Published : 12 May 2020, 04:22 PM
"করোনাভাইরাস" মানবজাতির কাছে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় আতংকের নাম। পৃথিবীজুড়ে মানবজাতির অস্তিত্বকে সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে এই অদৃশ্য ভাইরাস। ধন সম্পদের আধিক্য, বিশাল খনিজ ভাণ্ডার বা পারমানবিক অস্ত্রের ঝনঝনানি সবই যেন এই ভাইরাসের সামনে অসহায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এত অসহায় অবস্থায় মানবজাতিকে আর পড়তে দেখা যায়নি।
প্রথম যে প্রশ্নটা মাথায় আসে তা হল এই রোগটি কি পৃথিবীতে এই প্রথম? সেই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় করোনাভাইরাস ১৯৬০-এর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। প্রথমদিকে মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে এটি প্রথম দেখা যায়। পরে সাধারণ সর্দি-হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এরকম দুই ধরনের ভাইরাস পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যে পাওয়া ভাইরাস দুটি 'মনুষ্য করোনাভাইরাস ২২৯ই' এবং 'মনুষ্য করোনাভাইরাস ওসি৪৩' নামে নামকরণ করা হয়।
এই দুই প্রজাতির মধ্যে থেমে থাকেনি ভাইরাসটি এরপর থেকে বিভিন্ন সময় ভাইরাসটির আরো বেশ কিছু প্রজাতি পাওয়া যায় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৩ সালে 'এসএআরএস-সিওভি', ২০০৪ সালে 'এইচসিওভি এনএল৬৩', ২০০৫ সালে 'এইচকেইউ১', ২০১২ সালে 'এমইআরএস-সিওভি' এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালে চীনে 'নভেল করোনাভাইরাস'। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ভাইরাসের ফলে শ্বাসকষ্টের গুরুতর সংক্রমণ দেখা দেয়।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে ২১শ শতকের আগ পর্যন্ত করোনাভাইরাসগুলি মানুষের দেহে সাধারণ সর্দি-কাশি ব্যতীত অন্য কোনও উপসর্গ বা রোগব্যাধি সৃষ্টি করত না। কিন্তু ২১শ শতকে এসে এ পর্যন্ত ৩টি নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের উদ্ভব হয়েছে (সার্স, মার্স ও উহান করোনাভাইরাস) যেগুলি মানব সম্প্রদায়ে ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে প্রাণঘাতী আকার ধারণ করার ঝুঁকি বহন করে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রথমে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান নগরীতে শনাক্ত করা হয়। ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ২১২টিরও বেশি দেশ ও অধীনস্থ অঞ্চলে ৪১,৪৮,০৩৪ এরও বেশি ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে সংবাদ প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। ১১ মার্চ ডব্লিউএইচও এই প্রাদুর্ভাব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সম্প্রদায়ে সঞ্চালন ঘটায় বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত এই ভাইরাস বাংলাদেশকেও আক্রমণ করেছে। বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্তের ঘোষণা আসে। তারপর থেকে বাংলাদেশের মানুষকেও এই ভাইরাসের কারণে ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়েছে। করোনাভাইরাস আতংকের সাথে আরেকটি বিষয় মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে তা হচ্ছে স্বাস্থ্যখাতের ব্যবস্থাপনা। তিন মাস প্রস্তুতির সময় পেয়ে যে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে তা কি পর্যাপ্ত ছিল? বারংবার যথেষ্ট প্রস্তুতি আছে বলে যে বুলি আওড়ানো হয়েছে তা কি সত্যিই পর্যাপ্ত ছিল? নাকি শুধু রাজনৈতিক মাঠ গরম করার বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে ছেলে ভোলানো গল্প শোনানো হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর মানুষ এখনো খুঁজে ফেরে।
