Published : 03 Aug 2011, 10:01 PM
ইস্টার দ্বীপের প্রকাণ্ড মূর্তি নিমার্ণকারী মানুষেরা গেল কই ?
প্রশান্ত মহাসাগরের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ ইষ্টার আইল্যান্ড। এর পূর্ব দিকে তেইশশত মাইল দূরে চিলি'র উপকূল আর পশ্চিমে তেরশ মাইল দূরে পলিনেশিয় দ্বীপপুঞ্জের পিটকের্য়ান দ্বীপ। ছেষট্টি বর্গমাইলের এই ছোট্ট ত্রিভুজাকৃতির দ্বীপটিতে অষ্টাদশ শতকের গোড়ায় ইউরোপিয় নাবিকরা যখন প্রথম পদার্পণ করল, তখন তারা বিস্ময়ে দেখতে পেল যে সারা দ্বীপের সমুদ্রতীরের ধার ঘেঁষে শত শত প্রকাণ্ড প্রস্তরমূর্তি কে বা কারা বানিয়ে রেখেছে। মূর্তিগুলো প্রকান্ড–পনেরো/বিশ ফুট থেকে সত্তর ফুট লম্বা (প্রায় ছয়তলা বাড়ির সমান উচু) এবং ওজন দশটন থেকে আড়াইশো টনেরও বেশি।
"ইস্পাতের মতো কঠিন আগ্নেয় শিলাকে কাটা হয়েছে মাখন-কাটা করে। দশ হাজার টন ওজনের সব পাথর পড়ে আছে এখানে-ওখানে -সেখানে। তাদের আর চাঁছা-ছোলা করা হয়ে ওঠেনি। ৩৩ ফুট থেকে ৬৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা আর প্রায় পঞ্চাশ টন ভারী শত শত মূর্তি আজো চেয়ে থাকে পর্যটকদের মুখের পানে, বুক ফুলিয়ে।"
– এরিক ফন দানিকেনের 'দেবতা কি গ্রহান্তরের মানুষ' (অনুবাদ অজিত দত্ত) বইয়ে এমনটিই উল্লেখ আছে ইস্টার দ্বীপ সম্পর্কে। তিনি আরো বলেছেন, "যে-কোনো মহাদেশ থেকে সভ্যসমাজ থেকে ইস্টার দ্বীপ অনেক অনেক দূরে। দ্বীপবাসীরা পৃথিবীর দেশদেশান্তরের চেয়ে আকাশের চাঁদ-তারাকেই বেশি চেনে। কোনো গাছ জন্মায় না সে-দ্বীপে, সারা দ্বীপটা একখানা আগ্নেয়শিলা। … তাহলে কে ও-মূর্তিগুলি পাহাড় কেটে বের করে খোদাই করল, আর ওখানে তাদের বসালোই বা কে? রোলার ছাড়া ওই দানবদের মতো মাইল পথ বেয়ে আনলোই বা কেমন করে? কী করে তাদের খোদাই করা হলো, পালিশ করা হলো, আর দাঁড় করানোই বা হলো কেমন করে? … পাহাড়ের ধারে আর আগ্নেয়গিরির মুখের কাছে শত শত অসম্পূর্ণ মূর্তি, হাজার হাজার পাথরের অস্ত্র-শস্ত্র, পাথরের কুড়াল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পড়ে রয়েছে, যেন হঠাৎ কাজ পরিত্যক্ত হয়েছে।" ('দেবতা কি গ্রহান্তরের মানুষ,' পৃ. ১০৬)
এরিক ফন দানিকেন সৌখিন প্রত্নতাত্তিক। তিনি মনে করেন দূর অতীতে মহাকাশ থেকে অতিবুদ্ধিমান প্রাণী এসে পৃথিবীর মানুষকে 'সভ্যতা' শিখিয়ে গেছে। তাদেরই দেখানো পদ্ধতিতে মানুষ অসাধারণ স্থাপত্য ও ভাস্কর্য নিমার্ণ করেছেন, যা তাদের পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব ছিল না। কিন্তু দানিকেনের এসব গপ্পোসপ্পো কোনো প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন না। কার্ল সেগান বলেছেন, "অসাধারণ দাবীর পেছনে অসাধারণ প্রমাণ থাকা চাই"। এমন অনেক ঘটনাই আছে যার পেছনে স্পষ্ট কার্য-কারণ ও যুক্তি-প্রমাণ আছে যা অন্য কথা বলে। কিন্তু দানিকেন সহজ ব্যাখ্যা না মেনে উল্টোপাল্টা ব্যাখ্যার পথে হাঁটেন। যেমন ইস্টার দ্বীপের ক্ষেত্রেই তিনিই বলছেন যে পাহাড়ের ধারে পাথরের অনেক অস্ত্র-শস্ত্র পড়ে আছে। অথচ তিনিই আবার প্রশ্ন তুলছেন এইসব মূর্তি এমন 'মাখন-কাটা' হলো কীভাবে। আজকাল বিজ্ঞানীরা অনেকটাই জানেন ইস্টার দ্বীপে কী হয়েছিল। ইস্টার দ্বীপের গল্প আসলে পারিবেশিক বিপর্যয়ের গল্প। কীভাবে মানুষের উন্মত্ত কমকাণ্ডে সারা দ্বীপের পরিবেশ বিনষ্ট হয়, কীভাবে 'কালেক্টিভ ম্যাডনেস' দ্বীপবাসীদের ধ্বংস ডেকে আনে তা আজ আমরা অনেকটাই স্পষ্ট জানি। ইস্টার দ্বীপ আমাদের দেশবাসীর জন্য তো বটেই, পুরো বিশ্ববাসীর জন্য একটা বড় শিক্ষার বিষয়। এই একটাই আমাদের পৃথিবী। এর পরিবেশের উপর যদি আমাদের নগ্ন হামলা অব্যাহত থাকে, আমরা যদি আমাদের লোভকে সংবরণ না করি, তবে এই পৃথিবীরও একদিন ইস্টারের দুর্দশায় পেয়ে বসবে। এবং তার লক্ষণ অচিরেই দেখা দিচ্ছে।
