Published : 25 Jun 2025, 08:47 PM
ইরান ও ইসরায়েল যুদ্ধ আপাতত বিরতিতে আছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি ঘোষণায় দুই পক্ষই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তবে শত্রুতা থেকেই গেছে—বরং বলা যায়, আরও বেড়েছে। আসলে ট্রাম্প হলে সেই রকম রাজনীতিবিদ, যার কথা ভাবলে আমাদের কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতার কথঅ মনে পড়ে, ‘রাজনীতিকের ধমনী শিরায় সুবিধাবাদের পাপ’।
ট্রাম্প যুদ্ধ বিরতির ঘোষণাকে যে বিশ্বাস করা যায় না, সে তিনি ইরানের ওপর ইসরায়েলের প্রথম হামলা থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। এখন আবার হুমকি দিয়েছেন ‘ইরান ফের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি চালু করলে আবার হামলা চালাবে যুক্তরাষ্ট্র’। পশ্চিমা সামরিক জোট নেটো সম্মেলনে যোগ দিতে নেদারল্যান্ডসে আছেন ট্রাম্প। সেখানেই সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এই হুঁশিয়ারি দেন।
এটাই ট্রাম্পীয় রীতি। তিনি হুমকি-ধমকি দিতেই থাকবেন। এ যুদ্ধ নিয়ে বিশ্লেষণও চলতে থাকবে; বোমা ও মিসাইলের শক্তি নিয়ে সামরিক বিশ্লেষকেরা অনেক কথা বলবেন। কিন্তু গভীর বিশ্লেষণে না গিয়েও এখনই দু-একটি বিষয় বলে ফেলা যায়।
নিজেদের প্রতিরক্ষা অটুট না রেখেই পারমাণবিক কর্মসূচি এত দূর এগিয়ে নেওয়া ইরানের জন্য বোধ হয় সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। অপরদিকে, আমেরিকার সহায়তা ছাড়া ইসরায়েল যে কতটা অসহায়—তা আবারও প্রমাণিত হলো। এই দুই দুর্বলতা নিয়ে দুই দেশেই সরকার ও জনগণের ভেতরে অনেক আলোচনা চলবে।
ট্রাম্পের গোল: যুদ্ধের মাঠে শেষ হাসি কার?
এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় খেলোয়াড় হলেন ডনাল্ড ট্রাম্প। শেষ সময়ে এসে তিনিই ‘শেষ গোল’ দিয়েছেন। ক্লাস্টার বোমা ফেলে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছেন। কুয়েতের মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের ‘দুর্বল’ হামলা মেনে নিয়ে পরে নিজেই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছেন। সবকিছু ঘটেছে ট্রাম্পীয় ঢঙে—যুদ্ধের শেষভাগে মনে হচ্ছিল ভিডিও গেমের কন্ট্রোলার ট্রাম্পের হাতে। অবশেষে মাঠে নেমে শেষ গোলটা তিনিই করলেন—আর তাতেই খেলা শেষ।
কে জিতল, কে হারল? নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে ইরান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের পরিচালক আলী ভাইয়াজ বলেন, “সব পক্ষেরই এখন জয়ের জন্য নিজেদের মতো আখ্যান আছে, কিন্তু অঞ্চলজুড়ে আরেকটি বড় সংঘাতের ঝুঁকি এড়ানো উচিত।” তিনি বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থামিয়েছে, ইসরায়েল বলছে তারা আঞ্চলিক প্রতিপক্ষকে দুর্বল করেছে, আর ইরান বলছে তারা শক্তিশালী প্রতিপক্ষদের মোকাবেলা করে টিকে থেকেছে।”
এই ব্যালান্সড মূল্যায়ন এসেছে একজন ইরানিয়ানের কাছ থেকে—তাই আরও তাৎপর্যপূর্ণ।
এর মাঝে যুদ্ধবিরতি একবার ভেঙেছিল দুই পক্ষেরই দোষে। ট্রাম্প তাদের দুজনকেই গালি দিয়ে চুপ করান। জেরুজালেম পোস্ট জানিয়েছে, ট্রাম্প সরাসরি নেতানিয়াহুকে আদেশ দেন যুদ্ধবিমান ফিরিয়ে আনতে।
আমেরিকার জনমত: প্রেসিডেন্ট না যুদ্ধপ্রেমী?
এত সব সিদ্ধান্তের পর যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ কী ভাবছে?
