Published : 25 Sep 2019, 01:57 PM
এ লেখা যখন লিখছি তখন ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুপন ভূঁইয়ার বাসায় অভিযান চালিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। তবে অভিযানে অভিযুক্ত এনামুল হক ও সম্পাদক রুপন ভূঁইয়াকে আটক করা সম্ভব হয়নি। অভিযানে নগদ ১ কোটি ৫ লাখ টাকা, ৭২০ ভরি স্বর্ণ ও অস্ত্র পাওয়া যায়।
মঙ্গলবার সকাল ১০টার পর রাজধানীর পুরান ঢাকার মুরগিটোলা এলাকার একটি ভবনে ওই দুই নেতার দু'টি ফ্ল্যাটে র্যাব অভিযান চালায়। ক্যাসিনো ব্যবসা নিষিদ্ধ ব্যবসা এমন তো বলা যাবে না। বরং আমরা দুনিয়ার নানা দেশে এই ব্যবসার রমরমা দেখি। আমেরিকার লাস ভেগাসকে বলা হয় ক্যাসিনো নগরী। এখানে পৃথিবীর তাবৎ জু্য়াড়ীরা আসে ভাগ্য ফেরাতে। শুধু কি তাই? পর্যটকের দল ও ক্যাসিনো দেখার আকর্ষণেই ছোটে সেখানে। আমি যে দেশে থাকি সেখানেও ক্যাসিনো ব্যবসা জমজমাট। মিডিয়া মোগল ক্যারি প্যাকারদের মেলবোর্ন ক্যাসিনো নামকরা এক পর্যটন কেন্দ্র। ব্যক্তিগতভাবে আমি জুয়া খেলা পছন্দ করি না, খেলতেও জানি না। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার মানুষের মনপছন্দ যে লটো মানে লটারি হাজার হাজার বাঙালি তার জন্য পাগল। যদি ভাগ্য ফেরে এই আশায় প্রতি হপ্তায় লটারি কেনে তারা। আমি তাও পারি না। বড় জটিল সেসব সমীকরণ। যে কথা বলছিলাম, ক্যাসিনো নিষিদ্ধ হোক বা না হোক এখন টক অফ দ্যা কান্ট্রি হচ্ছে ক্যাসিনো ও ক্লাব ।
আমাদের দেশে যত সব আজগুবি কাণ্ড ঘটে। ঘটতে ঘটতে বড় হতে হতে যখন আর সামাল দেয়া যায় না তখন এগুলো খবরে পরিণত হয়। আর খবর যখন কুখবর বা দুঃসংবাদ তখনই তা নিয়ে হৈ চৈ পড়ে যায়। এবারের ঘটনা সাংঘাতিক। বিশেষত আমরা যারা ভেতরের খবর জানি না বা বুঝতে পারি না তাদের জন্য এ এক রহস্য উপন্যাস। একের পর এক জননন্দিত ক্লাবের ভেতর এত টাকা এত নিষিদ্ধ সামগ্রী নেশার বস্তু এগুলো কি একরাতে বা একদিনে চলে আসলো? নানা প্রশ্ন নানা জিজ্ঞাসা জনমনে দানা বাঁধলেও কিছু জানার উপায় নাই। ঢাকা মোহামেডান ক্লাবের মত ঐতিহাসিক ক্লাবও যখন এমন খপ্পরে পড়ে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আতংক জন্মায় বৈকি।
প্রথমত এই ঘটনার পেছনে আমরা দেখলাম যুবলীগের নেতারা জড়িত। এসব ভুইফোঁড় সুবিধাবাদী শামীম মূলত কোন ব্যক্তি নয়। ধীরে ধীরে যেসব তথ্য বেরুচ্ছে তাতে এটা স্পষ্ট কেউ দায় এড়াতে পারে না। একজন নেতা নামধারী অসাধু ব্যবসায়ী বা ডাকাত গোছের লোক এত ব্যাপক হয়ে উঠলো আর দল তা জানে না? এটা নিছক কথার কথা। ধরে নিলাম দলীয় প্রধান জানতো না। বাকীরা? আবার পরবর্তীতে ছাপা হওয়া ছবিগুলোতে দেখলাম এসব সন্ত্রাসীদের গডফাদারেরা ঠিকই জানতেন সবকিছু। তাদের হাসি মুখের ছবি আর আনন্দস্মৃতি প্রমাণ করে খাতির ছিলো। আর একজন লোককে কমান্ডো কায়দায় ছয় সাত জন লোক বড় বড় অস্ত্র নিয়ে পাহারা দেয়, এই লোক এদের সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর কেউ কিছু জানে না? সেসব ছবি ভাইরাল হবার আগে যারা জানতেন তাদের ভূমিকা কি সেটা জানা জরুরি। সবাই বলছে থলের বেড়াল বেরিয়ে আসছে। আমি বলি বেড়াল কোথায়? বেড়ালের চাইতে বড় এক জন্তু বেরিয়ে আসছে যাকে হজম করা সরকার বা অন্যদের জন্যও কঠিন হতে বাধ্য। ক্যাসিনো ব্যবসার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। লিগ্যাল ক্যাসিনো উপমহাদেশের নেপালে চলছে সেই কবে থেকে। এক সময় সেটাই ছিলো একমাত্র ও বিশাল। কিন্তু সেটা নিয়েতো ঝামেলা হয়নি। কারণ তা লিগ্যাল। আমাদের সমাজে সবকিছু উল্টা। দেখুন না যে জাতি ধর্ম সংস্কার আর আচরণ নিয়ে এত গোঁড়া এত বেশি ছোঁক ছোঁক করে তার ভেতরে ভেতরে এতসব পাপ এটা কি মানা যায়?