ইস্টার দ্বীপটির নামকরণ করেন এক ডাচ অভিযাত্রী ১৭২২ সালে। পাঁচই এপ্রিল তারিখে এই দ্বীপটি প্রথম গোচরে আসে এবং ঐদিন ছিল খ্রিস্টানদের পবিত্র 'ইস্টার দিবস'। তাই দ্বীপটির এই নামকরণ। দ্বীপটির অবস্থান বিষুবীয় অঞ্চলের নিচে ২৭ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশ বরাবর। তাই বিষুবীয় অঞ্চলের তুলনায় এ দ্বীপটি ঠান্ডা হলেও বরফ পড়ার মতো ঠান্ডা নয়। কিন্তু অপেক্ষাকৃত শীতল সমুদ্রের কারণে প্রবালদ্বীপ তেমন গড়ে উঠতে পারেনি যাতে মৎস্যসম্পদের পরিমাণ যথেষ্ট হতে পারে (প্রবাল ও মাছের মধ্যে চমৎকার খাদ্য-শৃঙ্খল আছে, যেখানে ঐ শৃঙ্খলের একেবারে নিচে অবস্থিত প্রবাল)। তাই ফিজিতে যেখানে হাজার রকমের রকমারি মাছ পাওয়া যায়, সেখানে ইস্টার দ্বীপে মাত্র একশত সাতাশ প্রজাতির মাছ পাওয়া গেছে। সারা বছর এই দ্বীপে গড়ে পঞ্চাশ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়। তাই মিঠাপানির উৎসও কম। সমুদ্রের নিচ থেকে গজিয়ে ওঠা তিনটি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে এই দ্বীপটি গড়ে উঠেছে। এসব আগ্নেয়গিরি এখন সুপ্ত।
বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে অন্যান্য পলিনেশিয় দ্বীপের মতোই একই নৃ-গোষ্ঠী ইস্টার দ্বীপে বাস করে। ডিএনএ পরীক্ষা থেকে এবং ভাষাগত সাদৃশ্য থেকে তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত, কোনো মহাজাগতিক জিন-সাক্ষ্য দ্বীপবাসীর রক্তে পাওয়া যায়নি। পরিত্যাক্ত কাঠ-কয়লার কার্বন-ডেটিং করে এবং মানব-বসতির চিহ্ন পরীক্ষা করে প্রত্নতাত্ত্বিকরা একমত হয়েছেন যে ইস্টার দ্বীপে মানব-বসতি শুরু হয়েছে নয়শ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। দ্বীপবাসীর নিজস্ব কাহিনী অনুযায়ী হোতু মাতুয়া নামের একজন সর্দারের নেতৃত্বে তার পরিবার, ছয় ছেলে ও অন্যান্যেরা দুটি নৌকায় চড়ে প্রথম এই দ্বীপে আসে। দ্বীপবাসীদের খাদ্য-তালিকায় ছিল নানারকম পাখির মাংস, তাদের একমাত্র পোষা প্রাণী মুরগি, আখ, আলু, কলা ইত্যাদি। মিঠাপানির উৎস কম থাকায় দ্বীপবাসীরা প্রচুর আখের রস পান করত। কাজেই দ্বীপবাসীর দাঁতের অবস্থা প্রাচীনযুগের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে শোচনীয় ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এমনকি চোদ্দ বছরের বাচ্চার দাঁতেও ক্যাভিটি দেখা দিত। দ্বীপবাসীর সংখ্যা ছয়হাজার থেকে ত্রিশহাজার পর্যন্ত ছিল বলে মনে হয়। ইস্টারদ্বীপে খুব জোর বাতাস বয়। পশ্চিমবঙ্গীয় ভাষায় 'দারুণ হাওয়া দিচ্ছে'। এইরকম জোর বাতাসে কৃষিকাজ একটু জটিল। তাই দ্বীপবাসীরা বড় বড় পাথরখন্ড দিয়ে আড়াল করে তার পাশে চাষবাস করত। ইস্টারের জোরালো ঠান্ডা শুষ্ক বাতাস খুবই ভয়ানক। তাই এই দ্বীপের চাষিরা বড় বড় পাথরের খেদা তুলে তারমধ্যে সামান্য কিছু চাষ করত। মাত্র কয়েকটা আলু ফলানোর জন্য দ্বীপবাসীদের প্রচুর পাথর বয়ে আনতে হতো। সেটা নিশ্চয়ই সহজ ছিল না। এক প্রত্নতাত্ত্বিক এধরনের বিচিত্র কৃষিকাজকে 'পাথরের বাগান' বলে অভিহিত করেছেন।
ইস্টারের মূর্তি প্রসঙ্গে দানিকেন গপ্পো ফেঁদেছেন এই বলে যে কথা-নেই-বার্তা-নেই হঠাৎ এই দ্বীপে এতো মূর্তি এলো কোথা থেকে। