Published : 20 May 2025, 04:46 PM
বাংলাদেশে নতুন কিছু চাই না, শুধু একটা হুজুগ চাই। আর ওই হুজুগ যদি হয় রহস্যময়, গন্ধময় এবং একটু-আধটু অবৈজ্ঞানিক— তাহলে তো কথাই নেই! এবারের হুজুগের নাম ‘সান্ডা’। হ্যাঁ, সেই কাঁটাওয়ালা মরুভূমির টিকটিকি, যার নাম শুনলেই এখন বাঙালির চোখ জ্বলজ্বল করে, মুখে ফেনা ওঠে, আর মস্তিষ্কে ঘুরতে থাকে একটাই প্রশ্ন— ‘এই সান্ডার তেলে কি সত্যিই জাদু আছে?’
বাঙালির হুজুগপ্রিয়তার খাতার নতুন পাতায় যোগ হয়েছে এই সান্ডা। আগে যেখানে গরমে সবাই খুঁজত ঠান্ডা, এখন সবাই খুঁজছে সান্ডা। কেউ কবিতা লিখছে, ‘লেজ তোমার সোনার দড়ি, তেল তোমার প্রেমের বড়ি’, আবার কেউ বানাচ্ছে হ্যান্ডি-ক্রাফট, ‘সান্ডা-আকৃতি চাবির রিং!’ বাজারে এখন চাল-ডালের চেয়েও বেশি ডিমান্ডে রয়েছে সান্ডা ও কফিলের ছেলে।
এই হুজুগের উৎস সেই পুরোনো চক্রে— ফেইসবুক-ইউটিউব-টিকটিকি (উফ, টিকটক!)। সৌদি আরবের এক প্রবাসী হয়তো একদিন মরুভূমিতে হাঁটতে হাঁটতে ধরেছিল এক সান্ডা। অসাবধানতায় ওই সান্ডা গেল বিরিয়ানির পাতে। তারপরে যা হওয়ার তাই— ভিডিও পোস্ট, ভিউ লাখ লাখ, আর বাংলাদেশে বয়ে গেল ‘সান্ডা-সুনামি’। এখন দেশের গলি-মহল্লায় গবেষণা চলছে, ‘এই সান্ডা কি আসলেই পেট্রো-ম্যাজিক-প্রেমিক?’
আমাদের স্বঘোষিত গবেষকগণ গবেষণাহীন গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে বলছেন, সান্ডা নাকি এমন এক প্রাণী, যার লেজে আছে প্রেমের দাওয়াই, পিঠে আছে প্রমোশনের ফর্মুলা, আর চোখে আছে সৌদি বেদুইনের ছোঁয়া!
তবে সান্ডা নিয়ে হুজুগটা হালের হলেও আমাদের দেশে সান্ডার তেল প্রাচীনকাল থেকেই ফুটপাতের ক্যানভাসাররা বিক্রি করে আসছেন। তাদের দাবি অনুযায়ী, গৃহস্থালি থেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অবধি— এই তেলের উপকারিতা পাওয়া যায়।
— হাঁটু ব্যথা? সান্ডার লেজ বেটে লাগান!
— প্রেমে ব্যর্থ? তেলটা মাখুন, আকর্ষণ বাড়বে!
— অফিসে প্রমোশন চাই? বসকে সান্ডা রোস্টের দাওয়াত দিন!
— নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হচ্ছে না? ইসি ভবনে সান্ডার ধোঁয়া দিন!
— বিয়েতে সমস্যা? সান্ডার ঘ্রাণ দিয়ে ‘লাভ ম্যারেজ’ হোক!
যে দেশে অন্তর্যামী পানি, ভ্যাকসিন-ক্যানভাসিং এবং দৈবশক্তির ওষুধ বাজারে দিব্যি চলে, সেখানে সান্ডার তেলে কেন আপত্তি হবে?
