Published : 23 Apr 2025, 08:22 PM
‘কাঁচা ইট পাকা হয় পোড়ালে তা আগুনে’– সুকুমার রায়ের ছড়ার ইট পাকানোর মতোই ‘কালো আইন সাদা হয় ক্ষমতার ফাগুনে’। যেমন বিশেষ ক্ষমতা আইন, সন্ত্রাস দমন আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ইত্যাদি।
কোনো সরকারই ‘কালো আইন’ বাতিল করে না। বরং রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধী দলে থাকলে যেটিকে ‘কালা-কানুন’ বলে, সরকারে গেলে তারাই ওই কানুনে তাদের বিরোধীদের শায়েস্তা করে। অর্থাৎ বিরোধী দল থেকে সরকারে বসিলেই কালো আইন সাদা হয়ে যায়! যেমন সন্ত্রাসবিরোধী আইন, জননিরাপত্তা (বিশেষ বিধান) আইন, দ্রুত বিচার আইন ইত্যাদি।
২০১৮ সালে দ্রুত বিচার আইন সংশোধন করে সাজার মেয়াদ বাড়ানো হয়। গণঅভ্যুত্থানে বিতাড়িত আওয়ামী লীগ ছিল তখন ক্ষমতাসীন। ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ওই আইনটি করা হয়েছিল দুই বছরের জন্য। পরবর্তীকালে সব সরকারই আইনটির মেয়াদ বাড়িয়েছে। বাড়িয়েছে সাজার মেয়াদও। সবশেষ গত বছরের মার্চ মাসে মেয়াদ বৃদ্ধির পরিবর্তে আইনটি স্থায়ী করা হয়।
২০০২ সালে যখন আইনটি করা হয় তখন তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এর তীব্র বিরোধিতা করেছিল এবং তারা এই আইনকে ‘আওয়ামী লীগ দমন আইন’ বলে অভিহিত করেছিল। অথচ তারাই এই আইনে সাজার মেয়াদ বাড়িয়েছে। অর্থাৎ বিএনপি যেমন এই আইনটিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে ব্যবহার করেছিল, আওয়ামী লীগও তা-ই করছে।
বিশেষ ক্ষমতা আইন ও মেঘনা আলম
১৯৭৪ সালে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে, ধ্বংসাত্মক তৎপরতা (Sabotage), কালোবাজারি, মজুদদারি, চোরাচালানি, নোট, মুদ্রা বা সরকারি স্ট্যাম্প জাল করা, খাদ্য ও ওষুধে ভেজাল মেশানো, ইত্যাদি অপরাধ সংগঠন কিংবা অপরাধ সংগঠনের জন্য উদ্যোগ বা প্রস্তুতি গ্রহণের দায়ে শাস্তি দেয়ার জন্য যে ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন’ প্রণয়ণ করা হয়েছিল, সেটি ৫০ বছর ধরে বহাল তবিয়তে রয়েছে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি পরপর দুটি ঘটনায় এই আইনের প্রয়োগ করা হয়েছে— যার মধ্যে একটি ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তো বটেই, মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও তোলপাড় চলছে।
সম্প্রতি এই আইনে মেঘনা আলম নামে এক মডেল ও অভিনেত্রীকে আটকের পরে প্রশ্ন উঠেছে, তাকে কেন এরকম একটি বিতর্কিত আইনে আটক করতে হলো? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে আটক করতে গিয়ে যা যা করেছে, যা যা বলেছে এবং এই ইস্যুতে এখনও যা কিছু হচ্ছে— তা একটি নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে আদৌ কাঙ্ক্ষিত ও কাম্য ছিল কি না?