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে পুরো পলিনেশিয় অঞ্চল জুড়েই মূর্তি ও পাথুরে মঞ্চ তৈরির একটা সাধারণ প্রবণতা দেখা যায়। কোনো কোনো দ্বীপে মূর্তি আছে (মারকুইসাস, ওস্ট্রান), কোনো দ্বীপে মূর্তির মাথায় শিরোস্ত্রাণও আছে (পিটকেয়ার্ন), পাথুরে মঞ্চকে উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহার দেখা যায় পিটকেয়ার্ন দ্বীপে। ইস্টার দ্বীপের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের সবকিছুই তুলনায় অনেক বড় ও ভারী। সমাজবিজ্ঞানীরা তারও ব্যখ্যা দিয়েছেন এই বলে যে যেহেতু অন্য পলিনেশিয় দ্বীপের মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরো অনেক ব্যাপক ছিল এবং বিভিন্ন দ্বীপের মধ্যে অভ্যন্তরীণ আদান-প্রদান ও বাণিজ্যও চালু ছিল, সেই তুলনায় এক কোনায় পড়ে থাকা ইস্টার দ্বীপ ছিল সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন। দ্বীপবাসীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও ছিল সীমিত। তাই তাদের সকল মনোযোগ যায় মূর্তি নিমার্ণে। তাই আমরা দেখি দ্বীপবাসীরা যেন এক অন্ধ উন্মত্ত প্রতিযোগিতায় শ'য়ে শ'য়ে প্রকাণ্ড সব মূর্তি বানিয়ে চলেছিল।
মূর্তি নির্মাণের এই পর্যায়কাল ব্যাপ্ত ছিল একহাজার খ্রিষ্টাব্দ থেকে ষোলোশো অব্দ অবধি। দেখা যায়, প্রথম দিকের তুলনায় শেষের দিকে মূর্তির সাইজ বাড়তে থাকে। মনে হয়, একটা সামাজিক প্রতিযোগিতার ব্যাপার ছিল যা বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে মান-সম্মান ও গর্বের বিষয় হিসেবে গণ্য হতো। এছাড়া মূর্তি বানানোর আর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই। সামাজিক গর্ব এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল যে দ্বীপের সম্পদের একটা বড় অংশ ব্যয় হয়েছে মূর্তি বানানো ও তাকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার কাজে। এই ব্যাপারটা যদি আমরা আমাদের এখনকার মূল্যবোধ দিয়ে বিচার করি তাহলে ভুল হবে। কল্পনা করুন, প্রশান্ত মহাসাগরের অথৈ কূলে একটা ছোট্ট বিচ্ছিন্ন দ্বীপ যার আশপাশে কোনো দ্বীপ নেই। এক হাজার বছর আগে সেই দ্বীপের মানুষের মানসিকতা যাচাই করা মুশকিল। হিটলারের নেতৃত্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি যেমন উন্মত্ততায় নিজেদের ধ্বংস ডেকে এনেছিল সে উদাহরণ কিন্তু আমাদের চোখের সামনে এখনো মুছে যায়নি। এই কনটেক্সটে ইস্টার দ্বীপের মনোসামাজিক প্রত্রিয়াটি বুঝে নিতে হবে। হাজার বছর আগে ঐ দ্বীপবাসীদের মূল্যবোধ, তাদের মনোজগৎ ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ইস্টারদ্বীপের আগ্নেয়শিলাকে ব্যবহার করেই এই মূর্তিগুলো বানানো হয়েছে। পাহাড়ের আশেপাশে পাথুরে অস্ত্র প্রচুর দেখা যায় যা দিয়ে ঐ মূর্তিগুলো বানানো হয়েছিল। এ বিষয়টি অত্যন্ত পরিস্কার এবং দানিকেনের দাবী এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। একটি মূর্তি বানাতে প্রায় বিশজন কারিগর সারা মাস কাজ করেছে এবং গাছের গুড়ির ওপর গড়িয়ে এইসব মূর্তিকে টেনে সমুদ্রতটে নেওয়া হয়েছে। এই কাজে পঞ্চাশ থেকে পাঁচশত মানুষ লেগেছে। সমান সংখ্যক শ্রমিক লেগেছে মূর্তিগুলোকে খাড়া করতে। এই মূর্তি বানানোর ইন্ডাস্ট্রি চালাতে প্রচুর খাদ্যের জোগান দিতে হয়েছে। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখিয়েছেন এই কাজ চালিয়ে যেতে ইস্টারদ্বীপের মূর্তি গঠনের চূড়ান্ত পর্যায়ের তিনশো বছরে অতিরিক্ত খাদ্য লেগেছে ঐ তিনশো বছরের মোট খাদ্য উৎপাদনের ২৫ শতাংশ। ঐ পর্যায়ে দ্বীপের কৃষিকাজেরও উন্নতি হয়েছিল সবকালের সেরা পর্যায়ে। উক্ত অতিরিক্ত খাদ্য এই সর্বোত্তম ফলন থেকেই এসেছে। এই খাদ্য কিন্তু শুধু মূর্তি বানাতেই যায়নি, মূর্তির নিচে যে পাথুরে মঞ্চ তৈরি করা হতো তাতেও প্রায় সমান সংখ্যক বা আরও বেশি পাথর লাগত। কিন্তু সেইসব কৃষিজমি কই গেল ? তাছাড়া পাথর টানতে প্রচুর দড়ি ও গাছের গুঁড়ি লেগেছে, সেগুলোই বা এলো কোথা থেকে? অষ্টাদশ শতকের ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের লেখা থেকে জানা যায় তাদের চোখেও দশ ফুটের বেশি লম্বা কোন গাছও চোখে পড়েনি। তাহলে?
