Published : 30 May 2025, 01:46 PM
রাজধানী ঢাকায় পথের ধারে এক নারী ধূমপান করায় মব জাস্টিসের শিকার হলেন গত ২৭ মে। মবের এই ঘটনাটি শুধু আইনের লঙ্ঘন নয়; বরং এর প্রতিক্রিয়া ছিল একটি সম্পূর্ণ পিতৃতান্ত্রিক, বৈষম্যমূলক ও সাংস্কৃতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট চর্চার বহিঃপ্রকাশ। তিনি সামাজিক মাধ্যমে জানান যে এক দারোয়ান তার ভিডিও ধারণ করে এবং প্রতিবাদ করলে পুলিশের সামনেই তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। এই ঘটনা যেমন নৈতিকতার দোহাই দিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা, তেমনি এটি একটি বৃহৎ সামাজিক সংকটের প্রতিফলন।
এর আগে, গত ৩ মার্চ লালমাটিয়ায় এক চায়ের দোকানে ধূমপান করার দায়ে দুই নারীকে প্রকাশ্যে হেনস্তা করা হয়। প্রশ্ন হলো, কেন শহরে কোনো নারী প্রকাশ্যে ধূমপান করলে তাকে ‘ম্যুরাল পুলিশিং’ ও জনরোষের মুখোমুখি হতে হয়? অথচ পুরুষদের ক্ষেত্রে এ কাজটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে গণ্য হয়ে থাকে। তাহলে কি ধূমপান নারীর জন্য ক্ষতিকর এবং পুরুষের জন্য উপকারী? নাকি নারীর জন্য নিষিদ্ধ এবং পুরুষের জন্য সিদ্ধ?
বাংলাদেশে ২০০৫ সালে প্রণীত ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন’ অনুযায়ী, পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ এবং তা লঙ্ঘন করলে জরিমানার বিধান রয়েছে। যদি এ আইন কেউ লঙ্ঘন করেন, তবে ৩০০ টাকা অর্থদণ্ড হবে। পুনরায় একই অপরাধ করলে দ্বিগুণ হারে দণ্ড হবে।
তবে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার আইনে কিন্তু পাবলিক প্লেস বলতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, আধা সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও বেসরকারি অফিস, গ্রন্থাগার, লিফট, আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্র, হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, আদালত ভবন, বিমানবন্দর ভবন, সমুদ্রবন্দর ভবন, নৌবন্দর ভবন, রেলস্টেশন ভবন, বাস টার্মিনাল ভবন, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণি ভবন, চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেস্টুরেন্ট, পাবলিক টয়লেট, শিশুপার্ক, মেলা বা পাবলিক পরিবহনে আরোহণের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সারি, জনসাধারণ কর্তৃক সম্মিলিতভাবে ব্যবহার্য অন্য কোনো স্থান অথবা সরকার বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক, সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা, সময়-সময় ঘোষিত অন্য যেকোনো বা সব স্থান উল্লেখ করা হয়েছে। পাবলিক প্লেস এই আইন নারী-পুরুষ সবার জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য।
পাবলিক প্লেস বলে নির্ধারিত স্থানেও পুরুষরা নির্বিকারভাবে ধূমপান করে। এর বাইরে তারা রাস্তায়, রিকশায়, দোকানে, এমনকি হাসপাতালের গেটেও অনায়াসে ধূমপান করছে—কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করে না। ধূমপান করার জন্য কখনো কোনো পুরুষকে মব জাস্টিসের শিকার হতে হয়েছে এমন কথা কস্মিনকালেও শোনা যায়নি। ২০০৫ সালে আইনটি প্রণীত হওয়ার মাঝেমধ্যে আইনে নির্ধারিত পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য দণ্ড দিতে হয়েছে বলে শুনেছি। আজকাল তা-ও হয় না।