সিএনএনের এক জরিপ বলছে, ইরানে বিমান হামলার সিদ্ধান্ত ৫৬ শতাংশ আমেরিকানের কাছে অপ্রিয় ছিল; ৪৪ শতাংশ সমর্থন করেছেন। ৬ ০শতাংশ মানুষ মনে করেন, এ হামলা মার্কিনিদের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করবে।
ট্রাম্প একসময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি শান্তির প্রেসিডেন্ট হবেন। এখন তার সমর্থকরাই হতাশ। নিউইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অনেক ভোটার বলেছেন, তারা যুদ্ধ চাননি।
মিশিগানের ব্রুস বেল বলেন, “আমি ট্রাম্পকে সন্দেহের সুবিধা দিচ্ছি। তবে চাই নিরপরাধ কেউ যেন মারা না যায়।” ওহাইওর ভোটার চার্লস বলেন, “আমি তাকে ভোট দিয়েছিলাম, কারণ তিনি আমাদের মধ্যপ্রাচ্যের ঝামেলা থেকে দূরে রেখেছিলেন।”
টক শোর দেশ আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অন্যতম সমালোচক হলেন ট্যাকার কার্লসন—ফক্স নিউজের সাবেক তারকা। ইরান যুদ্ধ নিয়ে তিনি ট্রাম্পকে বলেন, “ড্রপ ইসরায়েল”—অর্থাৎ ইসরায়েলের যুদ্ধ, তারা নিজেরা করুক।
ইরানের রাস্তা ও রক্ত: প্রতিরোধের স্লোগান
নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, মার্কিন হামলার পর তেহরান ও অন্যান্য শহরে হাজার হাজার ইরানি রাস্তায় নেমে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। তারা এটিকে সরাসরি দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন বলে আখ্যা দিচ্ছেন। একটি শ্লোগান ছিল, “দেশের জন্য দেওয়া রক্ত মধুর চেয়েও মিষ্টি।”
জেরুজালেম পোস্ট জানায়, এতদিনের হামলা সত্ত্বেও ইরানি শাসকদের মধ্যে কোনো ভাঙন দেখা যায়নি। বরং তারা আরও একতাবদ্ধ হয়েছেন।
ইসরায়েলি থিঙ্ক ট্যাঙ্কের ইরান বিশেষজ্ঞ রাজ জিম্মট বলেন, “এই মুহূর্তে ইরানিদের ক্ষোভের লক্ষ্য মূলত ইসরায়েল।”
এদিকে ১৯৭৯ সালে পতিত রেজা শাহ পাহলভির পুত্র যুবরাজ রেজা পাহলভি আজও আশা করছেন, ইসলামিক প্রজাতন্ত্র পরবর্তী ইরানে তিনি নেতৃত্ব দিতে পারবেন। ইসরায়েলি হামলার সুযোগে তিনি বিক্ষোভ, ধর্মঘট ও সরকার পতনের ডাক দিয়েছেন। তবে বাস্তবতা বলছে—তেহরানের রাস্তায় তার ডাক শুনছে না কেউ।
ইউরোপের অনুপস্থিতি: অতীতের টনি ব্লেয়ার, বর্তমানের নীরবতা
ট্রাম্পের আমলে ইউরোপ ও নেটো কার্যত গুরুত্ব হারিয়েছে। ইউক্রেইন যুদ্ধেও ইউরোপের সঙ্গে ট্রাম্প প্রায় যোগাযোগ বন্ধই রেখেছেন। ইরান ইস্যুতে তো আরও বেশি।
একসময় ইরাক যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার প্রতি সপ্তাহে আমেরিকায় ছুটে যেতেন। এখন ইউরোপের সেই ভূমিকা আর নেই।
ব্রিটেন ও জার্মানি ইসরায়েলকে অস্ত্র দিলেও, ট্রাম্প স্পষ্ট করে দেন—এই যুদ্ধে ইউরোপের কিছু করার নেই।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, “ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেওয়া যাবে না।” তিনি কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বানও জানিয়েছেন।
ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “আমরা এই হামলায় জড়িত ছিলাম না।”
জার্মানি অবশ্য দ্ব্যর্থহীনভাবে ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছে।
যুবরাজ বনাম ইসলামিক প্রজাতন্ত্র: ফিরে আসবে কি শাহ?
ইরানি প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান বলেছেন, তারা যুদ্ধবিরতি মেনে চলবেন, যতক্ষণ ইসরায়েল তা মানে। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক গড়তে পারলে ইরান লাভবান হবে। আমেরিকা থেকে সামরিক প্রযুক্তি কিনে প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করা যেতে পারে—তবে তার আগে যুদ্ধ এড়িয়ে চলতে হবে।
যুদ্ধবিরতির পর ট্রাম্প ঘোষণা দেন, তিনি আর ‘রেজিম চেঞ্জ’ চান না। কিন্তু মার্কিন ইহুদি লবি বলছে, ইরানের ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশি হয়নি, শিগগিরই পারমাণবিক কর্মসূচি আবার শুরু হবে। তাই তারা চায়, ট্রাম্প যেন চাপ বজায় রাখেন।
ট্রাম্পকে খুশি করতে ইরানের সম্পদের অভাব নেই। যেমন কাতার তাকে একটি আধুনিক প্লেন উপহার দিয়েছে—যা ট্রাম্প নিজেই ব্যবহার করবেন।
শিয়া-সুন্নি বিভাজন: মুসলিম বিশ্বের অন্তর্দ্বন্দ্ব
একটি স্পর্শকাতর বিষয় হলো মুসলমানদের শিয়া-সুন্নি বিভাজন। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বের প্রায় সব মুসলমান ইরানের পক্ষে থাকলেও, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক রাষ্ট্রে এই বিভাজন ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ইরানকেই এগিয়ে এসে এই বিভেদ নিরসনে উদ্যোগ নিতে হবে। বাহরাইন, ইয়েমেনসহ মধ্যপাচ্যে বসবাসরত শিয়া জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ঐক্য গড়তে হবে, সুন্নিদের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে—নয়তো পাশ্চাত্য আর ইসরায়েল এই বিভাজনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে যাবে।