এই ভাইরাল সান্ডা-দর্শনের নতুন নায়ক ‘কফিলের ছেলে’। কফিল মানে সৌদি মালিক, আর তার ছেলে মানে... আসলে কেউ জানে না সে কে! এক ধরনের মিথ তৈরি হয়েছে তাকে ঘিরে। কফিলের ছেলে এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি। সরকারপক্ষ বলছে, ‘কফিলের ছেলে আসলে বিদেশী ষড়যন্ত্রকারী’। বিরোধী দল দাবি করছে, ‘কফিলের ছেলে সরকারের গোপন এজেন্ট’। মিডিয়া বিশ্লেষণ করছে, ‘কফিলের ছেলে আসলে কার প্রপাগান্ডা?’ সাধারণ মানুষ ভাবছে, ‘কফিলের ছেলে কি আসলেই আছে?’
আমরা এমন এক পর্যায়ে এসেছি, যেখানে ‘জামা-কাপড়, খাদ্য, বাসস্থান’ নয়, বরং সোসাইটির মৌলিক চাহিদা হচ্ছে— সান্ডা তেল, কফিলের ছেলে আর ভাইরাল ভিডিও!
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দর্শন এখন দুটি মূল ভাগে বিভক্ত— আদর্শবাদী বনাম সান্ডাবাদী। আদর্শবাদীরা এখন সংখ্যালঘু। বাকি সবাই হুজুগের বাহক। আজ সান্ডা ও কফিলের ছেলে, কাল হয়তো কফিলের আব্বা— তিনিও ভাইরাল হতে পারেন!
ভাবুন তো, জাতীয় সংসদে নতুন বিল পাস হচ্ছে: ‘সান্ডা সংরক্ষণ ও উৎপাদন নীতিমালা-২০২৫’
— ধারা ৩: নির্বাচনের আগে এক বোতল তেল লাগানো বাধ্যতামূলক।
— ধারা ৭: কেউ যদি ভুয়া সান্ডা বিক্রি করে, তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা এক কেজি আসল সান্ডা খাওয়ানো হবে।
— ধারা ৯: কফিলের ছেলেকে অবৈধভাবে হাস্যরসের কাজে ব্যবহারে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা।
এদিকে মন্ত্রিসভায় আলোচনা চলছে— ‘সান্ডা-ভিত্তিক স্টার্টআপ’ খুলে বিদেশি রেমিটেন্স বাড়ানো যায় কি না!
তরুণদের প্রেমের ভাষাও বদলে গেছে, ‘প্রিয়তমা, তোমার ঠোঁট যেন সান্ডার লেজ, যার প্রতিটি কাঁটা প্রেমের যন্ত্রণা। তুমি যদি কফিলের ছেলের বউ হও, আমি হব তোমার মরুভূমির সাথী— স্যান্ডা!’
যেভাবে ভাইরাল হুজুগ সমাজের সব ক্ষেত্রে ঢুকে পড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে ভিন্ন এক চিত্র দেখা যেতে পারে। যেমন, প্রাথমিক শিক্ষা পাঠ্যসূচিতে ‘আমাদের স্যান্ডা, আমাদের গর্ব’ কবিতা অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স ‘SANDA 101: Viral Ethics and Desert Politics’, জাতীয় দিবস, ১ জুলাই সান্ডা দিবস, সরকারি উদ্যোগ, ‘সান্ডা-সেভার কার্ড’— যার মাধ্যমে সবাই মাসে একবার সান্ডা তেল পাবে ভর্তুকিমূল্যে!
দেশে এখন সবাই এখন সান্ডার তেলে ভাসছেন। একজন কবি লিখেছেন:
‘সান্ডা সান্ডা ডটার বান,
কফিলের ছেলে খায় না মান,
বাংলাদেশ হবে সান্ডার দেশ,
হুজুগে হুজুগে হবে সাফল্য বিশেষ!’