যখন মানুষ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সেই সময় মানুষের সেই উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ঘিরে পুঁজিবাদী শ্রেণির এক ধরনের শোষণতান্ত্রিক আচরণ। জনসমাগম করোনাভাইরাসের জন্য যে ভয়ংকর হতে পারে তা জানা সত্ত্বেও অযথা গার্মেন্টস খোলাকে কেন্দ্র করে জনসমাগম ঘটানো হয়েছে। যা করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য ছিল অতি ভয়াবহ একটি বিষয়।
সর্বশেষ যে বিষয়টিকে ঘিরে মানুষের উদ্বেগ চরম আকার ধারণ করেছে তা হল খুলে গেছে মার্কেট, শপিং মল। তবে বলা হয়েছে বিকাল ৪টার মধ্যে বন্ধ করতে হবে এই শপিং মল। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি লকডাউন শিথিল করে ভারতকে দিতে হয়েছে চরম মূল্য। এক দিনে আক্রান্ত হয়েছে ৪ হাজার মানুষ। যে সময়ে আমাদের দেশের আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ হাজারের অধিক ঠিক সেই সময়ে এই ধরনের সিদ্ধান্ত জাতির জন্য কতটা বিভীষিকাময় পরিস্থিতির অবতারণা করতে পারে সেটা চিন্তা করে জাতি উদ্বিগ্ন। মার্কেট হচ্ছে এমন এক জায়গা যেখানে ক্রেতা ও বিক্রেতার সম্মিলন ঘটে থাকে। ক্রেতা ও বিক্রেতা শ্রেণির সম্মিলন যেখানে ঘটে থাকে সেখানে জনসমগম হবে না এই ধরনের চিন্তা আমরা কিভাবে করলাম সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যেহেতু আমরা এখনও সব করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে পৃথক করতে পারিনি তাই কিভাবে নিশ্চিত হতে পারি যে একজন করোনাভাইরাস রোগীর স্পর্শকৃত পণ্য আরেকজন সুস্থ মানুষ এসে স্পর্শ করবে না? অথচ বিজ্ঞান বলে একজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর স্পর্শকৃত বস্তু যদি একজন সুস্থ মানুষ স্পর্শ করে নাকে বা মুখে হাত দেয় তিনিও করোনাভাইরাস আক্রান্ত হতে পারেন। তাহলে আমরা জেনেশুনে এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছি কার স্বার্থে? যেখানে আক্রান্ত সংখ্যা ১০ হাজারের অধিক হবার পর যখন উন্নত বিশ্বের দেশগুলো লকডাউনকে কঠোর করেছে সেখানে আমরা শিথিল করছি আসলে কোন যুক্তিতে?
এই মার্কেটে আসা যাওয়াকে কেন্দ্র করে রাস্তাঘাটে আরেক দফা জনসমাগম বৃদ্ধি পাবে যেই জনসমাগম করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সহায়তা করবে। আরেকটি বিষয় একেবারেই বোধগম্য না তা হচ্ছে সন্ধ্যার আগে সব বন্ধ করার চিন্তা। পৃথিবীর কোনো গবেষণাই আজ পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারেনি যে করোনাভাইরাস একটি নিশাচর ভাইরাস যা শুধু রাতের আধারে সক্রিয় হয়। তাহলে এই দিন রাতের খেলা কেন? বরং জনসমাগম নিরুৎসাহিত করতে হলে মার্কেট দুর্যোগপূর্ণ সময়ে বন্ধ রাখা উচিৎ।
তবে এই মার্কেট খোলাকে কেন্দ্র করে এক ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে জাতি। জীবিকার চেয়ে জীবন বড় এই স্লোগানকে সামনে রেখে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যে সাড়া মিলেছে তা অভূতপূর্ব। সেই প্রকৃত ব্যবসায়ীরা জাতির এই সংকটময় মুহূর্তে নিজেদের মুনাফার কথা না ভেবে জনস্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে মার্কেট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঈদ তাদের ব্যবসায়ের জন্য অনেক বড় মৌসুম তা জানা সত্ত্বেও তারা তাদের ব্যক্তি স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে। জাতি অবশ্যই এই সব প্রকৃত ব্যবসায়ীদের তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না।