দেশে বিশেষত ঢাকার পথেঘাটে এমন জুয়া আর ডিজিটাল সমাজ তা জানে না? আগেই বলেছি যে অংকের টাকা পয়সা বা সামগ্রী বেরিয়ে আসছে সেটাও সন্দেহজনক। কোটি টাকা এমন তুচ্ছ আর হাতের ময়লা হলো কবে থেকে? কবে থেকে মানুষ যেখানে সেখানে এত টাকা রাখা নিরাপদ মনে করছে? যারা টাকা পয়সা বিদেশে পাঠায় বা অবৈধ অর্থ দেশে রাখে না তারা কেন এত এত টাকার এফডিআর করলো? এই সত্যগুলো বের না হওয়া অবদি এই রহস্যের আসল জট খুলবে না। এখন দেখছি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতারাই এর জন্য দায়ী বলা হচ্ছে। এতে অবাক হবার কিছু নাই। দেশে তো আর কোন দল নাই। সবাই নাম লিখিয়েছে এক দলে। টানা তিন মেয়াদে সরকারে থাকার পর এরা বুঝে গেছে কিছু করতে হলে সরকারি দলের বিকল্প নাই। তাই দলমত নির্বিশেষে সবাই এখন আওয়ামী লীগ। এজন্যে দেশে বিরোধী দলের দরকার। সুষ্ঠু ও সার্থক বিরোধীতা না থাকলে এমন হবেই। কারণ মুখে যতই উন্নয়নের কথা বলা হোক মূলত আর্থিক উন্নয়ন ছাড়া জিডিপি ছাড়া সমাজ প্রগতি হয়নি। আর সে কারণে টাকার লোভ, নারীর লোভ, মদ আর নেশার লোভে মানুষ বেপরোয়া। যার উদাহরণ চোর ডাকাত বাটপার সবাই এখন আওয়ামী লীগার।
আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর আমল দেখেছি তাদের জানা আছে তিনি কিন্তু শুদ্ধি অভিযান, আত্মসমালোচনা এগুলো চালু করেছিলেন। আর তার ফলে ঘরের দুশমনরা তাঁকে ছাড় দেয়নি। এবার তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা নেমেছেন আসল অভিযানে। শেখ হাসিনার আসন অনেক বেশি শক্ত। আবার এটাও ঠিক তিনিই আছেন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। আন্তর্জাতিকভাবে তিনি যতটা শ্রদ্ধা আর গৌরবের আসনে দেশে ততটাই আছে বিরোধিতা। বাইরে না দেখালেও ঘাপটি মারা দলের নেতা সুবিধাভোগী চামচারাও আছে এই দলে। তাঁর নির্দেশে শুরু হওয়া এই অভিযান তাই একদিকে যেমন আশার আরেকদিকে ভয়ের। তাঁর জন্য যেমন ভয়ের তেমনি আমাদের জন্যও। কারণ মূল ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার ঈঙ্গিত এখনই স্পষ্ট। এমন সব বিষয় এবং এমন সব মানুষ ধরা পড়ছে যাদের সংখ্যা যত বাড়বে তত ঢাকা পড়ে যাবে আসল গডফাদারের দল। এমনটা না হবার জন্য প্রশাসন ও নীতিনির্ধারক মহলে দরকার কঠিন মনোবল। প্রয়োজন সঠিক উদ্যোগ। জানি না তা হবে কিনা। না হলে কেউই আসলে নিরাপদ থাকবে না। কারণ মৌচাকে ঢিল পড়েছে আর কামড় খেতে হবে না, এটা হয় না। সত্যিকারের শুদ্ধি অভিযান চায় জাতি। আমরা চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত শক্তিশালী হোক। আর বাকি কাজগুলো করা হোক অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে। তার ভুল থেকে পাঠ গ্রহণ করে। নাহলে এইসব গডফাদারদের ধরা কঠিন। এখন যে ধারা চলছে তাতে খোদ সরকারি দলেই ভূমিকম্প হতে বাধ্য। সে ভূমিকম্প কিভাবে সামাল দেয়া হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।