মেঘনা আলম কোনো রাজনৈতিক নেতা নন। তার বিরুদ্ধে সৌদি রাষ্ট্রদূতের একটি অফিসিয়াল অথবা আনঅফিসিয়াল অভিযোগের ভিত্তিতে গোয়েন্দা পুলিশ তথা রাষ্ট্র যে আচরণ করেছে, তাতে প্রশ্ন উঠেছে, রাষ্ট্র আসলে কাকে সুরক্ষা দিতে চায়, তার নিজের দেশের নাগরিককে নাকি বিদেশি কূটনীতিককে? উপরন্তু মেঘনা আলমকে আটকের ইস্যুতে সরকারের দুজন শীর্ষ ব্যক্তি যে বিপরীতমুখী বক্তব্য দিয়েছেন, তাতেও জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে— যা আদৌ প্রয়োজন ছিল না।
গত ৯ এপ্রিল রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে আটক হওয়ার আগ মুহূর্তে ফেইসবুক লাইভে এসে মডেল মেঘনা আলম অভিযোগ করেছিলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা তার ঘরের দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো ব্যাখা দেয়া হয়নি। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হলে পরদিন তাকে ঢাকার সিএমএম আদালতে নেয়া হয় এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩০ দিনের আটকাদেশ দেয় আদালত।
গত ১২ এপ্রিল গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে মিথ্যাচার ছড়ানোর মাধ্যমে আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক অবনতির অপচেষ্টা করার অভিযোগে মেঘনা আলমকে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছে।
পরদিন ১৩ এপ্রিল সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মডেল মেঘনার ব্যাপারে কিছু অভিযোগ আছে, সে বিষয় তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে সবকিছু যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে তাকে গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া ঠিক হয়নি।’ অথচ এর দুদিন পরে ১৫ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী সাংবাদিকদের বললেন, ‘বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক মডেল ও অভিনেত্রী মেঘনা আলমের সঙ্গে বেআইনি কিছু করা হয়নি।’
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। দুদিন পরে ১৭ এপ্রিল সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় দায়ের করা একটি চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে মেঘনা আলমকে। অথচ এর আগে গোয়েন্দা পুলিশ মেঘনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে মিথ্যাচার ছড়ানোর মাধ্যমে আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক অবনতির অপচেষ্টার অভিযোগে এনেছিল। যদি তাই হয় তাহলে চাঁদাবাজির মামলায় কেন তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হলো?
পুলিশের ভাষ্য, গত ২৯ মার্চ ধানমন্ডির একটি জাপানি রেস্টুরেন্টে এক কূটনীতিকের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা আদায়ের পরিকল্পনায় বৈঠক করেন মেঘনা ও তার সহযোগীরা। তার মানে চাঁদা নেয়াও হয়নি। চাঁদা আদায়ের পরিকল্পনা, আর তাতেই বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তার! তাহলে কি এখানে ঘটনা ভিন্ন? রাষ্ট্র বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি কোনো একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে খুশি করতে চেয়েছে অথবা তারা কোনো কিছু আড়াল করছে? মেঘনা আলম যদি সত্যিই অপরাধী হয়ে থাকেন, তাহলে তার প্রকৃত অপরাধ বা তার বিরুদ্ধে আনীত প্রধান অভিযোগেই মামলা হতে পারে বা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। কিন্তু সরকারের আচরণে মনে হচ্ছে তারা মেঘনার ব্যাপারে যা বলছে, তার সবটুকু সত্য নয় বা কিছু সত্য তারা আড়াল করছে অন্য কিছু আড়াল করার জন্য।
মেঘনা আলমের মুক্তির দাবি জানিয়ে ‘নারী সহিংসতার বিরুদ্ধে নারীরা’ নামে একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে উপদেষ্টাকে দেয়া স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রযন্ত্র ক্ষমতাধরদের সেবা দিতে ব্যবহৃত হচ্ছে, আইনের নামে নিপীড়ন চালাচ্ছে এবং সরকারের লোকজনের পক্ষ থেকে আসা দুঃখজনক অজুহাতের আশ্রয় নিচ্ছে। সরকার ভয়ভীতি, বিভ্রান্তি, মিথ্যা তথ্য, চরিত্র হনন, নারী বিদ্বেষপূর্ণ ইঙ্গিত ব্যবহার করে মানবিক আচরণ থেকে নিজেকে মুক্ত করেছে এবং ওয়ারেন্ট ছাড়াই একজন নারীর বাসায় প্রবেশ করে তাকে অপহরণ করার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। মুজিব আমলের বিশেষ ক্ষমতা আইন ব্যবহার করে ও বিনা কারণে আটক রেখে রাষ্ট্র যে অমানবিক ও বেপরোয়া ক্ষমতা প্রয়োগ করছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।’
হঠাৎ কেন এই আইন?