তবে এর সাথে এই সংকটকালীন মুহূর্তে মুদ্রার আরেক পিঠও প্রত্যক্ষ করেছে জাতি। দেখেছে ব্যবসায়ের নামে কিছু স্বার্থান্বেষী মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের কদর্য রূপ। যারা শুধু মুনাফার কথা চিন্তা করে জাতির এই সংকটময় মুহূর্তে তাদের ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানকে খোলা রেখেছে। যেখানে স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেও শঙ্কাবোধ করেছেন যে দোকানপাট ও মার্কেট খুলে দেয়া হলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়বে। শুধু তাই না, সম্প্রতি একটি জরিপে উঠে এসেছে দেশের ৯৩ ভাগ মানুষ শপিং মল না খোলার পক্ষে মতামত দিয়েছে। কিন্তু সেই তথাকথিত মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা জনমত এবং জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকির প্রতি বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে মুনাফা লাভের নিমিত্তে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বহাল তবিয়তে খোলা রেখেছেন। একটু চিন্তা করলেই দেখব এরা কারা? এদের কেউ হয়ত শেয়ার বাজারে নামিয়েছে ধস, এদের কেউ হয়ত এনজিও'র নামে বিদেশ থেকে টাকা এনে গরীব মানুষের কাছে চড়া সুদে খাটিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছে, এদের কেউ হয়ত নিরাপদ জনস্বাস্থ্যের কথা বলে বিদেশ থেকে ফান্ড এনে এখন জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলতে দ্বিধাগ্রস্থ হচ্ছেন না। এদের কাউকে হয়ত পণ্যের দাম নিয়ে নয়-ছয় করার কারণে মোবাইল কোর্ট থেকে জরিমানা করাও হয়েছে। তারপরেও তাদের অর্থলিপ্সা তো থামেইনি বরং দিনকে দিন বেড়েই চলছে। তাই জাতির প্রকৃত ব্যবসায়ীদের যেমন সম্মান করা উচিৎ তেমনি এই সব তথাকথিত মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের ঘৃণা ভরে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বর্জন করা উচিৎ।
আমাদের সামনে আছে নিউইয়র্ক, ইতালি বা স্পেনের মত ভয়াবহ উদাহরণ। সেই উদাহরণ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। লকডাউন শিথিল বা সময় মতো সঠিক সিদ্ধান্ত না নেবার ফলে উন্নত বিশ্বে করোনাভাইরাসের যে ধাক্কা তাদের উপর এসেছে সেই ধাক্কা তাদের মতো মানসম্পন্ন চিকিৎসা ব্যবস্থাই সামাল দিতে পারেনি। আমাদের যদি সেই রকম কাছাকাছি ধরনের কোনো ধাক্কা আসে তাহলে আমাদের এই নাজুক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কি হবে তা কল্পনাও করা যায় না। তবে হতবাক করার মত বিষয় হচ্ছে সব জানার পর আমাদের মতোই কিছু মানুষ এই শপিং মলগুলোতে যাওয়ার জন্য লাইন দিচ্ছে। তাদের এই ভয়াবহ আত্মঘাতী আচরণ পুরো দেশকে কী ভয়ানক পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে তারা কি তা বুঝে না? নাকি বুঝতে চায় না?
তাই উচিৎ হবে না কোনো শ্রেণি বা গোষ্ঠীর চাপে পড়ে আবেগতারিত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া। বাস্তবতার নিরিখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একটি পরিবার দুঃখে কষ্টে দিন যাপন করে হয়ত টিকে থাকতে পারবে কিন্তু পরিবারের প্রধান আয় করা ব্যক্তিটি মারা গেলে সেই পরিবারের জন্য অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা হয়ে যাবে দুষ্কর।
মনে রাখতে হবে, নগর পুড়লে দেবালয় রক্ষা পায় না। তাই করোনাভাইরাসের দাবানল একবার ছড়িয়ে পড়লে তা নিভানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। কাজেই যা করার সময় থাকতেই করতে হবে। সরকারকে যেমন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে বাস্তবিক হতে হবে তেমনি জনসাধারণকেও নিজের এবং নিজের পরিবারের কথা চিন্তা করে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কারণ সময় গেলে সাধন হবে না।