝিয়াছিলেন। যেহেতু তাঁহারা সকল মনুষ্যকেই সমানরূপে স্নেহ করিতে বা তৈল প্রদান করিতে উপদেশ দিয়াছেন।”
বাঙালি সাহিত্যিক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই অমূল্য সত্য কথাগুলো লিখেছিলেন আজ হতে শতবর্ষ পূর্বে। এখন বলতে হচ্ছে, সংস্কৃত কবিদের চাইতেও এটা ভাল বুঝেছেন ইসরায়েলি জায়নবাদীদের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং সম্প্রতি ন্যাটো সামরিক জোটের প্রধান মার্ক রুটে।
আমাদের বাংলা সাহিত্যের এই সাহিত্যিকের অমূল্য কথা ইসরায়েল ও ইউরোপের নেতারা পড়েছেন কিনা তা হলফ করে বলতে পারছি না। না পড়ারই কথা। তবে তারা তৈলমর্দনের বৈজ্ঞানিক ও রাজনৈতিক গুণ দুই-ই খুব যে ভালো করে বুঝতে পেরেছেন তা নিশ্চয় করে বলা যায়।
কেননা অনেকদিন ধরেই তারা যে আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে বাবা বলে মনে করতেন তা হাবভাবে ও কাজেকর্মে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। তাতেও মন ভরল না। সম্প্রতি তারা তৈলবিদ্যার অন্তর্নিহিত জ্ঞানে হরপ্রসাদকেও ছাড়ায়ে গেলেন। এখন তারা প্রকাশ্যেই প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে ড্যাডি মানে বাবা বলে ডাকতে শুরু করেছেন। নেতানিয়াহু ও রুটে মহোদয় কীভাবে হরপ্রসাদ পাঠ করে (বা না করেই) তাকেও হার মানালেন তা নিয়েই আজকার ক্ষুদ্র লেখাখানি।
ইসরায়েল হচ্ছে পশ্চিমা পুঁজিবাদের একটি দখলদারি প্রকল্প যার ভিত্তি বর্ণবাদ ও ফ্যাসিবাদরূপী জায়নবাদ। এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক আমেরিকা, ব্রিটেন ও শক্তিশালী ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রগুলো। পারমাণবিক জুজুর ভয় দেখিয়ে ইরানে হামলা ছিল গাজা গণহত্যাকে সফল করবার আরেকটি নৃশংস উপায়। এই হামলা চালিয়ে তারা বিশ্বদৃষ্টিকে গাজা থেকে কিছুটা সরাতেও পেরেছে।
এখন পর্যন্ত যুদ্ধের মাঠে ইসরায়েলকে একা দেখালেও সবার কাছে পরিষ্কার যে, যুদ্ধবাজ এই দেশটি অস্ত্র, আর্থিক ও বৌদ্ধিক শক্তি যুগিয়ে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় সহযোগীরা। কিন্তু নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা ছিল যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি যুদ্ধে টেনে আনা। এ কাজে তিনি অনেকটা সফলও হয়েছেন। ডনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি ইরানে হামলা করলেন এবং ইরানকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু ইরানের পক্ষ থেকে পাল্টা হামলা করবার শক্তি ইসরায়েল ও আমেরিকা উভয় দেশকেই বিস্মিত করেছে। সেই সঙ্গে ইসরায়েলের যুক্তরাষ্ট্র-নির্ভরতা স্পষ্ট করেছে সবার সামনে।
ইরানের নিক্ষেপিত মিসাইলগুলোর ১০ শতাংশও ইসরায়েলের মাটিতে পড়েনি। যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় ইসরায়েল প্রায় সবই আকাশে ধ্বংস করতে পেরেছে। কিন্তু এই পাঁচ থেকে ১০ শতাংশেই ইসরায়েলের মানুষের কিছুটা বোধগম্য হয়েছে, গাজার নিরীহ মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে। কয়েকটা ইরানি মিসাইল ইসরায়েলের হাসপাতালে পড়তেই তারা কিছুটা বুঝেছে গাজায় সব হাসপাতাল বোমা মেরে মেরে উড়িয়ে দেওয়া কতবড় মানবতাবিরোধী অপরাধ। তাদের দুয়েকটা বিজ্ঞান গবেষণাগার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারা কিছুটা বোঝার কথা ইরানে বিজ্ঞানীদের ঘুমের মধ্যে হত্যা করা কতবড় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।
এরপর ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে প্রতারণা করতে করতে যখন মধ্যরাতে হামলা করলেন, নেতানিয়াহু খুশিতে ডগমগ হয়ে ওঠেন। ট্রাম্প অচিরেই বুঝলেন তার এই মধ্যরাতের হামলাও আশানুরূপ ফল দেয়নি। ইরানকে আত্মসমর্পণের নির্দেশও হিতে-বিপরীত হলো। তারপরও ঘটনা যাই হোক, সাফল্যের কৃতিত্ব আত্মম্ভরী ট্রাম্পকে নিতেই হবে।
ইরানে হামলা করে নেতানিয়াহুর কাছ থেকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেলেন ডনাল্ড ট্রাম্প। আবার তিনি নাকি খামেনিকে নেতানিয়াহুর হাত থেকে প্রাণে বাঁচিয়েছেন, সে প্রশংসাও চাইলেন ইরানের কাছ থেকে!