বর্তমানে ইস্টার দ্বীপে মাত্র আটচল্লিশ প্রজাতির উদ্ভিদ দেখা গেছে যাদের অধিকাংশই গুল্ম ও ঝোপ-জাতীয়। বৃক্ষ-জাতীয় কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই আজ সে দ্বীপে। কিন্তু এই দ্বীপের উদ্ভিদের অবস্থা কি আগেও এমনই ছিল? জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে উদ্ভিদের কি পরিবর্তন হয়েছে? এটা জানার উপায় আছে। গ্রিনল্যান্ড বা অ্যান্টার্কটিকার যেসব জায়গায় কয়েক কিলোমিটার পুরু বরফের আচ্ছাদন আছে, সেখানে ড্রিল করে লম্বা নলাকৃতির আইস-কোর উঠিয়ে নিয়ে আসা হয়। তারপর এসব বরফের মধ্যে বুদ্বুদাকারে জমা হওয়া বাতাসের গঠন পরীক্ষা করলে জানা যায় বহুকাল পূর্বে পৃথিবীর আবহাওয়া কেমন ছিল। এভাবে কয়েক হাজার থেকে কয়েক লক্ষ বছরের জলবায়ুর ইতিহাস জানা যায়। ঠিক একই ভাবে পুকুর বা জলাশয়ের তলা থেকে লম্বা গোল কাদার কলাম তুলে এনে পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব কাদার পরতে পরতে কী রহস্য লুকিয়ে আছে। পুরাকালের বিভিন্ন উদ্ভিদের নানা অবশেষ (বিশেষত পরাগ রেণু) ও অন্যান্য দ্রব্য পানিতে দ্রবীভূত হয়ে এসব জলাশয়ে জমা হয়। তারপর সেসব স্তর পরবর্তী কাদার স্তরে চাপা পড়ে যায়। এভাবে স্তরের পর স্তর কাদার লেয়ার সৃষ্টি হয় যা প্রাচীন কালের জলবায়ু ও উদ্ভিদ সম্পর্কে অমূল্য জ্ঞান দেয়। শ্রীমঙ্গলের বিখ্যাত সাত-তলা চা'য়ের মতো স্তরে স্তরে পুরা-ইতিহাস জলাশয়ের নিচের কাদায় লুকিয়ে থাকে। এই পদ্ধতির নাম পরাগ রেণু বিশ্লেষণ পদ্ধতি বা পলেন অ্যানালিসিস। প্রতিটি স্তরের বয়সও রেডিও কার্বন পদ্ধতিতে নির্ণয় করা যায়।
এভাবে ১৯৮৩ সালে জন ফ্লেনলি অনেকানেক কাদার কোর পরীক্ষা করেন এবং বহুতর বিলুপ্ত প্রজাতির সন্ধান পান। বিশেষ করে লাভার মধ্যে ফসিলায়িত এক বিশেষ প্রজাতির তালের আটির সন্ধান পান। কাছাকাছি প্রজাতির তাল গাছের অস্তিত্ব দেখা গেছে চিলিতে যেখানে ঐ চিলিয়ান তালগাছগুলোর উচ্চতা পয়ষট্টি ফিট হয় এবং গুঁড়ির বেড় তিন ফুট মতো হয়। তবে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত প্রমাণ পেয়েছেন যে কয়েক হাজার বছর আগে ইস্টার দ্বীপে যে ধরনের তালগাছ ছিল তাদের বেড় ছিল অন্তত সাত ফুট। এসব গুঁড়ির সন্ধান জমাটবদ্ধ স্তরের নিচে ঢাকা পাওয়া গেছে। মনে হয় ইস্টার দ্বীপের ঐসব বিলুপ্ত পাম বা তালগাছ একসময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা তালগাছ ছিল। চিলিতে দেখা তালগাছের গুঁড়ি থেকে ভালো জাতের মদ প্রস্তুত করা যায়, সেসব তালের শাঁস অত্যন্ত সুস্বাদ খাদ্য হিসেবে ব্যবহত হয়। তালগাছের খরের বেড়া, নৌকোর পাল, মাদুর ইত্যাদি বানাতে ব্যবহৃত হয়। আর গাছের গুঁড়ি গড়িয়ে মূর্তি বহন তো সহজ সমাধান! ফরাসি প্রত্নতাত্তিক ক্যাথরিন অরলিয়াক ইস্টার দ্বীপে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা বর্জ্যস্তুপ ও তন্দুরের অবশেষ ঘেটে তেইশ শত রকম উদ্ভিদের অস্তিত্ব শনাক্ত করেছেন যাদের এখনো পলিনেশিয় দ্বীপপুঞ্জের অন্যত্র খুঁজে পাওয়া যায়। আরো প্রায় ষোলোটি জাতের বড় বৃক্ষের সন্ধান পাওয়া গেছে যারা ইস্টার দ্বীপে একসময় চমৎকার ফলত। লক্ষণীয় যে, অরলিয়াক যেভাবে এসব উদ্ভিদের খোঁজ পেয়েছেন, তাতে মনে হয় এসব বৃক্ষাদি জ্বালানির কাজে ব্যবহৃত হতো।