মেঘনা আলমের এই ঘটনার কাছাকাছি সময়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনের আরেকটি প্রয়োগ (মূলত অপপ্রয়োগ) ঘটে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় বানানো মোটিফে আগুন দেয়ার ঘটনায়। নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে চারুকলায় তৈরি করা ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ এবং একটি শান্তির পায়রা মোটিফে আগুন দেয় এক যুবক। ওই ঘটনায় ১২ এপ্রিল রাজধানীর শাহবাগ থানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি মামলা করে। এই মামলাটিও করা হয় বিশেষ ক্ষমতা আইনে। প্রশ্ন হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান একটি বিতর্কিত আইনের আশ্রয় নিতে গেল কেন? মোটিফে আগুন দেয়া বা নাশকতার ঘটনায় সাধারণ আইনেই মামলা করার সুযোগ ছিল।
২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রথম আলোর একটি খবরে বলা হয়, বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিলুপ্ত হওয়া ধারায় পুলিশ ১৫ জন শ্রমিকনেতার বিরুদ্ধে মামলা করে তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে। খবরে বলা হয়, বিজিএমইএ ৫৫টি কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেয় ২০১৬ সালের ২০ ডিসেম্বর। এর ঠিক আগের দিন শ্রমিকনেতারা ‘ষড়যন্ত্র’ বা অপরাধ সংঘটনের চক্রান্ত করেছেন— এই অভিযোগ আনে পুলিশ। আশুলিয়ার পুলিশ বাদী হয়ে ১৫ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের করে, তাতে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিলুপ্ত হওয়া ১৬(২) ধারা প্রয়োগ করা হয়।
তবে এরপরে দীর্ঘদিন এই আইনের প্রয়োগ কার্যত হয়নি। হঠাৎ করে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে কেন এই বিতর্কিত আইনের প্রয়োগ ঘটানো হলো—তা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন আছে। বিশেষ করে এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই প্রধান উপদেষ্টা এবং আইন উপদেষ্টা যেখানে বারবার বলেছেন যে, তারা নিবর্তনমূলক এবং যেসব আইন নাগরিকের কথা বলার অধিকার সংকুচিত করে সেসব আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনবেন। প্রয়োজনে ত্রুটিপূর্ণ আইন বাতিল করবেন। এরকম প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরেও বিশেষ ক্ষমতা আইনে কেন একজন নারীকে ফিল্মি কায়দায় আটক করতে হলো এবং প্রথমে একধরনের অভিযোগ করা হলেও পরে তাকে কেন আরেকটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হলো—তার সদুত্তর মেলেনি। বরং মেঘনা আলমকে আটককে ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারীর যেভাবে সাফাই গেয়েছেন—তা অতীতের কর্তৃত্বপরায়ণ ও গণবিরোধী সরকারগুলোর আচরণই স্মরণ করিয়ে দেয়।
আইনের ‘নিজস্ব গতি’
সংবিধান বলছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী (অনুচ্ছেদ ২৭)। আর আইন সম্পর্কে বলা হয়, সে তার নিজস্ব গতিতে চলে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ‘আইনের নিজস্ব গতি’ ব্যাপারটি বরাবরই গোলমেলে। কেননা আইন চলে ক্ষমতাবান তথা সরকারের হাত ধরে।
আইনগুলো এমনভাবে তৈরি হয় যাতে মনে হবে আইনের কাজই হলো ক্ষমতাবানদের সুরক্ষিত রাখা। যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (বর্তমান নাম সাইবার নিরাপত্তা আইন) প্রয়োগ (মূলত অপপ্রয়োগ) দেখে এটা মনে করার যষ্ট কারণ আছে যে, এই আইনটি তৈরি করা হয়েছে ইন্টারনেট দুনিয়ায় ক্ষমতানদের কথিত ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য। অথচ আইনের উদ্দেশ্য ছিল পর্নোগ্রাফি প্রতিরোধ এবং ডিজিটাল দুনিয়ায় নাগরিকের সুরক্ষা। কিন্তু আইনের প্রয়োগ দেখলে মনে হবে, এই আইনের চোখে নাগরিক মানে যার হাতে ক্ষমতা আছে।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, আইনের নিজস্ব গতি বলে কিছু নেই। গতি নির্ধারিত হয় প্রধানত রাজনৈতিকভাবে। এর সঙ্গে অনেক সময় যুক্ত হয় ক্ষমতা, অর্থ ও অন্যান্য চাপ। প্রতিটি আইন কোন গতিতে চলবে এবং কাকে কতটুকু গতিতে গিয়ে সে পাকড়াও করবে, তা নির্ভর করে রাষ্ট্র বা সরকারের ওপর। কোন আইন কখন সক্রিয় থাকবে অথবা কতটুকু ক্রিয়াশীল থাকবে এবং সে কাকে ধরবে এবং কোন তরিকায় ধরবে, সেটি নির্ভর করে সরকারের রাজনৈতিক অভিলাষের ওপর। দ্বিতীয়ত, আইনের গতি নির্ভর করে যারা ওই আইনের প্রয়োগ করেন, অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর। তৃতীয়ত ব্যক্তির ওপর। অর্থাৎ একই আইন একই অপরাধে ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে। আচরণ করে মানে আইনকে যেভাবে বলা হয়, সে সেভাবে অ্যাক্ট করে। কারণ তার নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। নেই বলে অনেকে রসিকতা করে বলেন, আইন হচ্ছে সুবোধ বালক। সে একা হাঁটতে পারে না। তাই সে তার বাবার হাত ধরে চলে।