একজন রাজনৈতিক ভাষ্যকার বলেছেন, সান্ডা-পান্ডাদের দিয়ে আর যাই হোক রাজনীতি হয় না।
সত্যি বলতে কী, সান্ডা কেবল একটা প্রাণী নয়, একটা দর্শন। একটা বাঙালিয়ানার প্রতিচ্ছবি। আমরা সারাজীবন হুজুগের লেজে ঝুলে থাকতে ভালোবাসি। কখনো সেটা নির্বাচন, কখনো কারো প্রেমঘটিত ফাঁদ, কখনো রোহিঙ্গা ইস্যু, আবার কখনো ‘বিরিয়ানি বানাতে টিকটিকি’।
আর তাই, সান্ডা নিয়ে যতই হাসাহাসি হোক, মূল কথা হচ্ছে— বাঙালি তার ভাইরালতন্ত্র দিয়ে পৃথিবী জয় করতে চায়। আজ সান্ডা, কাল হয়তো অন্য কিছু। কিন্তু এই হুজুগপ্রিয়তাই তো আমাদের জাতীয় পরিচয়।
ভবিষ্যতে হয়তো ওই ব্যক্তির হাতে নোবেল প্রাইজ উঠবে যিনি প্রমাণ করবেন— ‘সান্ডার লেজ দিয়ে ব্যাটারি চার্জ হয়!’ এমনটি ঘটলে মোটেও অবাক হবেন না। আর যদি সেসব কিছু না হয়, সমস্যা নেই! আমাদের সামনে তখন নতুন হুজুগ আসবে— ‘কফিলের ছেলের বউ দেশি না বিদেশি?’
আসলে আমরা সবাই সান্ডা— একেকজন কাঁটাওয়ালা, মরুভূমির মাঝেও সোশ্যাল মিডিয়ায় বেঁচে থাকা প্রাণী। আর আমাদের কফিল? সে তো ভাইরাল সংস্কৃতি— যে কখনো দেখা যায় না, অথচ সর্বত্র রাজত্ব করে!
রাষ্ট্রের ভেতর যখন একের পর এক সংকট— ডলার নেই, দাম বাড়ে, দুর্নীতি বাড়ে, ভোট নেই, বিচার নেই—তখনও আমাদের মন পড়ে থাকে একটা মরুভূমির টিকটিকির লেজের তেলে! এটা শুধু হুজুগ না, এ একধরনের জাতীয় আইডেন্টিটি।
আমাদের ভবিষ্যৎ লুট হোক, শিক্ষানীতিতে কফিলের ছেলের ছায়া পড়ুক, বিদেশিরা এসে সমুদ্র দখল করুক, তেল গ্যাস বেচে খাক— আমরা হুজুগ নিয়ে বাঁচি। কারণ হুজুগেই আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র কাব্যিকতা।
সাংবাদিকতা মরে গেলে আমরা লাইভে সান্ডা ধরি, রাজনীতি মরে গেলে আমরা স্যান্ডেলউড-গন্ধে প্রেম খুঁজি। স্কুলের পড়ালেখা যখন তেল-চাপায় পিছলে পড়ে, আমরা তখন কফিলের ছেলের ফ্রয়েডিয়ান বিশ্লেষণ পড়ি।
এটা শুধুই হাসির বিষয় নয়, এটা একটা জাতিগত মানসিক অবসাদের সৃজনশীল বহিঃপ্রকাশ। বিশ্ব যেদিকে এগোচ্ছে, আমরা হুজুগে পেছনের দিকে হাঁটছি— কিন্তু এমনভাবে হাঁটছি যেন ওটাই আসল অগ্রগতি!
তাই বলে রাখুন, পরবর্তী প্রজন্ম যখন ইতিহাস বই খুলে পড়বে, হয়তো পাবে এমন লাইন,
‘একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা গণআন্দোলনের নাম ছিল— সান্ডা।’
তারা তখন প্রশ্ন করবে, ‘সান্ডা আন্দোলন কী?’ আমরা উত্তর দেব, ‘একটা ভাইরাল টিকটিকির তেলের বোতল, যা বিশ্বাসের চেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছিল।’
তাই বলাই যায়, আমরা যা-ই হারাই না কেন, হুজুগ হারাই না। কারণ হুজুগেই আসলে আমরা ভালো থাকি।
জয় হোক সান্ডার! জয় হোক হুজুগের! জয় হোক আমাদের সম্মিলিত লেজতত্ত্বের! আমরা হুজুগপ্রিয়, আমরা ভাইরালভক্ত, আমরা এক অদ্ভুত সুন্দর সান্ডা-সনাতন জাতি!