এক পক্ষি-বিশারদ ডেভিড স্টিডম্যান বেশ কিছু পাখির হাড়ের সন্ধান পেয়েছেন। মনে হয়, ঐসব পাখি একসময় ইস্টার দ্বীপে বাস করত। তাছাড়া দেখা গেছে, সংগৃহীত হাড়ের অবশেষের প্রায় এক-তৃতীয়ংশাই সাধারণ ডলফিনের।
পলিনেশিয় দ্বীপপুঞ্জের অন্যত্র এতো অধিক-সংখ্যক ডলফিনের হাঁড় পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ ইস্টার দ্বীপের খাদ্যচক্রে ডলফিনের আধিক্য ছিল এবং এসব ডলফিন শিকার করতে দ্বীপ থেকে বেশ দূরে গভীর সমুদ্রে যেতে হতো। কাজেই ইস্টারবাসীদের শক্ত-সমর্থ ক্যানু-জাতীয় নৌকোর ব্যবহার ছিল। এসব দেখে মনে হয়, ইস্টার দ্বীপ একসময় জঙ্গলাকীর্ণ ভূ-স্বর্গ ছিল। কিন্তু মানুষ পদার্পণের সময় থেকেই তার জঙ্গল লোপ পেতে শুরু করে। নয়শ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই জঙ্গল কাটার লক্ষণ দেখা যায়। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন চৌদ্দোশো খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই ইস্টার দ্বীপ থেকে সমস্ত তালগাছ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ষোলোশো চল্লিশ সালের পরে জ্বালানি হিসেবে বৃক্ষাদির অবশেষে আর দেখা যায় না, পরিবর্তে দেখা যায় গুল্মাদির পোড়া অবশেষ। এভাবে মানুষের হাতে জঙ্গল-নিধনের এক জ্বলন্ত উদাহরণ ইস্টার দ্বীপ। জ্যারেড ডায়মন্ডের ভাষায়, "ইস্টার দ্বীপের জঙ্গল নিধনের উদাহরণ সারা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে চরমতম এবং সারাবিশ্বের সবচেয়ে ভয়ানক নিধনের অন্যতম।" দ্বীপটির সমস্ত গাছ বিলুপ্ত হয়ে যায়, বৃক্ষ নিধনের ফলে ভূমির ক্ষয় বেড়ে যায়। একই সাথে প্রোটিন খাদ্যেও ঘাটতি দেখা দেয়। দ্বীপের প্রাণিকূল বিলুপ্তির পথে ছিলই, গাছের ঘাটতির কারণে বড় ও ভালো ক্যানুরও অভাব দেখা যায়। ফলে গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ও ডলফিন শিকারেও ভাটা পড়ে। ইস্টার-সমাজে ভালো গাছ বা কাঠের চাহিদা এতো বেশি ছিল যে ইউরোপিয় অভিযাত্রীদের জাহাজের কাঠ কোথা থেকে এলো তা জানতে দ্বীপবাসী ব্যতিব্যস্ত ছিল : "আদিবাসীরা বারবার এবং উত্তেজিতভাবে 'মিরু' শব্দটি উচ্চারণ করছিল এবং আমরা বুঝতে পারছি তারা বেশ অধৈর্য হয়ে উঠছিল। এই শব্দটি দিয়ে আসলে পলিনেশিয়রা ক্যানু বানানোর কাঠ বোঝায়। এই কাঠই ঐ আদিবাসীরা সবচেয়ে বেশি চাইছিল এবং এটা আমাদের বোঝাতে তারা সর্বান্তঃকরণে চেষ্টা চালাচ্ছিল।" এই রিপোটটি লেখেন একটা ফরাসি জাহাজের কাপ্তান আঠারোশো আটত্রিশ সালে।
পরিবেশের বিপর্যয় হওয়ায় ইস্টার দ্বীপে যা হবার তা-ই হলো । খাদ্যাভাব দেখা দিল। সম্পদের অপচয় পুরোদমে চালু ছিল, কিন্তু সেই প্রাকৃতিক সম্পদ নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছিল না। ফলে জনসংখ্যা সাংঘাতিক রকম কমে আসে। গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। একদল সামরিক নেতার আবির্ভাব হয় যারা পুরনো সর্দারদের উৎখাত করে। একইসাথে পুরনো পুরোহিত সম্প্র্রদায় এবং তাদের মূর্তি নিমার্ণও বন্ধ হয়ে যায়। মানুষের সমস্ত রাগ গিয়ে মূর্তির উপর পড়ে। মূর্তি ফেলে ভাঙা শুরু হয়। মূর্তি এমন এক প্রতীক যা সভ্যতার সৌকর্য-দম্ভ-ক্ষমতা-জৌলুস প্রদর্শন