ইরান আমেরিকার গালে একটা চড় মেরেছ, আয়াতুল্লাহ খামেনির এই বক্তব্যে ট্রাম্পের আঁতে ঘা লাগে। ইরান জয়লাভ করেছে খামেনির এই দাবির জবাবে ট্রাম্প বলেন, “দেশটা ধ্বংসপ্রাপ্ত, তার তিনটি দুষ্ট পারমাণবিক স্থাপনা মুছে ফেলা হয়েছে। আমি ঠিক জানতাম, তিনি কোথায় লুকিয়ে, তবু ইসরায়েল বা মার্কিন সামরিক বাহিনীকে তার জীবননাশ করতে দেইনি। আমি তাকে বাঁচিয়েছি একটা কুৎসিত ও অপমানজনক মৃত্যু থেকে।” তাও খামেনি তাকে কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে আরও অপমান করছেন! সেজন্য ট্রাম্প বলেছেন, “তারা সবসময় এত ক্রুদ্ধ, শত্রুভাবাপন্ন ও অখুশি থাকে, এর ফলে তাদের কী অবস্থা হয়েছে দেখুন। একটি দগ্ধ, ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ যাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত সৈন্যবাহিনী, দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনীতি ও চারদিকে ছড়ানো মৃত্যু। তাদের কোনো আশা নেই, আর পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।”
এ হলো ড্যাডির আবদার —যিনি এখন ইউরোপের ও ইসরায়েলের আক্ষরিক ড্যাডি! ন্যাটো সামরিক জোটের প্রধান মার্ক রুটে এবার ২৫শে জুন হেগে আয়োজিত ন্যাটো সম্মেলনে তাকে ড্যাডিই বলেছেন। ইসরায়েল ও ইউরোপের দেশগুলোর মত সম্পদশালী দেশ এবং জাতিও যে কতখানি মূল্যবোধবিবর্জিত ও আত্মমর্যাদাহীন হতে পারে —এ তারই প্রমাণ। তাদের কথপোকথনে চরম বালখিল্যতা ফুটে ওঠে। বিনা উসকানিতে ইরানের ওপর হামলা করে নিরীহ মানুষ খুন করার সঙ্গে সঙ্গে দেশটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়ে ট্রাম্প হাসতে হাসতে বলছেন, “তারা একটা বড় মারামারি করেছে, স্কুলের মাঠে দুই বালকের মতো। তারা প্রাণবাজি রেখে মারামারি করেছে, তখন তাদেরকে থামানো সম্ভব না। দুই-এক মিনিট মারামারি করতে দাও, তখন থামানো সহজ হয়।” এক উৎকট প্রেসিডেন্টের এরকম বালখিল্য মন্তব্যে আরেক তৈলমর্দনকারী সাবেক ডাচ প্রধানমন্ত্রী রুটে হা-হা করে হাসতে হাসতে বলেন, “ড্যাডিকে মাঝে মাঝে কড়া কথাও বলতে হয়।”
এরপর থেকে নেদারল্যান্ডের ভেতরে ও বাইরে ন্যাটো প্রধান রুটেকে ‘পাচাটা মোসাহেব’, ‘ট্রাম্পের প্রিয় পুতুল’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হচ্ছে। তবে কেউ কেউ তাকে প্রশংসাসূচকভাবে ধূর্ত হিসেবেও চিহ্নিত করছেন, কেননা তাদের ধারণা তিনি জানেন ট্রাম্পের মত এক বদমেজাজী প্রাণীকে (র্যাবিড ডগ) কী করে বশ মানাতে হয়!
ডাচ সাংবাদিক টিম ব্রিঙ্কফ তার সাম্প্রতিক লেখায় (ইউরোপ’স ড্যাডি ইস্যু, জ্যাকোবিন, ২৭ জুন ২০২৫) আরও লিখেছেন, “রুটের এই মন্তব্য কেবল ইউরোপের নিরাপত্তাই নয়, আমেরিকান গণতন্ত্রের বেঁচে থাকার জন্যও হুমকিস্বরূপ। নিজেকে ও সেইসঙ্গে পুরো ইউরোপকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পায়ের তলায় ছুঁড়ে ফেলে ন্যাটো প্রধান কার্যত দেশে ট্রাম্পের বাজার দর বাড়িয়ে তুললেন।” রুটে যেন যুক্তরাষ্ট্রকে আরও বার্তা দিলেন—“তুমি আমাদের পরিবার ছেড়ে যতই চলে যেতে চাও না কেন, তুমিই আমাদের প্রিয় বাবা, তোমাকে ঘরে ফেরাতে আমরা যা প্রয়োজন সব করব।” আহা! ট্রাম্পের বাৎসল্যপ্রীতি উথলে না উঠে পারে না!
রুটের এহেন চাটুকারিতার তিনদিন পর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি এক্স-এ পোস্ট করে বলেছেন, “ধূলায় মিশে যাওয়া থেকে বাঁচতে বাপের কাছে দৌঁড়ে পালানো ছাড়া ইসরায়েলের কোনো উপায় ছিল না।”
এদিকে প্রতিদিন গাজায় নতুন নতুন উপায়ে মানুষ হত্যা বেড়েই চলেছে। ইরান এবার নতুন উদ্যমে পারমাণবিক স্থাপনা শক্তিশালী করবে। কেননা বোমা তৈরি করা ছাড়া যে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে, সব আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে মার্কিন-ইসরায়েলি হামলা এবার তা প্রমাণ করে দিল। যার যার দাবি অনুযায়ী এই যুদ্ধে জিতেছে সবাই–আমেরিকা, ইসরায়েল ও ইরান। কিন্তু হেরেই চলেছে গাজা–ইসরায়েলি গণহত্যার যেন শেষ নেই বিশ্বড্যাডির আমলে, তারই ছত্রছায়ায়।