নারীর ক্ষেত্রেই যত বাধা। আইন প্রয়োগকারী পুলিশ নয়, নীতি পুলিশেরা ‘নীতি-নৈতিকতা প্রয়োগে’ ঝাঁপিয়ে পড়ে। নারীদের প্রায়ই প্রকাশ্যে ধূমপান করার কারণে হেনস্তা করা হচ্ছে, ভিডিও করে সামাজিকভাবে অপমান করা হচ্ছে। কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা নিশ্চিত করা হচ্ছে না। এই ছোট্ট ঘটনাই প্রমাণ করে—এটি কেবল আইনের প্রশ্ন নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক ও লিঙ্গভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়।
বাংলাদেশে যেহেতু প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলিম, ধর্মীয় মূল্যবোধ সামাজিক নীতি-নৈতিকতার গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। ইসলাম ধর্মে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে— যে বস্তু গ্রহণে শরীরের ক্ষতি হয় তা হারাম। পবিত্র কোরানে আছে, আল্লাহ মানুষের জন্য ভালো ও পবিত্র বস্তুসমূহকে হালাল করেছেন এবং অপবিত্র ও ক্ষতিকর বস্তুসমূহকে হারাম করেছেন। (সূরা আল-আ'রাফ, ৭:১৫৭)
এখন প্রশ্ন হলো—ধূমপান কি সেই ভালো ও পবিত্র বস্তুসমূহের অন্তর্ভুক্ত, না কি অপবিত্র ও ক্ষতিকর বস্তুসমূহের মধ্যে পড়ে? ধূমপান নিঃসন্দেহে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগের অন্যতম কারণ। একে অপবিত্র ও ক্ষতিকর হিসাবে গণ্য করা যায়। সেই দিক থেকে ইসলামে এটি হারাম হওয়ার ভিত্তি সুদৃঢ়। শুধু তাই নয়, ধূমপানে অর্থ ব্যয় করাও ইসলামিক দৃষ্টিকোণে নিষিদ্ধ হওয়ার কথা, কারণ সেটা অর্থের অপচয়– এমন অনেক হাদিসও রয়েছে। অতএব, ধর্মীয়ভাবে ধূমপান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই নিষিদ্ধ হওয়ার কথা।
তবুও বাংলাদেশে ইসলামিক বিধান এবং রাষ্ট্রীয় আইন নারীদের ক্ষেত্রে যেভাবে প্রয়োগ হয়, তা প্রায়শই ভিন্নমুখী ও বৈষম্যমূলক। একজন নারী যদি কোনো পাবলিক প্লেসে ধূমপান করে, তাহলে এটা শুধু তার সামাজিক নিন্দার কারণ হয় না, শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের কারণ হয়ে যেতে পারে।
এই বৈষম্যের পেছনে রয়েছে একটি গভীর সাংস্কৃতিক ও লিঙ্গবাদী পক্ষপাত। নারীর হাতে যদি একটি ফিল্টারযুক্ত সিগারেট থাকে, তখন সেটিকে ‘নৈতিক অধঃপতন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই সামাজিক প্রতিক্রিয়া আসলে ধূমপানের বিরুদ্ধে নয়, বরং নারীর ‘নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা’ রক্ষা করার নামে এক প্রকার পিতৃতান্ত্রিক শৃঙ্খলাবদ্ধতা চাপিয়ে দেওয়া। পুরুষের অনিয়ন্ত্রিত অধিকারকে সামাজিকভাবে বৈধতা দেওয়া হলেও নারীর আত্মপ্রকাশকে অপরাধ হিসেবে চিত্রিত করা হয়।
বাংলাদেশে নারীর স্বাধীনতা, চলাফেরা, পোশাক, এমনকি শারীরিক চাহিদার ওপরেও সামাজিকভাবে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। নারীর শরীরকে এখনো ‘পরিবারের সম্মান’ হিসেবে দেখা হয় এবং সেই সম্মানের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে পিতৃতন্ত্র। ফলে একজন নারী যখন শহরের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটি সিগারেট ধরান, তখন তা ‘নৈতিকতার পতন’ বলে বিবেচিত হয়।
কিন্তু আমাদের গ্রামীণ সমাজে, বিগত শতাব্দীর আশির দশকেও নারীর ধূমপানকে সমাজ এমনভাবে দেখত না। পুরনো বাংলা সিনেমা যেমন ‘ভাত দে’ বা ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’-তে দেখা যায় নারীরা তামাক খাচ্ছে খুব স্বাভাবিকভাবেই। গ্রামের বহু নারী, বিশেষ করে যারা চা-বাগান, চালের আড়ত বা পানের বরজে কাজ করেন, তারা প্রকাশ্যে তামাক গ্রহণ করেন। আমাদের মা, খালা, দাদি, নানিরা পরিবারে সবার সামনেই জর্দা-মিশ্রিত পান খান। জর্দা তো সরাসরি তামাক। অথচ আজকের শহুরে নারী যখন ফিল্টার সিগারেট ধরান, তখন সমাজ তার চরিত্র, শালীনতা ও ‘নারীত্ব’ নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