করে। তাই ক্ষুদ্র মানুষ আবার সেই প্রতীককেই আক্রমণ করে বসে। এ ঘটনা আমরা এ আধুনিককালেও দেখেছি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময়ে লেনিনের মূর্তি ভাঙ্গায়, কিংবা রোমানিয়ায় চসেস্কুর মূর্তি ভাঙায়, অথবা ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের মূর্তি ভাঙায়। এই ঘটনা সত্যজিৎ রায়ের 'হীরকরাজার দেশে' সিনেমায় খুব সুন্দর প্রতীকীভাবে উপস্থাপিত হয়েছে ছবিটির শেষ দৃশ্যে: 'দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খানখান।' যেখানে দড়ি ধরে টেনে হীরক রাজার বিরাট মূর্তি উপরে ফেলা হয়। একই রকমে ইস্টার দ্বীপের মানুষেরাও তাদের অন্তর্জালা মিটিয়েছে পুরনো ধর্মীয় চেতনাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে। এমনকি এক পর্যায়ে তারা নরমাংসও ভক্ষণ শুরু করে। ষোলোশো পঞ্চাশ সালের পরে ইস্টার দ্বীপে মুরগির সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু বর্জ্যস্থানগুলোয় নরাস্থির সংখ্যাও বেড়ে চলে। ইস্টারদ্বীপে প্রচলিত সবচেয়ে জঘন্যতম গালির শাব্দিক অর্থ হলো তোর মায়ের মাংস এখনো আমার দাঁতের ফাঁকে লেগে আছে। এভাবে কয়েকশ বছরের অস্বাভাবিক জঙ্গল-নিধন করায় এক সময়ের জঙ্গলাকীর্ণ ইস্টারদ্বীপটি সম্পূর্ণ রিক্ত হয়ে যায়। সেখানে পাল্লা দিয়ে বাড়ে আরো বড় আরো ভারী মূর্তি নির্মাণের প্রতিযোগিতা। দেবতাকে তুষ্ট করে প্রাণ রক্ষার শেষ চেষ্টা যেন-বা।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, সব দ্বীপেই তো মনুষ্য-সৃষ্ট ডিফরেস্টেশন চলে। কিন্তু ভেজিটেশন বা উদ্ভিদ বা সবুজ রেখা তো আবার ফিরে আসে। ইস্টার দ্বীপের ক্ষেত্রে সবুজ রেখা ফিরে এলো না কেন? বড় বড় গাছ আর জন্মালো না কেন? গবেষকরা দেখিয়েছেন যে মানুষের স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ড তো ছিলই, তারা নির্বিচারে গাছ কেটে উদ্বাহু সব মূর্তি বানিয়েছে সে কথা সত্যি। কিন্তু ইস্টার দ্বীপের ভৌগোলিক কয়েকটি ফ্যাক্টর আছে যারা এই দ্বীপটির ডিফারেস্টেশনে প্রভাব রেখেছে। এমন কয়েকটি ফ্যাক্টর আছে যার কারণে দ্বীপটিতে আর নতুন করে গাছ জন্মানোর সুযোগ ও সময় কোনোটাই পায়নি। বিখ্যাত লেখক জ্যারেড ডায়মন্ড এবং ব্যারি রোলেট প্রশান্ত মহাসগারীয় অঞ্চলে ভ্রমণকারী প্রাচীন ইউরোপিয় অভিযাত্রীদের (যেমন ক্যাপ্টেন কুক প্রমুখ) নথি থেকে ঐ অঞ্চলের একাশিটি দ্বীপ সম্পর্কে তথ্য আহরণ করেন। সব দ্বীপেই কম বেশি জঙ্গল নিধন হয়েছে এবং সব দ্বীপেই বনায়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোনো দ্বীপে বেশি, কোনো দ্বীপে কম। ডায়মন্ড ও রোলেট দেখিয়েছেন নয়টি কারণে কোনো দ্বীপে বনায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। কোনো দ্বীপ যদি নিরক্ষরেখা থেকে দূরে ঠান্ডা ও শুষ্ক অঞ্চলে থাকে তাহলে তাদের গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পায়। নিরক্ষীয় অঞ্চলে (যেমন নিউগিনিতে) একটা গাছ কাটলে এক বছরের মধ্যে সেখানে আরেকটি বিশফুট লম্বা গাছ দাঁড়িয়ে যায়, ইস্টার দ্বীপে তা হয় না। এছাড়া দ্বীপে অগ্ন্যুৎপাতের পরিমাণ ও কত আগে সংঘটিত হয়েছে তার উপরও বনায়ন নির্ভর করে। কারণ অগ্ন্যূৎপাতের লাভায় অনেক