Published : 07 Jul 2020, 05:02 PM
ভারত ও চীন ক্রমাগত বেড়ে ওঠা দুটি পরাশক্তির নাম পৃথিবীর মানচিত্রে। এ দুটি প্রতিবেশী দেশের রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জনপথ। জনসংখ্যা ও আয়তনে পৃথিবীর মানচিত্রে বৃহৎ ভাবে অবস্থান উভয় দেশেরই। তবে দীর্ঘ ইতিহাসে দেশ দুটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়নি বললে ভুল হবে না। যদিও ১৯৫০ সালে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী হিন্দি-চীনি ভাই ভাই স্লোগান উঠেছিল। তবে তা শুধু কার্যকর হয়েছে বর্ডারে উত্তপ্ত সহিংসতা শেষে হাত মেলানোর সময়েই। বন্ধুত্বের সম্পর্কের আবহটা যথাযথ ভাবে পরিপূর্ণ না হলেও বৃহৎ এই দুই জনপদের অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা যথাযথ বা বেশ ভালোই বলা চলে। প্রতি বছরে দুই দেশের মধ্যে ১৭০-১৮০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়ে থাকে।
বিগত ২ মাসের মতো সময় ধরে সিনো-ইন্ডিয়ান সীমান্ত এলাকায় মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে পিপলস রিপাবলিক আর্মি ও ভারতীয় আর্মি। এমন মুখোমুখি অবস্থান নতুন কিছু নয় এই দুই দেশের কাছে। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ ৪ হাজার কিলোমিটারের মতো জায়গা জুড়ে সীমান্তরেখা রয়েছে। প্রায়শই উত্তেজনা লেগেই থাকে সীমান্ত এলাকাগুলোতে। তবে এবারের উত্তেজনা একটু আলাদা বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। লক্ষণমতে দীর্ঘ ৪০ বছর পর রক্তপাত হলো সিনো-ইন্ডিয়ান সীমান্ত এলাকায়। গত ১৫ জুন রাতে মুখোমুখি সংঘর্ষে উভয় দেশেরই সেনাসদস্য নিহত ও আহত হন।
পৃথিবী যখন করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বিপর্যস্ত ঠিক এই সময় হঠাৎ এমন আগ্রাসী মনোভাব ভাবাচ্ছে পুরো বিশ্বকে। দক্ষিণ চীন সমুদ্রে নৌ সামরিক মহড়া বৃদ্ধি ও প্রতিবেশী দেশগুলো যেমন তাইওয়ান, হংকং এবং ভারতসহ প্রায় প্রত্যেকটি দেশের সাথে যুদ্ধাংদেহী মনোভাব চীনের।
প্রত্যেকটি পদক্ষেপ নেয়া হয় নির্দিষ্ট কোনো কারণ বা ফলের আশায়। তবে হঠাৎ চীনের এই আগ্রাসনের পেছনেও একাধিক উদ্দেশ্য রয়েছে। যদিও কোনো উদ্দেশ্যই মহৎ বা কল্যাণকর নয় বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। যার অন্যতম একটি কারণ সমগ্র পৃথিবীর চীনের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। আর যার জন্যই চীন এমন আগ্রাসী মনোভাব নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের উহান নামক প্রদেশের এক জীবজন্তুর বাজার থেকে। যা আজ সমগ্র পৃথীবিকে প্রায় অচল করে দিয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশই আজ ক্ষিপ্ত চীন দেশের ওপর। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের উৎপত্তি চীনের এক প্রদেশে এবং চীনের অসাবধনতা ও তথ্য লুকানোর জন্য পৃথিবীময় এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। এমনটাই অভিযোগ তুলেছে অনেক দেশ। তাই বিশ্বের অনেক দেশই এর অনুসন্ধান ও সঠিক কারণ অন্বেষণ করতে দাবি তুলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে। আর যা চীন ভালোভাবে নিচ্ছে না বলেই সবার ধারণা। যার কারণেই ভারতসহ চীনের সাথে সীমান্ত সম্পর্কিত ২১টি দেশের সাথে কোনো না কোনোভাবে সীমান্ত বিবাদে জড়াচ্ছে চীন। যা শুধু মূল বিষয় থেকে দৃষ্টি সরানোর জন্য বলেই মনে করছে বিজ্ঞজনেরা।
যদিও চীন একটি দৃঢ় ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষ এবং ভারতের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে কিন্তু ৩ জুলাই হঠাৎ নরেন্দ্র মোদীর লাদাখ সফর ও গত ১৫ দিনে ভারতের নেওয়া বিভিন্ন সামরিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পদক্ষেপ বুঝিয়ে দিয়েছে যে ভারতও একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ।
মোদীর এই লাদাখ সফর ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অত্যন্ত উদ্বুদ্ধ করেছে। সাথে সাথে ৫৯টি চীনা অ্যাপ বন্ধ করে অর্থনৈতিক ভাবে আঘাত করেছে চীনকে। ভারত সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে চীনকে চিন্তায় ফেলেছে ও চীনের সুবিধাজনক অবস্থানকে প্রতিহত করছে। চীনের কোম্পানিগুলির প্রবেশ ভারতে বন্ধ হয়ে গেছে। ভারতীয় রেল ও বিএসএনএল চীনের যন্ত্রপাতির নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। MTNL তাদের 4G সার্ভিস অপগ্রেড টেন্ডার থেকে চীনা কোম্পানিকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। ভারতের সড়ক পরিবহনমন্ত্রক ও বিদ্যুত মন্ত্রক চীনা কোম্পানির বিনিয়োগ বন্ধ করছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যও ভারত সরকারের পথ অনুসরণ করছে। সাংহাই টানেল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে দিল্লী-মিরাট RRTS করিডোর থেকে বাদ দেওয়ার দাবি উঠেছে। চীনের কোম্পানিগুলির পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাতিল করেছে।
তাছাড়াও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও কূটনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভারত অনেক এগিয়ে গেছে। ২৭ জুন ভারতীয় নৌ-বাহিনী ও জাপানের নৌ-বাহিনী একসঙ্গে ভারত মহাসাগরে মহড়া দিয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি রাশিয়া সফরে গিয়ে অত্যাধুনিক মিসাইল ও যুদ্ধবিমান ক্রয়, পুরনো বিমানের স্কোয়াড্রন আধুনিকীকরণ ইত্যাদি চুক্তি করে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি পুতিনের সঙ্গে এ ব্যাপারে জুলাই মাসের ২ তারিখে কথা বলেছেন ও পুতিন তাকে দু'দেশের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ এর ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন। এর মধ্যে ১ জলাই আমেরিকার সেক্রেটারি অফ স্টেট ভারতের ৫৯টি চীনা অ্যাপকে নিষিদ্ধ করাকে সমর্থন করেছেন। ভারতের এই সংকটময় সময়ে সর্বভাবে সাথে থাকবার কথা বলেছে আমেরিকা। তাছাড়াও আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত একটি আগামীর সম্ভাবনাময় চতুর্ভুজের সুরক্ষাবলয় নতুন শক্তির উদয় বলে মনে করছে বিশ্বের বিজ্ঞজনেরা। চিরবন্ধু রাশিয়া, ফ্রান্স ও ইসরাইল পাশে থেকে কাজ করবার প্রত্যয় ভারতকে অনেকটাই এগিয়ে রাখছে বিশ্ব রাজনীতিতে ও চীন ভারত মুখোমুখি অবস্থান প্রেক্ষাপটে।