এই দ্বৈত দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস ও নাগরিক আধুনিকতার সঙ্গে সংযুক্ত। গ্রামীণ নারীকে দেখা হয় শ্রমজীবী হিসেবে—তাদের জন্য আলাদা কোনো ‘আধুনিক নারীত্ব’ তৈরি করা হয়নি। কিন্তু শহরের, শিক্ষিত বা মধ্যবিত্ত নারীর জন্য আলাদা এক নৈতিক কাঠামো তৈরি করে দিয়েছে সমাজ, যেখানে তার পোশাক, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, এমনকি তার ধূমপান– সবকিছু নিয়েই রয়েছে সামাজিক নজরদারি।
এই লেখাটির উদ্দেশ্য কোনোভাবেই ধূমপানকে গ্লোরিফাই করা নয়। বরং আমরা এই সত্য মেনে নিই যে ধূমপান নারী-পুরুষ নির্বিশেষে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ ধূমপান সংশ্লিষ্ট রোগে মারা যায়। এর মধ্যে নারীদের সংখ্যাও ক্রমাগত বাড়ছে। ধূমপানের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি—কিন্তু সেই কাজটি যেন কোনোভাবেই লিঙ্গ বৈষম্যমূলক না হয়।
তবে প্রশ্ন হলো, কেন ২৭ মে ঘটে যাওয়া মবের ঘটনাটি, যেখানে নারীটিকে উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশও আক্রান্ত হয়েছে, সেনাবাহিনীর সহায়তা লেগেছে, মতো ঘটনাগুলো সংবাদমাধ্যমে সেভাবে আসে না কেন? নারীটিকে নিরাপত্তাহীন অবস্থায় এতক্ষণ আটকে থাকতে হলো কে? তার মানসিক অবস্থা কেমন? কেন মিডিয়া এই ঘটনাগুলোর পেছনের সাংস্কৃতিক পক্ষপাতের বিশ্লেষণ করে না? এর একটি বড় কারণ কি গণমাধ্যম নিজেই একধরনের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর অংশ? নারীর প্রতিবাদ, যন্ত্রণা বা আঘাত যদি ‘ভিকটিমাইজেশন’ বা ‘ভিকটিম ব্লেইমিং’য়ে পরিণত হয়, তাহলে গণমাধ্যম তার গল্প তুলে ধরতে চায় না? অথবা রাজনৈতিক পাল্লা যেদিকে ভারী ঠিক সেভাবে খবরগুলো মডিফাইড হয়?
মব জাস্টিস একটি অপরাধ, সেটা যে করুক না কেন। কিন্তু যখন একজন নারী ধূমপান করার জন্য জনতার হাতে হেনস্তা হয়, তখন সেটিকে কেউ অপরাধ হিসেবে দেখে না; বরং সেটাকে একধরনের ‘নৈতিক শিক্ষা’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই মনোভাব ভয়ঙ্কর। কারণ এটি নারীকে নাগরিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করে। এটি তাকে একটি নির্ধারিত সামাজিক ফ্রেমে আটকে রাখে, যেখানে তার আচরণ, সিদ্ধান্ত ও স্বাধীনতা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে জনমত, জনরোষ এবং পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ।
ধূমপান হোক বা অন্য কোনো অভ্যাসের কারণে দণ্ড প্রযোজ্য হয়, সেখানে আইন সবার জন্য সমান হতে হবে। যদি কোনো নারী আইন ভাঙে, তার জন্যও নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নিতে হবে, যতটা একজন পুরুষের ক্ষেত্রেও হয়। কিন্তু সেটা কোনোভাবেই জনতার হাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বৈধতা দিতে পারে না।
বাংলাদেশ একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল দেশ। কিন্তু এই সংবেদনশীলতাকে যদি শুধুমাত্র নারীর দমন ও নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে সেটা শুধু নারী নয়, সামগ্রিক সমাজব্যবস্থার জন্যই হুমকি।
অনেক নারীর নিপীড়নের গল্প হয়তো আমরা জানতে পারি না। কিন্তু প্রতিটি ঘটনার পেছনে রয়েছে একটি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, যার বিরুদ্ধে কথা বলা আমাদের দায়িত্ব। আমাদের আইন, সমাজ ও সংস্কৃতিকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে—নারীকে নয়।