প্রয়োজনীয় উপকরণ থাকে যা গাছের জন্য সহায়ক। এই লাভা থেকেই পরে উৎকৃষ্ট মাটি তৈরি হয়। ইস্টার দ্বীপে শেষ অগ্ন্যুপাত ঘটেছে দুইলক্ষ বছর আগে। এছাড়াও অন্যত্র অগ্ন্যুৎপাতের ছাই বাতাস-বাহিত হয়ে দ্বীপের মাটিকে উর্বর করে। তাছাড়া পূর্ব ও মধ্য-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপগুলোতে মধ্য-এশিয়ার সমৃদ্ধ ধূলিকণা বায়ু-বাহিত হয়ে এসে উর্বরতা বাড়াতে সাহায্য করে। ইস্টার দ্বীপের ক্ষেত্রে এর সবগুলোই নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কম উচ্চতার দ্বীপ বেশি উচ্চতার দ্বীপের তুলনায়, বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুচ্ছ দ্বীপপুঞ্জের তুলনায় এবং ছোট দ্বীপ বড় দ্বীপের তুলনায় বন দ্রুত হারায়। তাই বলা যায় যে, ইস্টার দ্বীপের মনুষ্য-সৃষ্ট নিধনের পাশপাশি দ্বীপটির ভৌগোলিক অবস্থান তার বন-জঙ্গলকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। তাই এই দ্বীপে নতুন বন তৈরিই হয়নি। অনেকেই বলেন মানুষের কর্মকাণ্ডের তুলনায় পরিবেশের ভঙ্গুরতাই এর ডিফরেস্টেশনের জন্য দায়ী। ডায়মন্ড তাঁর অনবদ্য গ্রন্থ 'কোলাপ্স'-এ তাই বলেছেন,
"ইস্টার দ্বীপ ও আমাদের আধুনিক পৃথিবীর তুলনা গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো সত্য। বিশ্বায়ন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, জেট প্লেন ও ইন্টারনেটের কল্যাণে পৃথিবীর সকল দেশই আজ পরস্পরের সাথে যুক্ত এবং পরস্পরকে প্রভাবিত করে। ইস্টার দ্বীপের বিভিন্ন গোত্রও তা-ই ছিল। এই দ্বীপটি প্রশান্ত মহাসাগরে যেমন নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন ছিল, মহাশূন্যে পৃথিবীও তেমনি নিঃসঙ্গ। ইস্টার দ্বীপবাসীরা যখন বিপদে পড়ল তখন পালাবার কোনো পথ ছিল না, সাহায্য চাইবার মতোও কেউ ছিল না; পৃথিবীবাসীরও একই করুণ দশা হবে যদি তারা বিপদে পড়ে। তাই ইস্টার দ্বীপের সমাজ-ব্যবস্থার পতনকে অনেকেই রূপক হিসেবে, সবচেয়ে খারাপ কী ঘটতে পারে তার উদাহরণ হিসেবে, উপস্থাপন করতে চায়; কারণ ভবিষ্যতে হয়তো এই পরিণতি আমাদের জন্যও অপেক্ষা করছে।" (কোলাপ্স পৃ.১১৯)
কিন্তু প্রশ্ন হলো, একটা সমাজ কখন, কেন এবং কীভাবে নিজেদের পতন নিজেরাই ডেকে আনে? জ্যারেড ডায়মন্ড তাঁর উক্ত বইয়ে তাঁর সুচিন্তিত ও সু-গবেষিত উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন একটা সমাজ প্রথমত সমস্যা যে একটা তৈরি হতে পারে সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকতে পারে। দুয়ার প্রান্তে যখন সমস্যা এসে হাজির হয়, সমাজপতিরা হয়ত তখন সমস্যাকে 'সমস্যা' বলেই মনে করল না। আর যদিও-বা করে দেখা গেল সমস্যার দ্রুত সমাধান নিতেও তারা ব্যর্থ হলো। অথবা সমাধানের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া সত্ত্বেও তারা ব্যর্থ হলো। দেখা যায়, মায়া সভ্যতা (একাধিক খরা ও যুদ্ধ) থেকে শুরু করে গ্রিনল্যান্ডের ভাইকিং সমাজ-ব্যবস্থার পতন–এসব শিল্পবিপ্লব-পূর্ব সমাজ-ব্যবস্থার পতন উপর্যুক্ত কোনো-না-কোনো কারণে ঘটেছে। এইসব কারণের মধ্যে যেটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, অথচ যেটা অত্যন্ত বিস্ময়কর একটা সমস্যা, সেটা হলো মানুষের যৌক্তিক কিন্তু অবিমৃষ্য