Published : 01 Jul 2025, 08:21 PM
বাংলাদেশ আজ এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি। দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটেছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং আন্তর্জাতিক চাপের প্রেক্ষাপটে। তার পরপরই, প্রায় ভেঙে পড়া একটি রাষ্ট্রকে পুনর্গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকার, যার নেতৃত্বে রয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস। বছরখানেক হতে চলেছে এই যাত্রা শুরুর। যাত্রা শুরু হয়েছিল গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও জাতীয় সংহতির প্রতিশ্রুতি নিয়ে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে—যা হওয়ার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। বরং দেশটি ক্রমশই এক নেতিবাচক প্রবণতার আবর্তে আটকে পড়ছে। অথচ প্রয়োজন ছিল একটি সহনশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্বেষণ, শত্রু বিনাশ নয়, মীমাংসার পথ খোঁজা।
পরিবর্তনের আশায় যে জনগণ রাস্তায় নেমেছিল, তাদের অনেকেই হতাশায় ভুগছেন। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, আমরা আবারও দেখতে পাচ্ছি প্রতিশোধমূলক রাজনীতির পুনরাবৃত্তি—যেখানে হিংসা, হয়রানি ও দমন-পীড়নই হয়ে উঠতে শুরু করেছে শাসনের প্রধান উপকরণ। এটি শুধু হতাশাব্যঞ্জক নয়, গণতন্ত্রের স্বপ্নের পুরো বিপরীত।
অন্তর্বর্তী সরকারের সূচনালগ্নে জনগণের একাংশের মধ্যে একটি সহানুভূতিশীল মনোভাব দেখা দিয়েছিল। অনেকেই আশা করেছিলেন, অতীতের দমন-পীড়ন, দলীয়করণ ও দুর্নীতির অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার হয়তো একটি সহনশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো পথে গেছে।
আওয়ামী লীগকে ‘জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি’ আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ, দলটির হাজারও নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যাপকহারে মামলা ও গ্রেপ্তার, বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ—এসব পদক্ষেপ স্পষ্ট করে দিয়েছে, সংস্কারের চেয়ে প্রতিশোধপরায়ণতাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে আওয়ামী সমর্থকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে আইনি ন্যায্যতা বহুক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়েছে। প্রতিপক্ষকে দমন করতে আইন ও প্রশাসনের অপব্যবহার যেন আওয়ামী স্বৈরতান্ত্রিক কৌশলেরই পুনরাবৃত্তি।
এর ফলে সমাজে এক প্রতিহিংসাপরায়ণ মানসিকতা গড়ে উঠছে, যেখানে ‘শত্রু দমন’ই হয়ে উঠছে রাজনীতির নৈতিক মানদণ্ড। এই প্রবণতা চলতে থাকলে, বাংলাদেশে একটি মুক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্র গড়ে তোলার সম্ভাবনা চরমভাবে বিপন্ন হবে।
অবশ্য, অন্তর্বর্তী সরকার কিছু আর্থিক সূচকে ইতিবাচক অগ্রগতি অর্জন করেছে—মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে এবং আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের আস্থা আংশিকভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এগুলো মূল কাঠামোগত সংস্কারের সূচনামাত্র। বাস্তবে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বদলে দেশে এখন এক প্রকার নৈরাজ্য দখল নিয়েছে।
সম্প্রতি উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে গণপিটুনি ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত সহিংসতার ঘটনা। 'মব জাস্টিস'-এর নামে সংঘটিত সহিংসতা এতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে যে অনেকক্ষেত্রে পুলিশের উপস্থিতিতেও হামলা ঘটে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিষ্ক্রিয় থাকে। এর একটি প্রতীকী উদাহরণ সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার ওপর হামলা।
গত ১১ মাসে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর দ্বারা নির্যাতন, ঘরবাড়ি ও প্রতিষ্ঠান লুট, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্থাপনায় হামলা এমনকি নারী খেলোয়াড়দের প্রতিযোগিতা বন্ধ করে দেওয়া—এসব ঘটনার ঘনঘটায় দেশে এক বিপজ্জনক সামাজিক সংকটের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের অগাস্ট থেকে ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত ‘মব জাস্টিস’-এর ঘটনায় অন্তত ১৭৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
এই পরিসংখ্যান ও প্রবণতাগুলো একসঙ্গে একটি গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়: বর্তমান শাসন কাঠামো কি সত্যিই সংস্কারের পথে, নাকি কেবল পুরোনো দমননীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার আধুনিক সংস্করণ?
বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা এক বিপজ্জনক সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে—যেখানে প্রতিপক্ষকে নিঃশেষ না করে শান্তি প্রতিষ্ঠা অসম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে। এই ‘শত্রু-মূলোৎপাটন’ দর্শন শুধু ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নিষ্ঠুর রূপ হিসেবেই প্রকাশ পাচ্ছে। শাসক বদলালেও রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকৃতি অপরিবর্তিত থাকলে—জনগণের ভোগান্তি কেবল দীর্ঘায়িত হবে, মুক্তি আসবে না।
এই প্রতিহিংসার ধারাবাহিকতা যে কোনো সময় একটি নতুন প্রতিশোধপরায়ণ ঢেউয়ের জন্ম দিতে পারে। দেশে স্থায়ীভাবে তৈরি হচ্ছে এক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার আবহ, যা শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকেই নষ্ট করছে না, অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বিনিয়োগ কমছে, আস্থাহীনতা বাড়ছে—বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে, যারা দীর্ঘ সময় ধরে অবিচার, দমন-পীড়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এসেছিল। তাদের আশা ছিল, শুরু হবে একটি গণতান্ত্রিক ও দায়িত্বশীল রাজনীতির নবযাত্রা। কিন্তু বাস্তবতায় তারা দেখছে, কেবল মুখ বদলেছে, চরিত্র নয়।
ফলে দেশে বাড়ছে রাজনৈতিক হতাশা, নিষ্ক্রিয়তা এবং বিপজ্জনকভাবে চরমপন্থার প্রতি আকর্ষণ। যেসব নতুন শক্তি সহনশীল ও ন্যায়ভিত্তিক রাজনীতির বার্তা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, তারাও এখন দ্বিধাবিভক্ত ‘দুই শিবির’-নির্ভর প্রতিহিংসার খেলায় জড়িয়ে পড়ছে—স্বাধীন কণ্ঠগুলো হারিয়ে যাচ্ছে শত্রু-মিত্রের সরল ছকে।
এই প্রতিশোধমূলক রাজনীতি কেবল বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেই জোরদার করছে না, বরং জনতার সহিংস উন্মত্ততাকেও একধরনের নৈতিক বৈধতা দিচ্ছে। ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিকের প্রতিক্রিয়া’র আড়ালে যেসব ঘরবাড়িতে হামলা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সামাজিকভাবে হেয় করার ঘটনা ঘটছে, সেগুলোর বেশিরভাগই বিচারহীন থেকে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে, যা তাদের নিরপেক্ষতা ও পেশাদারত্ব নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে। এমনকি কোথাও কোথাও পুলিশের উপস্থিতিতেই ‘বিপ্লবের নামে’ সরকারি সম্পদ লুটের ঘটনাও ঘটেছে।
এই প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে—এ কি নতুন বাংলাদেশের রূপরেখা? হিংসা ও প্রতিশোধ কি কেবল পুরোনো কর্তৃত্ববাদের নতুন মোড়ক নয়? যে সরকার গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে ক্ষমতায় এসেছে, জনগণের প্রত্যাশা ছিল তারা সত্যিকারের একটি ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ প্রক্রিয়া শুরু করবে—যেখানে অপরাধীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতি হিসেবে ক্ষমা, সহনশীলতা ও পুনর্গঠনের নৈতিক উচ্চতায় পৌঁছানো হবে।
কিন্তু আমরা বরং ক্রমেই সেই পথ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।
সংস্কারের পথ এখন কণ্টকময়। নতুন কিছু রাজনৈতিক উদ্যোগ—যেমন শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন এনসিপি নতুন রাজনীতির স্বপ্ন দেখালেও, জনমত জরিপে স্পষ্ট হচ্ছে যে পুরোনো, বিতর্কিত দলগুলো আবারও শক্ত অবস্থানে ফিরছে। এতে করে নতুন সম্ভাবনার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ ছাড়া নির্বাচন কখনোই প্রকৃত অর্থে ‘পরিবর্তনের মাধ্যম’ হতে পারে না। সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে, গণতন্ত্র শুধু প্রতিশোধের হাতিয়ারেই পরিণত হবে—পুনর্গঠনের নয়।
এই জটিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের মধ্যে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানও বিবেচনায় নিতে হবে। চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক ও কূটনৈতিক ঘনিষ্ঠতা যেমন ভারতের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াচ্ছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কেও টানাপোড়েন দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশ যদি সত্যিই বহুমুখী পররাষ্ট্রনীতির পথে এগোতে চায়, তবে একটির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে গিয়ে অন্যটির সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করা আত্মঘাতী।
আমাদের দেশের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো একটি ন্যায়ভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ভবিষ্যৎমুখী রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা। এ কাজে প্রতিশোধ নয়, প্রয়োজন হবে রাষ্ট্রনৈতিক উদারতা, সংলাপ ও পারস্পরিক সহনশীলতা। এখানেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সবচেয়ে কঠিন কাজটি দাঁড়িয়ে আছে—দেশের বিভক্ত, রক্তাক্ত রাজনীতিকে একটি মীমাংসা বা ‘ম্যান্ডেলা মুহূর্ত’-এর দিকে নিয়ে যাওয়া। এর অর্থ, অতীতের অপরাধীদের বিচার না করে ছেড়ে দেওয়া নয় বরং বিচার ও ক্ষমার মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করা—যাতে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’-এর কূটনৈতিক ও নৈতিক চেতনা প্রতিফলিত হয়।
একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য শত্রু তৈরির আয়োজন বন্ধ করতে হবে। যে মাটি যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সেই মাটিকে আবার এক ভাইয়ের হাত আরেক ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হতে দেওয়া যাবে না। এই নতুন শুরুর সুযোগ যদি প্রতিশোধের দহনেই ভস্মীভূত হয়, তবে সেটি হবে আরও একটি বড় ভুল—যার মাশুল দিতে হবে আগামী প্রজন্মকে।
এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, শুভ বোধসম্পন্ন মানুষের একটাই জিজ্ঞাসা, দেশনায়করা কি অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবেন, নাকি প্রতিশোধের চক্রে আটকে থাকবেন?
আমাদের বেছে নিতে হবে, আমরা কি পুরোনো প্রতিশোধের ধারা বজায় রাখব, নাকি সত্যিকার অর্থে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা করব, যেখানে প্রতিপক্ষকে নিধনের বদলে সংলাপের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ নির্মাণই হবে প্রধান ধারা।
পরিবর্তন কেবল শাসকের নয়—মনোভাব, নীতি ও রাষ্ট্রচিন্তারও হওয়া প্রয়োজন। না হলে জুলাই-অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানও, ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের মতো, ইতিহাসের গহ্বরে হারিয়ে যাবে।