আচরণ। অর্থনীতি বা সমাজবিদ্যার ভাষায় একে বলে tragedy of the commons। কিংবা সরলার্থে বলা যায়, সংখ্যালঘু মানুষের স্বার্থপর কর্মকাণ্ড দ্বারা সংখ্যাগুরু মানুষের ক্ষতিসাধন। এইসব কর্মকাণ্ড 'যৌক্তিক', কারণ তারা এক শ্রেণীর মানুষের সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা থেকে উদ্ভূত হয়, কিন্তু তাদের যুক্তি-শৃঙ্খল সঠিক থাকলেও নৈতিক প্রশ্নে এসব সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া যায় না। যেমন কোনো সমাজে একশ্রেণীর সংখ্যালঘু কিন্তু প্রভাবশালী ও স্বার্থসচেতন মানুষ এমন এক কাজ করল যাতে তাদের লাভ হয়, কিন্তু ক্ষতি হয় সংখ্যাগুরুর। সামগ্রিক ক্ষতি হলেও ব্যক্তি বিশেষের ক্ষতি অতিসামান্য থাকে, তাই ব্যক্তি-বিশেষ এসব বাদ-বিবাদে জড়াতে চায়না। অতিসামান্য ব্যক্তিক ক্ষতিকে কাজে লাগিয়ে ঐ মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী তাদের স্বীয় স্বার্থ উদ্ধার করে। সবাই সব বুঝেও কেন যেন চুপ থাকে। সবাই-ই মনে করে খামাখা ঝামেলা করে লাভ কী, অন্যেরা পারলে বলুক। এটা সবাই-ই মনে করতে থাকে, তাই কেউ কিছু বলে না। নজরুলের কবিতা স্মর্তব্য,'আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে, তোমার ছেলে উঠলে পরে রাত পোহাবে তবে।' কিন্তু কেউ আর 'জাগে' না, সবাই ভাবে অন্য কেউ জাগুক, তাই রাতও আর 'পোহায়' না। এই ঘটনা সব দেশেই কম-বেশি দেখা যায়। আমাদের দেশে এই ঘটনা আরো প্রবল। ঢাকার শহরের খাল-বিল যেভাবে দখল হচ্ছে, নদী পর্যন্ত দখল হয়ে যাচ্ছে, ফলে পরিবেশের দারুণ বিপর্যয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এক অন্তহীন লোভের চক্রে আমরা পড়ে গেছি, যাকে বলে 'সম্মিলিত উন্মাদনা' বা 'কালেক্টিভ ম্যাডনেস'। আমরা সবাই উন্মাদের মতো স্বল্প-মেয়াদী লাভ খুঁজে চলেছি, এবং ধ্বংস করে চলেছি আমাদের পরিবেশ। দেশের দক্ষিণাংশে দীর্ঘস্থায়ী জলাদ্ধতা দেখা দিয়েছে, সমুদ্রতীরের গাছ উপড়ে ফেলছি শ'য়ে শ'য়ে। সমস্ত খাল-বিল, নদী-নালা ভরাট হয়ে যাচ্ছে, শুধু উঠছে বহুতল ইমারত, এদিকে ভূ-গর্ভস্ত পানির তল নেমে যাচ্ছে। তারপর আবার গোঁদের উপর বিষফোঁড়া–বৈশ্বিক উষ্ণায়ন।
আমাদের কী হবে? উত্তর খুব সোজা, এভাবে চলতে থাকলে ধ্বংস অনিবার্য। পাল আমলের অনিন্দ্য বৌদ্ধ বিহারগুলো সব সেন রাজাদের অত্যাচারে এবং পরে আরব আক্রমণে পরিত্যক্ত হয়। এখন তারা সব ঢিবিতে পরিণত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অংশে আমরা নানাবিধ ঢিবি শুধু দেখি। হাজার-বছরের লালিত সমাজ-সভ্যতা আজ শুধুই ঢিবি। আজ থেকে হাজার বছর পর আমাদের পরিণতিও হবে ঢিবিতে। যদি এই ভূ-খন্ডের কিছুমাত্রও অবশিষ্ট থাকে, তাহলে দেখা থাকে অন্তবিহীন খেত-খামার, খেতের আল, আর বড় বড় ঢিবি। বেঁচে থাকবে শুধু বাংলার আল আর তার ঢিবি সংস্কৃতি।
আপনি-আমি এটাই চাইব কি-না, সেটা আপনার-আমার উপরই নির্ভর করে।
তথ্যপঞ্জি:
১/ জ্যারেড ডায়মন্ড, 'কোলাপ্স', ২০০৫।
২/ এরিক ফন দানিকেন, 'দেবতা কি গ্রহান্তরের মানুষ',অনু. অজিত দত্ত, ১৯৮৬।
৩/ আবুল মোমেন, 'বাংলা ও বাঙালির কথা', ১৯৯২।
ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী:বিজ্ঞান গবেষক ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।